খান জাহান আলী সম্পকে ত্র কথা বলা হয় য়ে তিনি ছিলেন ইয়েমেন অথবা পারস্য দেশীয় সওদাগর । দিল্লীতে এসে তিনি সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রধানমন্ত্রী হন জাহান আলীর সমাধি লিপি হতে জানা যায় যে, তাঁর উপাধী ছিল উলুখ খান ও খান –আল আজম-খান –জাহান। বিদ্রোহ দমনে জৈনপুর এসে তিনি আধ্যাতিক জ্ঞানলাভ করেন । এ সময় তিনি মানব-সেবাও ধর্ম প্রচারের জন্য রাজা দরবার হতে দূরে অবস্থানের জন্য জৈনপুর ত্যাগ করে ৩৬০ জন আউলিয়াসহ দক্ষিণ বঙ্গে আসেন । ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ লাখনৌতির সিংহাসনে বসেন। পরে তিনি সোনারগাঁও অধিকার করেন এবং সারা বাংলাকে একত্রিত করে ইলিয়াস শাহী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতিহাস পাঠে এ কথা জানা যায় যে, ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দর শাহ ১৩৫৮ খ্রি. সিংহাসনে বসেন। সিকান্দর শাহ আবার তাঁর প্রথমা স্ত্রীর একমাত্র পুত্র গিয়াস উদ্দিনকে রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের শাসন ভার দেন। সোনারগাঁয়ে রাজধানী করে তিনি সাফল্যের সাথে পূর্বাঞ্চল শাসন করতে থাকেন। কিন্তু রাজধানী পান্ডুয়ায় বিমাতার প্ররোচণায় পিতা সুলতান সিকান্দর শাহ তাঁর অনুগত্যের প্রতি সন্দেহ পোষণ করায় পিতা-পুত্রের মধ্যে বিবাদ উপস্থি হয়। বিবাদ এক সময় যুদ্ধে রূপ নেয়। যুদ্ধে সিকান্দর শাহ পরাজিত ও নিহত হলে গিয়াস উদ্দিন পান্ডুয়ায় গিয়ে সিংহাসন দখল করেন। সোনারগাঁয়ে সুলতান গিয়াস উদ্দিনের সহপাঠী এবং সেনাদক্ষ আজম খান সুলতানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই আজম খান-ই আমাদের খান জাহান।

হযরত খানজাহান আলি এর মাজার ভবন, বাগেরহাট

পরবর্তীতে রাজা গণেশ নামক এক উচ্চ পদস্থ হিন্দু শাসক সুলতানকে হত্যা করে সৈফুদ্দিন হামজা শাহ নামে গিয়াসউদ্দিনের এক পুত্রকে সিংহাসনে বসান। ষড়যন্ত্রে টিকতে না পেরে নিহত সুলতানের প্রধান উজির খান জাহান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের অপর পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ ও তাঁর পরিবারের লোকজন নিয়ে রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল সুন্দরবন এলাকায় আশ্রয় নেন।

মহারাজ গণেশনারায়ণ রায়ভাদুড়ি

খান জাহান প্রথমে যশোরের বারোবাজার এলাকায় আস্তানা গাড়েন। পরে আরো দক্ষিণে বাগেরহাট গিয়ে তার স্থায়ী আশ্রয়স্থল গড়ে তোলেন। তবে খান জাহান কোন স্বাধীন সুলতান হিসেবে তাঁর অঞ্চল শাসন করেননি। তিনি নিজের নামে কোন মুদ্রা বা খুতবাও চালু করেননি।

খান জাহান তার শাসন কেন্দ্রের নাম দিয়েছিলেন খলিফাতাবাদ বা প্রতিনিধির আবাসস্থল। প্রচলিত লোককাহিনী অনুসারে তিনি ৩৬০ টি দীঘি এবং ৩৬০ টি মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন। এসব নিদর্শণ যশোরের বারো বাজার হতে শুরু করে গোটা ভাটি অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। খান জাহানের অধিকাংশ স্থাপত্য কীর্তি উনিশ শতকে ধ্বংসস্ত’পের আকার ধারণ করে। ফলে সকল স্থাপত্য কীর্তি আজ আর অবশিষ্ট নেই। দৃশ্যমান আকারে যেগুলো আছে সেগুলোর সংখ্যা একেবারেই কম। ১৪৫৯ খ্রি. মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মানুষকে সন্ধান দিয়েছিলেন উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির। তবে এ পর্যায়ে এসে একটি কথা স্বীকার করে নেয়া ভাল যে, খান জাহানের পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধাকার ঐতিহাসিক এবং অন্যান্য লেখক বিভিন্ন কথা লিখলেও তাঁর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন প্রামাণ্য তথ্য লেখা হয়েছে বলে জানা যায়নি।

এই সরল স্বীকারোক্তি মেনে নিয়েই আমরা খান জাহানের বিভিন্ন কীর্তির প্রসঙ্গে আলোচনা করবো।

ষাট গম্বুজ মসজিদ: খান জাহান আলীর এক অর কীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ। এটি অবিভক্ত বাংলার তৃতীয় বৃহত্তম এবং বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাচীন মসজিদ। বিশে^র একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় মসদিটির ইউনেস্কো প্রত্নতাত্ত্ব সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ

ষাট গম্বুজ মসজিদ ছাড়াও রয়েছে আরও কতিপয় মসজিদ- যেগুলোতে পরিচিতিমূলক কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে এদের স্থাপত্য রীতিতে খান জাহান নমুনারীতির প্রভাব দেখা যায়। যেমন, বিবি বেগনী মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ, হোসেন শাহী মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, এবং আরো কতিপয় মসজিদ।

খান জাহান আলী আরো যে সব অবদান রেখে গেছেন তার মধ্যে ফকির বাড়ির পুকুর, বাগমারা দীঘি, আফরা, খলসী উৎফুল, বাদোখালী প্রভৃতি গামের দিঘী, রামপাল থানার হুড়মো গ্রামের ঝলমলে দিঘী, বাগের হাটের পচা দিঘী, সোনাতলার শাহবাদ খাঁর দীঘি। এছাড়া বাগেরহাটের গলিতে গলিতে ছোট-বড় মসজিদ, দীঘি, পুকুর, সরাইখানা, মাজার, বিরাটাকার প্রস্তরখন্ড আজও সেই প্রভাবশালী শাসকের বিজয় গৌরব ঘোষণা করছে।

খাঞ্জেলী দীঘি: খান জাহান আলী’র আর এক অমর কীর্তি খাঞ্জেলী দীঘি। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রি. দিকে খান জাহান আলীর উদ্যোগে খননকৃত বিশাল দীঘিটির আয়তন ২০০০ ফুট ১৮০০ ফুট। এর বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শত শব বৎসর ঘরে এখানে বিরাজ করছে অনেকগুলো কুমির। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এই যে খান জাহান আলীর ছেড়ে দেয়া কালা পাহাড় ও ধলা পাহাড় নামের কুমির দুটের বংশধর এই কুমিরগুলো।

মাজার সংলগ্ন দিঘীর কুমীর;

কালের নীরব সাক্ষী হয়ে এরা ভ্রমণকারীদের মানত ভক্ষণ করে থাকে। এদের ডাকলেই এরা কাছে আসে এবং এদের শরীরে হাত দিলেও বিরূপ আচরণ করে না। খান জাহান আলী (রহঃ) এর মাজার বাগেরহাট শহর হতে ৫ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে। রণবিজয়পুর গ্রামে খান জাহান আলীর মাজার অবস্থিত। এই সমাধি সৌধটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। এটি বর্গাকার মধ্যভাগে তিন ধাপ বিশিষ্ট কালো পাথর দ্বারা নির্মিত। এই সমাধিতে খান জাহান আলি (রহঃ) এর মৃত্যুর তারিখ ২৬ মে ডিলহজ্ব ৮৬৩ হিজরী, ২৫ মে আক্টবার ১৪৫৯ সাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

খান জাহানের স্মৃতিসৌধ।