প্রাচীন ইরানের বিখ্যাত নগরী আকেমেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানী পার্সেপোলিসের একমাত্র অক্ষত নিদর্শন হিসেবে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘নাকশে রুস্তম’ অর্থাৎ ‘রুস্তমের চিত্র’। নাকশে রুস্তম একটি রাজকীয় সমাধিস্থল। ধারণা করা হয়, এখানে সম্রাট ডেরিয়াস দ্য গ্রেটসহ তার আরো তিনজন উত্তরসূরির সমাধি আছে। ‘নাকশে রুস্তম’ নামের পেছনেও রয়েছে কাহিনী। ইরানের বিখ্যাত কবি ফেরদৌসির রচিত মহাকাব্য ‘শাহনামা’ -তে বর্ণিত রুস্তম ও তার যুদ্ধের কাহিনীর সাথে এই সমাধিস্থলের দেয়ালচিত্রগুলোর কাহিনী মিলে যায় বলেই এই জায়গার নাম রাখা হয়েছিলো ‘নাকশে রুস্তম’।

নাকশে রুস্তম পার্সেপোলিসের শেষ চিহ্নতে শাহনামার যুদ্ধে

শাহনামার যুদ্ধের দৃশ্যের সাথে মিলে যায় নাকশে রুস্তমের খাদাইচিত্রগুলো; Source: ancient-origins.net

ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের ইচ্ছাতেই পাহাড় কেটে এতো উঁচুতে সুবিশাল এই সমাধিস্থল তৈরী করা হয়েছিলো। তিনি ছিলেন তখন বিশ্ব কাঁপানো শাসক। তার সমাধি তো আর যেনো-তেনো হতে পারে না। নাকশে রুস্তম তৈরীর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৮ সালের মাঝামাঝিতে, অর্থাৎ সম্রাট হিসেবে ডেরিয়াসের অভিষেকের পর। পার্সেপোলিস থেকে বারো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গড়ে তোলা এই সমাধিস্থলের প্রতিটি সমাধির প্রবেশপথই ক্রুশ আকৃতির। তাই ‘পারস্যের ক্রুশ’ বলেই অনেকে সম্বোধন করেন নাকশে রুস্তমকে। ক্রুশ আকৃতির ঠিক মাঝামাঝিতেই রয়েছে সমাধিতে ঢোকার দরজা। দরজাগুলোতে ভীষণ সুন্দর কারুকাজ করা।

নাকশে রুস্তমঃ পার্সেপোলিসের শেষ চিহ্নতে দারিয়ুস দি গ্রেটের সমাধি

দারিয়ুস দি গ্রেটের সমাধি; Source: jontynz.com

মোট চারটি বিশাল সমাধি রয়েছে নাকশে রুস্তমে। এর মধ্যে শুধু একটি সমাধিতেই শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। শিলালিপির কথাগুলো উত্তম পুরুষে লেখা হয়েছে, যেনো স্বয়ং সম্রাট জনগণের উদ্দেশ্যে কোনো বাণী খোদাই করেছেন। ধারণা করা হয়, শিলালিপিযুক্ত এই সমাধিটিই ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের সমাধি এবং বাকি তিনটি সমাধি তার মৃত্যুর পরে তৈরী করা হয়েছিলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেকজান্ডার অভূতপূর্ব পার্সেপোলিস নগরীকে একদম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সামান্য দূরে অবস্থিত হওয়ায় নাকশে রুস্তমে সেই ধ্বংসলীলা চালাতে পারেন নি তিনি। যদিও আলেকজান্ডারের পারস্য আক্রমণের সময় তার সৈন্যরা নাকশে রুস্তমের সমাধিগুলো থেকে মূল্যবান সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। রাজাদেরকে সমাধিস্থ করার পর দরজা তালা মেরে বন্ধ করে দেয়ার নিয়ম ছিলো পারস্যে। আলেকজান্ডারের সৈন্যরাই প্রথমবার নাকশে রুস্তমের সমাধির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো।

নাকশে রুস্তমের দেয়ালে আগে কোনো দেয়ালচিত্র ছিলো না। সাসানীয় রাজারা পরবর্তীতে নিজেদেরকে আকেমেনিড সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করার ইচ্ছা থেকে এসব দেয়ালচিত্র খোদাই করেছিলেন।

নাকশে রুস্তমের চতুর্থ সমাধির সামনে পবিত্র কাবা শরীফের আদলে তৈরী একটি ঘনকাকৃতির পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। কিন্তু এটি কি কাজে ব্যবহৃত হতো, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় নি। দেখতে কাবা ঘরের মতো বলে একে ‘কাবা-ই-জারথষ্ট’ অর্থাৎ ‘জরাথ্রুস্টের কাবা’ নাম দেয়া হয়েছিলো।

আরেকটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ মিলেছে নাকশে রুস্তম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। অনেকের ধারণা, এখানে কোনো পূজা হতো, আবার অনেকে মনে করেন, এটিও কারো সমাধিস্থল ছিলো। সেই জায়গায় এখন শুধু কিছু পাথরখন্ডের অস্তিত্ব রয়েছে। জায়গাটির নাম দেয়া হয়েছে ‘তখত-ই-রুস্তম’।

নাকশে রুস্তমঃ পার্সেপোলিসের শেষ চিহ্নতে তখতে রুস্তম

তখত-ই-রুস্তম

এক সময়ের শ্রেষ্ঠ আকেমেনিড সাম্রাজ্যের অভূতপূর্ব এক নিদর্শন নাকশে রুস্তম। এই সমাধিস্থলটিই আমাদের জানান দেয় পার্সেপোলিস নগরী কতোটা চমকপ্রদ ছিলো। নাকশে রুস্তমের অস্তিত্ব আমাদের মধ্যে এক অদ্ভূত বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সেই সাথে জন্ম নেয় অসংখ্য প্রশ্ন ও সম্ভাবনা। কে জানে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো এক দিন সব প্রশ্নেরই উত্তর মিলে যাবে, মিলে যাবে সমস্ত সূত্রের সমাধান।