‘ ধর্মকে বাঁধতে হবে কর্মের বন্ধনে ‘ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে উপরোক্ত নীতিকথা_ইতিকথা বা রুপকথা বা উপকথায় পরিণত হয়নি অন্তত তার জীবনের আয়ুষ্কালের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাই। সামাজিক, পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক আর সর্বপরি উঁচু তলার ট্যাগকে পায়ে মাড়িয়ে ব্রাত্যদের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বা নিজ রুপকে ব্রাত্যদের স্বরুপে রুপায়িত করে তাদেরই একজন হয়ে যাওয়া চাট্টেখানি কথা নয়, অন্তত তৎকালিন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে! যাইহোক, যা হওয়ার নয় তা-ই হয়ে আর যাদেরকে নিয়ে লেখার নয় বা লেখার প্রশ্নই আসে না তাদেরকে নিয়েই লিখে বা তাদেরই একজন হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। পারিবারিক পদবীর মর্যাদা রক্ষা না করে, ম্লেছদের আশ্রয় দিয়ে, অস্পৃশ্যদের অশন-বসন-ভূষণ দিয়ে তাদের সাথে নিজেকে একাঙ্গিভূত করে নিরবে নিভৃতে সাহিত্য রচনা করতে লাগলেন। খ্যাতির চেয়ে অখ্যাতি বা সুখ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতির রাশ টানাটানি চলতে থাকলেও নিজ সাধনা থেকে পিছপা হননি বরং বাঁধা-বিপত্তিকে একপাশে রেখে দিয়ে যাহা কিছু সজ্জন, সেখানে অর্জনের নিমিত্তে কোথাও কোথাও বর্জনের মাত্রা টেনে অকল্যাণের মুখে ঝামা ঘসে কল্যাণের পথের নিজে যেমন দিশারী হয়েছেন আবার কখনো কখনো সাহিত্য রচনার মাধ্যমে পরবর্তী আলোকবর্তিকা হিসেবে আমাদেরকে এগিয়ে আসার পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছেন। যাতে করে সমাজকে সবার জন্য সমান্তরাল স্রোতে বহাইতে পারি।

প্রথম জীবনে কখনো কলকাতামুখো হননি। সবার তীর্থস্থান যেখানে কলকাতা, সেখানে তিনি অনেকটাই লুক্কায়িত অবস্থায় থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন। যামিনী রায় একবার সহাস্য বলে উঠলেন_কি হে ভায়া, বীরভূমে কেন? কলকাতায় চলুন। জানেন তো? শশ্মান না হলে শব সাধনা হয় না। প্রত্যেক সাধনায় সাধনাপীঠের প্রয়োজন হয় আর সেই সাধনার পীঠস্থান হল কলকাতা! স্বভাবতই তারাশঙ্কর বাবুর এই কথায় মনঃপুত হয়নি। যাইহোক, পরবর্তীতে কিছুকাল কলকাতায় নিবাস করলেও সাহিত্যের উপজীব্য সেই নির্যাতিত, নিপীড়িত আর জোরজবরদস্তিতে নিজ অধিকার থেকে বিতাড়িত মানুষদের নিয়ে আসলেন নায়ক-খলনায়ক হিসেবে। সেই নদীরবাঁক, বকেরঝাক আর বাঁশেরঝাড়ের কাহিনিকেই করে তুললেন মূল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। মহান এই লেখকের আজ ২৩ শে আগস্ট, ১২৩ তম জন্মবার্ষিক’তে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। চিরকাল বাঙালি পাঠকের পঠন-পাঠনের চর্চায় স্মরিত-বরিত হয়ে চিরভাস্বর থাকবেন।

‘গণদেবতা’ নামের যথার্থতা বিচার করার আগে উপন্যাসের সময়ের সাথে বিভিন্ন চরিত্রের চরিত্রায়ন বা চিত্রায়ন কতটুকু সার্থকতা বা সফলতা বা বিফলতার সংমিশ্রণের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক ফুটিয়ে তুলেছেন সেটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ যদি আমার মতো স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠকের মাথায় নাও ঢুকতে পারে তাতে হতাশ বা নিরাশ হওয়ার কোনো চান্স নেই। কারণ তারাশঙ্কর বাবু’র উপন্যাসে অতটা জটিল চরিত্রের সাক্ষাৎ আমরা পাই না, সচরাচর যেখানে অন্যসব বাঙালি ঔপন্যাসিকের বেলায় হরহামেশাই গদবাঁধা চরিত্রের দেখা মেলে। বীরভূমের আশেপাশের সাঁওতাল তথা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নানান কাহিনি, ঘটনার আলোকে দুর্ঘটনার আবির্ভাব, তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক অনগ্রসরতা আর নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্নতা ইত্যাদী তার উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। তাই আধুনিক/সবেমাত্র আধুনিকতায় পা দিয়ে অত্যাধুনিকতায় গা ভাসিয়ে দিলে যে ধরণের জটিলতা-কুটিলতা-কঠিনতায় ভরপুর সে সব দোষে দুষ্টতার চেয়ে নির্মলতার প্রতিনিধিত্ব করে তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে ‘দেবতা’ আসলে কে বা কারা? ‘দেবতা’ কি তথাকথিত বাঁশ মাটি দিয়ে নির্মিত কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব? না ‘দেবতা’ তৎকালিন সমাজব্যবস্থার হর্তা-কর্তা-বিধাতারা বা তাদের পোষ্য চেলা-চামুণ্ডারা? ‘দেবতা’ আসলে কে বা কারা তার সঠিক নির্দেশ ঔপন্যাসিক দিয়ে যাননি তবে আমার কাছে মনে হয়েছে প্রদত্ত উপন্যাসে ‘দেবতা’ বলতে তৎকালিন ‘ সময়’ কেই বুঝানো হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের সমাজের রীতিনীতি, আচার-বিচারের দোদুল্যমানতা আর ভবিষ্যৎ জীবনের নানান সুযোগ-সুবিধার দেদীপ্যমানতা’র হাতছানি এক ভাঙ্গা-গড়ার ইঙ্গিত দেয়। আর তাতে সমাজের অধস্তনদের উপর যে তার ঢেউ লাগবে তা তো স্পষ্ট সত্য! হোক সে উপজাতীয় কিন্তু তবুও তো সে ভারতীয়। তাই ভিনদেশীদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরবর্তীতে সোসাইটি কোন দিকে মুভ করবে তার নানান ঘাত-প্রতিঘাতের দিকে নির্দেশ দেয় এই উপন্যাস।

উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেবু, অনিরুদ্ধ, শ্রীহরি, পদ্ম, দুর্গা, যতিন আর গিরিশ। প্রত্যেকটির চরিত্রের স্বাতন্ত্র্যতা আছে সন্দেহ নেই তবে নায়ক আর খলনায়ক খুঁজতে গেলেই সমস্যা বাঁধে! এখানে নায়েক আর কে তার বিপরীত এই প্রশ্নের উত্তর হবে ব্যক্তি নয় বরং ‘সময় ‘ ই হল প্রকৃত নায়ক তদ্রুপ খলনায়কও! পারিবারিক পেশাদারিত্ব ছেড়ে নতুন পেশার দিকে ধাবিত হওয়ার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা তাতেই সবার নজর কারে। আবার আর্থিক স্বচ্ছলতার দরুণ পারিবারিক নাম-ধাম-পদবী পরিবর্তন করে নতুন নামে প্রভাব খাটানো সেই নতুন সমাজ বাস্তবতার চিত্র আর চরিত্র ধারণ করে। আর তাছাড়া যতিনকে দিয়ে স্বদেশী আন্দলনের ক্ষাণিক ঝংকার একটু হলেও পাঠকের মনে অনুরণন দিয়ে যায়। দুর্গার সতিত্বের কাছে সমাজের গতিত্বের সম্পর্ক কেমন ছিল তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। সন্তানবাৎসল্য পদ্মার জীবন নানা বাঁক না নিলেও উপন্যাসে শেষাবধি অন্যকোনো ঘাত তৈরি করে তাকে নির্বাক করেনি। তাই বলা যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসের উপজীব্য একটি বিশেষ গোষ্ঠিকেন্দ্রিক হলেও আসলে তা তৎকালিন বৃহত্তর সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে।।।