মাত্র তেরো বছর বয়স ছেলেটির। আস্তানা থেকে বেশ অনেকটা দূরে খাবারের খোঁজে গহীন বনের ভেতর এসেছিলো সে বড় ভাইয়ের সাথে। হঠাৎ করেই পথ হারিয়ে ভাইয়ের চেয়ে কিছুটা দূরে চলে আসায় ভয় ভয় করতে থাকে তার ভেতরটা। এমন সময়েই তীব্র গর্জন শুনতে পায় সে। ঠিক তার পেছন থেকেই আসছে শব্দটি। এমনিতে ভয়ংকর প্রাণী দেখে অভ্যস্ত সে। তবে আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই প্রচন্ড ভয়ে জমে যায় তার শরীর।
সেই প্রাণীটি। এই তো মাত্র কিছুদিন আগেই তার বাবাকে মেরে ফেলেছে লোমশ এই প্রাণীটি। বাবার মতো এতো শক্তিশালী মানুষও পেরে ওঠে নি এর সাথে। ভয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য নড়াচড়া করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে সে। তবে হঠাৎ করেই সম্বিৎ ফিরে পায় সে। না, এভাবে সে হেরে যেতে পারে না, কিছু একটা তাকে করতেই হবে। সে জানে যে, যুগ যুগ ধরে তারা মানুষ, ভয়ংকর দর্শন প্রাণী ও প্রকৃতির তাড়া খেয়ে আসছে। বেঁচে থাকার জন্য ক্রমাগত লড়াই করেই যাচ্ছে। কিন্তু আর কতোকাল এভাবে চলতে দেয়া যায়! হঠাৎ করেই মাত্র তেরো বছর বয়সের এক কিশোরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো, কয়েক সেকেন্ডেই যেনো মনের গহীন থেকে অত্যন্ত সবল হয়ে উঠলো সে। কিছু একটা তাকে করতেই হবে। আসার পথে বেশ অনেকগুলো লতানো গাছ চোখে পড়েছিলো তার। হঠাৎ করেই সর্বশক্তি দিয়ে সেদিকে দৌড়াতে শুরু করলো সে। পেছন পেছন প্রাণীটিও ধেয়ে আসছে বুক কাঁপানো গর্জন করতে করতে। বনে আসার আগে বাবার দেয়া চোখা অস্ত্রটি আনতে ভোলে নি সে। এক দৌড়ে বড় মতোন একটি গাছে তরতর করে উঠে অনেকটা অবচেতনভাবেই অনেকগুলো লতা নিজের শরীরের সাথে পেঁচিয়ে চোখা ধাতব অস্ত্রটি থলে থেকে বের করে নিলো সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উপর থেকে লক্ষ্য স্থির করলো সে। শরীরের সাথে শক্ত করে প্যাঁচানো লতার সাথে আড়াআড়িভাবে চোখা অস্ত্রটিকে কায়দা করে টেনে লক্ষ্য বরাবর তীব্র গতিতে ছেড়ে দিলো সে। সোজা প্রাণীটির চোখ বরাবর গিয়ে মস্তিষ্ক ভেদ করে স্থির হলো সেটি। মাত্র একটি আঘাতেই শক্তিশালী প্রাণীটিকে কোণঠাসা করার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো নিজের দক্ষতা টের পেলো ছেলেটি। বড় হতে হতে ছেলেটি একজন দক্ষ তীরন্দাজ বনে গেলো এবং তার এই দক্ষতা সে ছড়িয়ে দিয়েছিলো তার স্বজাতির মাঝে। তাই তো প্রত্যেক সিথিয়ানই ছিলো একজন দক্ষ তীরন্দাজ। হ্যাঁ, বলছি ‘সিথিয়ান’ বা ‘শক’ নামের সেই যাযাবর জাতির কথা, যারা কালের পরিক্রমায় ভাগ্যের তাড়নায় ঘুরে বেড়িয়েছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত এবং রপ্ত করেছিলো টিকে থাকার অভিনব কৌশল। এক পর্যায়ে তারা সক্ষম হয়েছিলো নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরী করতে, সক্ষম হয়েছিলো ক্ষমতা হাতে তুলে নিতে। আর সিথিয়ানদের এই গল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদেরই উপমহাদেশের ইতিহাসের সাথে, যা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
১৯৭৮ সালের দিকে গ্রীক-রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভিক্টর সারিয়ানিডির অধীনে সোভিয়েত-আফগানের একটি দল উত্তর আফগানিস্তানের টিলিয়া টিপে একটি খননকার্য পরিচালনা করেন। এই খননে একটি প্রাগৈতিহাসিক মন্দিরের ভেতর ৬টি সমাধি পাওয়া গিয়েছিলো, যার মধ্যে পাঁচটিতে ছিলো নারী দেহাবশেষ এবং একটিতে ছিলো পুরুষ দেহাবশেষ। প্রতিটি সমাধিতে দেহাবশেষগুলোর সাথেই মিলেছিলো অত্যন্ত সমৃদ্ধ অলঙ্কার, মুদ্রা ও নানাবিধ শিল্পকর্মের সংগ্রহ। এই সমাধিগুলো থেকে পাওয়া রাজকীয় মুকুট, গোলাকার খন্ডে সজ্জিত ছোরা ও অন্যান্য শিল্পকর্মগুলো খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর একটি যাযাবর জাতির হস্তশিল্পের সাথে দারুণভাবে মিলে যায়। এমনকি সেখানে যে মুদ্রাগুলো পাওয়া গিয়েছিলো, সেগুলোও ছিলো খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর, কোনো মুদ্রাই এর পরের সময়ের নয়। সুতরাং আবিষ্কৃত সেই সমাধিগুলো যে অনুমিত সেই যাযাবর গোষ্ঠীর অধিবাসীদেরই ছিলো সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আর অনুমিত এই যাযাবর গোষ্ঠী আর কেউ নয়, এরা ছিলো ইন্দো-সিথিয়ান বা শক জনগোষ্ঠী।
প্রশ্ন জাগতেই পারে যে কারা এই ‘শক’? কি করেই বা তারা জুড়ে আছে উপমহাদেশের ইতিহাসের সাথে? চীনের মহাপ্রাচীর সম্পর্কে কমবেশি জানে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। তবে এই মহাপ্রাচীরের সূত্রপাত যে কারণে হয়েছে তা হয়তো অনেকেই জানেন না। খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ অব্দে চীন বিভিন্ন খন্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিলো। উত্তর চীনের এমনই কয়েকটি রাজ্য ছিলো- কিন, উই, ঝাও, কিউ, হান, ইয়ান এবং ঝোংশান। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে ‘জিওংনু’ নামের যাযাবর উপজাতিদের একটি সংঘ উত্তর চীনের এই রাজ্যগুলোতে ক্রমাগত আক্রমণ ও লুটতরাজ চালাতে থাকে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে কিন রাজ্যের রাজা হুয়াং-টি অন্য রাজাদের সংঘবদ্ধ করে নিজেকে সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ও তার নেতৃত্বে ‘জিওংনু’ সংঘের উপজাতিদের কবল থেকে চীনকে মুক্ত করার জন্য সারি সারি দুর্গ নির্মাণ শুরু হয়। প্রায় এক শতাব্দী সময় ধরে এসব দুর্গই ‘চীনের মহাপ্রাচীর’ এর আকার ধারণ করে। এই মহাপ্রাচীরের নির্মাণ ভারতীয় উপমহাদেশের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিলো। চীনের এই প্রতিরোধ যাযাবর সম্প্রদায়কে পিছু হটতে বাধ্য করে। তখন ‘জিওংনু’ এর ‘চানিউ’ ছিলো লাও-শাং। সে সময় যাযাবর সম্প্রদায়ের নেতৃত্বদানকারীকে ‘চানিউ’ বলা হতো। সম্পদ লুটপাটের সুযোগ ও চারণভূমি হারিয়ে যখন ‘জিওংনু’ এর অধিবাসীরা দিশেহারা হয়ে পড়লো, তখন লাও-শাং এর নেতৃত্বে তারা উত্তর পশ্চিম চীনের তারিম বেসিনের সমৃদ্ধ কৃষি মরূদ্যানে বসবাসরত ‘ইউ-চি’ উপজাতিদের আক্রমণ করলো এবং ‘ইউ-চি’ রাজাকে হত্যা করে তার মাথার খুলি দিয়ে একটি পানীয়ের কাপ বানানো হলো। ‘জিওংনু’ দের আকস্মিক আক্রমণে পরাজিত ‘ইউ-চি’-রা পশ্চিমের দিকে পালাতে বাধ্য হলো এবং এক পর্যায়ে তারা নিজেদের চারণভূমির প্রয়োজনে কাজাখস্তানের ইসিক্কুল হ্রদের কাছে বসবাসরত ‘উ-সুন’ উপজাতিদের উপর আক্রমণ করে তাদের রাজাকে হত্যা করলো। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দে পরাজিত ‘উ-সুন’-রা আরও পশ্চিম ও দক্ষিণে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। তখন শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের সুযোগে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ‘গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান’-রা ভারতবর্ষের সীমান্তের খুব কাছাকাছি উত্তর আফগানিস্তানে সমৃদ্ধ বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিলো। কিন্তু পরাজিত ও ক্ষিপ্ত ‘উ-সুন’ দের আকস্মিক আক্রমণে সমৃদ্ধ গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য মাটির সাথে মিশে যায়। ফলে গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ানরা পাঞ্জাবের দিকে পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু ‘উ-সুন’-রা তাদেরকে তাড়া করতে করতে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে পাঞ্জাবে প্রবেশ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫ অব্দের কাছাকাছি সময়ে চূড়ান্তভাবে তাদেরকে পরাজিত করে। বিজিত এই যাযাবর ‘উ-সুন’ সম্প্রদায়ই পরবর্তীতে ‘ইন্দো-সিথিয়ান’ বা ‘শক’ বলে পরিচিত হয়।
সিথিয়ানদের ভারতবর্ষে প্রবেশ ভারতবর্ষের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব তো ফেলেছিলোই, সেই সাথে পুরো বিশ্বেই তখন এই ঘটনা একটি আলোড়ন তৈরী করেছিলো। গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ানদের উপর বিজয়প্রাপ্তির মাধ্যমে তাদের গড়ে তোলা সম্পদ লুট করে সিথিয়ানরা কি পরিমাণ সমৃদ্ধি ও ক্ষমতা লাভ করেছিলো তা টিলিয়া টিপ থেকে আবিষ্কৃত সোনার অলঙ্কার ও মুদ্রাগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা সম্ভব, কেননা প্রচুর সম্পদশালী না হলে এমন বহুমূল্যবান সম্পদ কোনো সমাধিতে অর্পণ করার কথা নয়। প্রভাবশালী সিথিয়ানরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেই থেমে যায় নি, তারা আরও পশ্চিমে অগ্রসর হতে থাকে এবং পার্থিয়ান রাজ্য আক্রমণ করে পার্থিয়ান রাজা দ্বিতীয় ফারাতেসকে হত্যা করে।
সিথিয়ানরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলো মূলত দুটি রুটের মাধ্যমে। একটি হলো, কুঞ্জেরাব পাস বা বর্তমান পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর হয়ে গিলগিট ও তক্ষশীলা এবং অপরটি হলো, বোলান পাস হয়ে সিন্ধু ও গুজরাট। সিথিয়ানদের প্রথম দলটিই পরবর্তীতে পাঞ্জাব আক্রমণ করে মথুরায় চলে যায় এবং তাদের দ্বিতীয় দলটি চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত গুজরাট, সিন্ধু, মালওয়া ও রাজস্থান শাসন করেছিলো।
এমন কৌতুহল হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, কি এমন ছিলো, যা সিথিয়ানদেরকে ভারতবর্ষের গভীর থেকে আরও গভীরে প্রবেশ করতে আকর্ষণ করেছিলো। এটি ছিলো ভারতবর্ষের বিপুল সমৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সে সময় আকর্ষণীয়ভাবে আকার নিতে শুরু করা চীন থেকে রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ ‘সিল্ক রুট’। সিথিয়ানরা ছিলো ঘোড়সওয়ার সম্প্রদায়। পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া প্রাণীবিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞান তাদের জন্য সবচেয়ে সেরা ঘোড়া বাছাই করা সহজ করে দেয়, যার ফলে তারা সর্বোচ্চ গতিশীলতা লাভ করে। সব মিলিয়ে তাদের বাণিজ্যের পথ হয়ে ওঠে অত্যন্ত সুগম।
ইন্দো-পার্থিয়ানদের সাথে ইন্দো-গ্রীকদের সংঘর্ষ লেগেই থাকতো, যার ফলে সিল্ক রোডের বাণিজ্য ব্যাহত হতো। তবে ইন্দো-গ্রীকদের পরাজয়ের ফলে ইন্দো-সিথিয়ান ও ইন্দো-পার্থিয়ানরা একসাথে সহজেই কাজ করতে পারছিলো বলে চীন, রোম, পার্থিয়া এবং ভারতবর্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়।
গ্রীক ঐতিহসিক হেরোডোটাসের মতে, সিথিয়ানরা প্রথমে বাস করতো কৃষ্ণসাগরের তীরে। খ্রিস্টপূর্ব ৫১২ অব্দে পারস্যের সম্রাট দারিয়ুসের আক্রমণে তাদের বিশাল আবাসস্থল হাতছাড়া হয়ে যাবার পর তারা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। ভারতবর্ষে প্রবেশের পর সিথিয়ানরা উত্তরাঞ্চলীয় বেলুচিস্তানে বসতি স্থাপন করেছিলো, যা তখন ‘শাকাস্থান’ ও বর্তমানে ‘সিস্তান’ নামে পরিচিত।
ইন্দো-সিথিয়ানরা ইন্দো গ্রীকদের চেয়েও অনেক বেশি সময় রাজত্ব করেছিলো। এক পর্যায়ে তারা ভারতীয় জীবনধারার সাথে চমৎকারভাবে মিশে যায় এবং ভারতীয় রঙিন সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতির মতো করে লালন করে। তারা ছিলো মূলত ইন্দো-ইরানি মিলিটারি শক্তি।
সিথিয়ানরা ছিলো মধ্য এশিয়ার মঙ্গোলীয় ইরানি যাযাবর পশুপালক গোত্র। তাদের গতিময়তা ছিলো বিস্ময়-জাগানিয়া। ঘোড়া ছিলো তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ঘোড়াপালন ছিলো তাদের পেশা ও নেশা। ভারতীয়রা তাদেরকে ‘শক’ বলে অভিহিত করলেও পুরো পৃথিবীতে তারা মূলত ‘সিথিয়ান’ নামেই পরিচিত ছিলো। তারা নিজেদেরকে বলতো ‘স্কুদাত’, অর্থাৎ ‘তীরন্দাজ’। তারা ছিলো সার্থক তীরন্দাজ। অব্যর্থ ছিলো তাদের লক্ষ্য। চলন্ত ঘোড়ায় বসেও দক্ষতার সাথে তারা শত্রুকে আক্রান্ত করতে পারতো। তারা ব্যবহার করতো উন্নতমানের তীর। প্রসূতি সাপের বিষে তীরের ফলা ডুবিয়ে তীরকে করে তুলতো মরণঘাতক। বিশেষভাবে তৈরী তাদের তীরের ফলার পেছনে থাকতো আটটি আংটা। একবার সেই তীর কারো শরীর ভেদ করে ঢুকলে তা বের করা ছিলো প্রায় অসম্ভব। বিষমাখানো ও কাঁটাযুক্ত তীরের প্রচলন তারাই প্রথম করেছিলো। সিথিয়ানদের পরিধেয় বস্তুর মধ্যে পায়জামা ছিলো উল্লেখযোগ্য। মৃতের সমাধি তাদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করতো। তাদের সমাধিসৌধ থেকে পাওয়া প্রচুর শিল্পকলায় অদ্ভুতভাবে পুরুষ হরিণের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত পুরুষ হরিণকে তারা মৃতের আত্মার বাহক মনে করতো।
প্রাচীন সিথিয়ানদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্তমানের একটি নিষিদ্ধ দ্রব্য ছিলো তাদের অত্যন্ত প্রিয় বস্তু। বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত এই উদ্ভিজ্জ নেশাদ্রব্যটি হলো গাঁজা। গাঁজা শুধু তারা সেবনই করতো না, বরং এটি ছিলো তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গাঁজার ধোঁয়াকে তারা পবিত্র বলে মানতো। তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গাঁজার কোনো বিকল্প ছিলো না। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষা করা হতো গাঁজার পবিত্র ধোঁয়ার মাধ্যমে, এমনকি মৃতের সমাধিতে রাখার জন্য গাঁজার বীজ ছিলো একটি অত্যাবশ্যকীয় বস্তু। সিথিয়ানদের মাধ্যমেই প্রথম মধ্য এশিয়া থেকে সংগ্রহকৃত গাঁজা গ্রীসসহ বিশ্বের বহু সংস্কৃতিবান জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যায়। সিথিয়ানদের গাঁজা সেবনের এই ইতিহাস হেরোডোটাসের লেখা থেকে জানা যায়। হেরোডোটাসের লেখা থেকে আরও জানা যায়, সিথিয়ানরা মৃতের মাথার খুলিতে পানীয় গ্রহণ করতো। সিথিয়ান এবং গ্রীকরা ছিলো পরস্পরের চিরবিরোধী, আর এ কারণেই হেরোডোটাসের লেখায় শুধু সিথিয়ানদের নেতিবাচক দিকগুলোই উঠে এসেছে।
সিথিয়ানদের গল্প এতোটাই নাটকীয় এবং একই সাথে এতোটাই বাস্তব যে, মনে হয় যেনো কোনো সিথিয়ান-গ্রীক রণক্ষেত্র একদম চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। এই তো, পাঞ্জাবের কোনো এক অংশে ছোট ছোট ক্যাম্পফায়ার বা আগুনের কুন্ডলী এদিক-ওদিক জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পরই সেই আগুনের মাঝে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, যার পট পট শব্দটাও যেনো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ছুঁড়ে ফেলা বস্তুটি হলো গাঁজা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে গাঁজার ধোঁয়া। মন্ত্রের তালে তালে সন্ন্যাসীরা তাদের দৈববাণী জপ করে চলেছে। তৈরী হয়েছে এক গুরুগম্ভীর পরিবেশ। ঢোলের আওয়াজে প্রত্যেক যোদ্ধার অন্তরে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে। ঢোল বেজেই চলেছে। রণক্ষেত্রে পুরুষের সাথে নারীরাও সমান তালে অংশগ্রহণ করেছে, কেননা সিথিয়ানদের মধ্যে নারীর মর্যাদা ছিলো পুরুষের সমতুল্য। নারীযোদ্ধারা তাদের শিশুদের স্তন্যপান করিয়ে বুক ভরে গাঁজার ধোঁয়া নিয়ে তৈরী হচ্ছে সম্মুখ-সমরের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ, মৃদঙ্গের তাল, অস্ত্রের ঝনঝনানি যেনো রক্ত হিম করা এক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। এ যেনো মৃত্যুর ভয়াবহতারই পূর্বাভাস। অন্য দিকে গ্রীকরাও তাদের রণপোশাকে প্রস্তুত। তারা অপেক্ষা করে আছে এই মদ-গাঁজা সেবনকারী অসভ্য-বর্বর জাতিটিকে যুদ্ধে পরাস্ত করার জন্য। এর আগেও বহু বার তাদেরকে পরাস্ত করেছে গ্রীকরা। কিন্তু গ্রীকরা জানে না যে, এবার তারা এসেছে বিজয়ী হতে, এবার নিজেদের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে তাদেরই কাছে। গ্রীকরা জানে না যে, ভারতবর্ষের বেশ কিছু অংশ শাসিত হবে এই বর্বর গোষ্ঠীর মাধ্যমেই। গ্রীকরা জানে না যে, যে শিক্ষিত প্রতিবেশীরা তাদেরকে বর্বর বলে হেয় করতো, তাদের উপরই রাজত্ব করবে তারা। গ্রীকরা জানে না যে, বর্বরতার আবরণ ঝেড়ে ফেলে শান্ত ও স্থির হয়ে এই উপমহাদেশকে পরিচালনা করবে তারা। অনেকের মতে, সিথিয়ানরা আগে এই উপমহাদেশের পার্থিয়ান রাজার সৈন্য হিসেবে কাজ করতো এবং এক পর্যায়ে গ্রীকদের অসংগঠিত শাসনের সুযোগকে ব্যবহার করে তারা। জানা যায় যে, তাদের হাতেই ধ্বংস হয় সমৃদ্ধ গ্রীক নগরী ‘আই-খানুম’।
প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক গভর্নরকে ক্ষত্রপ বলা হতো। উত্তর ও পশ্চিম-দক্ষিণ ভারতবর্ষের সিথিয়ানরা ছিলো ক্ষত্রপ। এদের মধ্যে নহপান নামের একজন সিথিয়ান ছিলেন। তিনি সাতবাহন রাজবংশীয় রাজাদের কাছ থেকে মহারাষ্ট্রের একটি বিশাল অংশ অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ জন্য নহপানকে ‘মহাক্ষত্রপ’ উপাধি দেয়া হয়েছিলো। উত্তরে আরেকজন মহাক্ষত্রপ ছিলেন। তার নাম ছিলো রাজুবুলা। প্রায় ১০ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন।
উত্তর ভারতবর্ষে সিথিয়ানরা ছিলো সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। তাই সেখানে সিথিয়ানদের একটি রাজ্য গড়ে ওঠে। এই রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী রাজা ছিলেন ময়েস, যিনি মোগ নামেও পরিচিত ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৮৫-৬০ অব্দে ময়েস একটি বিশাল রাজ্য গড়ে তোলেন। তক্ষশীলার অনুশাসন ও তাম্র মুদ্রা থেকে জানা গিয়েছে যে, ময়েস ছিলেন গান্ধারের রাজা। কাবুল উপত্যকা থেকে পূর্ব পাঞ্জাবের মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তার রাজ্য। ময়েস মারা যাওয়ার পর গ্রীকরা পূর্ব পাঞ্জাব পুনরুদ্ধার করেন এবং খ্রিস্টপুর্ব ৫৮ অব্দে রাজা প্রথম অ্যাজেস আবারও পূর্ব পাঞ্জাব দখল করেন। ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে অ্যাজেসের অবদান উল্লেখযোগ্য। তার তৈরী ক্যালেন্ডার আজও নেপালে ব্যবহার করা হয়। তিনিই তৈরী করেছিলেন ‘বিমারান ক্যাসকেট’ নামের বৌদ্ধচিত্রখচিত একটি স্বর্ণের পাত্র। জালালাবাদে পাওয়া এই বিমারান ক্যাসকেট অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে, কারণ এতেই সর্বপ্রথম শাক্যমুনি বা গৌতম বুদ্ধকে মানবরূপে উপস্থাপন করা হয়। এর আগে বুদ্ধকে ধর্মচক্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো। তাহলে অধিকাংশের মতে যে প্রথমবার শাক্যমুনির মানবরূপী অবয়ব প্রদানে কুষাণদের অবদানের কথা বলা হয়, সেটা কতোটা যুক্তিযুক্ত, সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়। অ্যাজেসের মুদ্রায় বৌদ্ধ ত্রিরত্ন প্রতীক দেখতে পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫ অব্দে প্রথম অ্যাজেসের মৃত্যুর পর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১২ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন দ্বিতীয় অ্যাজেস। অন্য দিকে পশ্চিম-দক্ষিণের শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রপ নহপান ১১৯ থেকে ১২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা ছিলেন। তবে পরবর্তীতে সাতবাহন রাজবংশের রাজা গৌতমী সাতকর্ণী নহপানকে পরাজিত করেছিলেন। সিথিয়ানদের আরেকটি রাজবংশ ‘কর্দমক’ এর প্রতিষ্ঠাতা চষ্টন সাতবাহনদের কাছ থেকে কিছু অঞ্চল উদ্ধার করেছিলেন এবং ১৩০ খ্রিস্টাব্দে এই রাজবংশেরই রাজা রুদ্রদমন আবারও গৌতমী সাতকর্ণীকে পরাজিত করেন। রুদ্রদমন ছিলেন শ্রেষ্ঠ শক রাজা এবং বীরযোদ্ধা। একই সাথে তিনি ছিলেন একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব। তিনি সাতবাহনদের পরাজিত করে মালব পুনরধিকার করেছিলেন। গৌতমী সাতকর্ণী ও তার ছেলে ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ। তবুও কোনো উপায় না দেখে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্য গৌতমী সাতকর্ণীর ছেলে নিজের ছেলের সাথে রুদ্রদমনের মেয়ের বিয়ে দেন। তবে এই বিয়ে যতোই বিরূপ পরিস্থিতিতে হোক না কেনো, ভারতীয় সংস্কৃতি ও রীতি-নীতির সাথে সিথিয়ানদের মেলবন্ধন তৈরীতে এই সম্পর্ক ছিলো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সিথিয়ানদের ভারতীয়করণ ভারতবর্ষের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিলো। বহু সিথিয়ান বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলো। যতো বেশি বৌদ্ধস্তূপ থাকবে ততো বেশি উপাসনাস্থল বাড়বে ও পরকালের পথ ততো বেশি প্রশস্ত হবে -এমন ধারণা থেকে তারা প্রচুর বৌদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেছিলো। তবে বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি সিথিয়ানরা জৈন ধর্মেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলো।
রুদ্রদমন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার পর সিথিয়ানদের মধ্যে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য বাড়ে। রুদ্রদমন সংস্কৃত ভাষাকে গ্রহণ করেন। তখন সংস্কৃত ছিলো কেবল পুরোহিত ও উচ্চবর্গের মানুষের ভাষা। সাধারণ মানুষের এই ভাষা ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিলো না। এই প্রথাকে ভেঙে ফেলার জন্যই মূলত রুদ্রদমন সংস্কৃত ভাষার প্রচলন করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
ভারতীয় সাহিত্যের বেশ কিছু জায়গায় সিথিয়ানদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত, মহাভাষ্য, মনুস্মৃতি প্রভৃতিতে সিথিয়ানদেরকে ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়াও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন পাটালিপুত্র দখল করেন তখন তার সাথে সেই যুদ্ধে যবন বা ইন্দো-গ্রীক এবং পার্থিয়ানদের পাশাপাশি ইন্দো-সিথিয়ান বা শকদের সহায়তার কথাও জানা গিয়েছে।
লায়ন ক্যাপিটাল মথুরাতে ইন্দো-সিথিয়ান শাসকদের অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। চীন এবং দক্ষিণ এশিয়াকে উপস্থাপনকারী ব্রিটিশ জাদুঘর স্যার জোসেফ হতুং গ্যালারীতে রাজুবুলার লাল বেলে পাথরের তৈরী খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। এটি মথুরাতে আবিষ্কৃত হয়েছিলো এবং বিশিষ্ট রাজা মুকি ও তার ঘোড়ার শেষকৃত্য উপলক্ষে তৈরী করা হয়েছিলো। এতেও বৌদ্ধ প্রতীক ত্রিরত্ন দেখা যায়, যা বৌদ্ধ ধর্মের সাথে তাদের একাত্মতারই বহিঃপ্রকাশ।
ইন্দো-সিথিয়ানদের সাথে রোমান সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। রোমান সম্রাট অগাস্টাসের কাছে তারা পার্সিয়ানদের পরাজিত করার উদ্দেশ্যে জোটবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানাতে দূতও পাঠিয়েছিলো। কিন্তু চীনের সাথে রোমানদের একটি সম্পর্ক আগেই তৈরী হয়ে যাওয়ায় এই চুক্তিটি করতে রোমানরা সম্মত হয় নি। ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’-তে এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। রোমানদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে সিথিয়ানরা সিল্ক রুটকে বিকশিত হতে সহায়তা করে। ঘোড়া বাণিজ্য, সিল্ক বিনিময় প্রভৃতির মাধ্যমে সিথিয়ানরা ভারতবর্ষে বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলো। তাদের এই ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে কুষাণরা যখন একই পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের স্থান দখল করে নেয়, তখন সব দিক থেকে ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীই লাভবান হয়েছিলো।
বুদ্ধিদীপ্ত বর্বর এই সিথিয়ান বা শক জনগোষ্ঠীর কথা ইতিহাসে তেমন গুরুত্ব দিয়ে কখনোই বলা হয় নি। এর কারণও আছে। সিথিয়ানরা লিখে রাখতো না। তাই তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জেনেছি তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণকারী ঐতিহাসিকদের লেখনী থেকে। তবে বিভিন্ন গবেষণা হয়তো আমাদেরকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার কিছুটা সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। তাই আজ আমরা জানতে ও জানাতে সক্ষম হয়েছি যে, ইতিহাসে অবহেলিত বর্বর এই জাতিও কতো গুরুত্বপূর্ণ অবদানে এই উপমহাদেশকে নিয়ে গিয়েছিলো সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে এবং কতোটা অবলীলায় গ্রহণ করেছিলো ভিনদেশী সভ্যতার স্বাদ।