মুর্শিদকুলী খান যখন সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন তখন থেকেই কার্যত ঢাকার জৌলুস হারাতে থাকে। রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে ঢাকা তখন উপ-প্রদেশের তকমা গায়ে লাগায়। পূর্ববঙ্গকে শাসনের স্বার্থে মুর্শিদকুলি খান ঢাকাকে একজন সহকারী সুবাদারের আওতায় সেখানে নিয়াবত স্থাপন করেন। ফলে ঢাকার শাসনকর্তার পদটির নাম দাঁড়ায় নায়েবে নাজিম। এই নায়েবে নাজিমরা তাঁদের সরকারি বাসভবন হিসেবে ঢাকা দুর্গকে (ধারণা করা হয় নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের কোন একটি স্থানে এই ঢাকা দুর্গ ছিল) ব্যবহার করতেন। ১৭৬৬ সালে ইংরেজ জেনারেল সুইনটন পুরান ঢাকার নিমতলীতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলে সেটি পরিণত হয় নায়েবে নাজিমদের প্রশাসনিক দফতর হিসেবে। আর এরই সাথে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত নিমতলী প্রাসাদ ঢাকার নবাব এবং নায়েবে নাজিমদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বর্তমানে প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া প্রাসাদটিকে সংস্কার করে পুরনো ছাপ আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার অনুগতদের সমুচিত শিক্ষা দিতে জায়গায় জায়গায় ধরপাকড় পরিচালনা করে। তারই অংশ হিসেবে ইংরেজ জেনারেল সুইনটন ঢাকায় তার বাহিনী নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুইনটন এসেছিলেন ঢাকার ইংরেজ অনুগত নায়েবে নাজিম জসরত খানকে রক্ষা করতে৷ এ সময় জসরত খানের ইংরেজ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে নবাব মীর কাসিম তাকে বিহারে বন্দি করে রাখেন। ওদিকে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয়ের ফলে জসরত খানের মুক্ত হওয়ার দ্বার খুলে যায়। অতীতের সাহায্যের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ লর্ড ক্লাইভ কলকাতা পরিষদের কাছে জসরত খানকে পুনরায় নায়েবে নাজিম হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেন। এরই সাথে জসরত খান আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি এখানে এসে দেখেন তার পূর্বের বাসভবন ইংরেজরা দখল করে বসে আছে। ফলে নিরুপায় হয়ে জসরত খান বড় কাটরায় বাস করতে থাকেন। ফলে কলকাতা থেকে খুব দ্রুত নায়েবে নাজিমদের জন্য একটি বাসভবন নির্মাণের আদেশ দেয়া হয় জেনারেল সুইনটনকে। ১৭৬৬ সালে সুইনটনের হাত ধরে ইংরেজ কর্তৃক ঢাকার প্রথম দালান হিসেবে নিমতলী প্রাসাদ আত্মপ্রকাশ করে।
কেমন ছিল নিমতলী প্রাসাদ?
ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, নিমতলী প্রাসাদ ছিল বিশাল এক বর্গাকার চত্বরে ভিন্ন ভিন্ন অট্টালিকা সংবলিত। দুইতালা বিশিষ্ট এসব অট্টালিকার চারদিক প্রাচীরঘেষ্টিত আবরণের ভেতরে ছিল একটি সুদৃশ্য বাগান এবং একটি বিশাল দীঘি যার কিছু অংশ এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের দেয়াল বরাবর বিদ্যমান। এছাড়াও ছিল অভ্যন্তরীণ অঙ্গন, নিভৃতে থাকার জায়গা, প্রার্থনার জন্য নির্দিষ্ট স্থান, সৈন্যদের ব্যারাক এবং কর্মচারীদের থাকার জায়গা। কুঠির দক্ষিণে নবাবী মসজিদ নামের এক ছোট গম্বুজঅলা মসজিদও ছিল। উত্তর দিকে ছিল একটি সরু খাল যা শহরের পূর্বদিক হতে কুঠিতে পানি সরবরাহের কাজ করত। নিমতলী প্রাসাদে বারোদুয়ারী নামে একটি বিশেষ কক্ষ ছিল। কথিত আছে, এই বারোদুয়ারীতে বারোজন সর্দার রোজ বিভিন্ন আবেদন শুনার জন্য এখানে এসে দেখা দিতেন। ১৯১৪ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত বারোদুয়ার কক্ষটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ বর্তমানে এ অংশটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোয়ার্টারের ভেতর পড়েছে।
১৮২৪ সালে কলকাতার বিশপ রেজিল্যান্ড হেবার ঢাকায় ভ্রমণ করে তৎকালীন নায়েবে নাজিম শামসউদ্দৌলার সঙ্গে দেখা করতে নিমতলী প্রাসাদে যান। তার বর্ণনায় জানা যায়,
“ঢাকার নবাবকে সম্মান দেখানোর জন্য তখন এক কোম্পানি সৈন্য রাখা হত নিমতলী প্রাসাদে। দুপাশ বৃক্ষ আচ্ছাদিত একটি রাস্তা চলে গিয়েছিল পুরান ইটের প্রাচীর ঘেরা নিমতলী কুঠির দিকে। সেখানে একটি সুন্দর ফটক, খোলা গ্যালারিসহ নহবতখানা ছিল। প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় ছিল গথিক রীতিতে নির্মিত একটি সুদৃশ্য হলঘর। হলঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল রাজা, সম্রাট আলেকজান্ডার, লর্ড ওয়েলেসলী এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের বিভিন্ন ছবির প্রিন্ট”।
ঢাকার কালেক্টরেট চার্লস ডয়লী নায়েবে নাজিম নুসরাত জং এর আমলের নিমতলী প্রাসাদের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,
“প্রাসাদটি প্রাচ্য রীতিতে সাজানো। দরবার হলের দেয়ালে ১ ইঞ্চিও ফাঁকা ছিল না। পুরো দেয়াল ভর্তি ছিল ইংলিশ চিত্রকর্মের প্রিন্ট”।
নায়েবে নাজিমদের ক্ষমতালোপ ও নিমতলী প্রাসাদের ভাগ্য
১৭৭২ সালে হেস্টিংস দ্বৈত শাসন প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৮৭ সালের প্রণীত আইনে কালেক্টরেটকে ম্যাজিস্ট্রেসি ও বিচারকের ক্ষমতা প্রদান করলে অল্প কিছু ক্ষমতা নায়েবে নাজিমদের হাতে অবশিষ্ট থেকে যায়। সেই ক্ষমতাও আর বেশিদিন টিকেনি৷ ১৭৯০ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস নায়েবে নাজিমদের ক্ষমতা পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দেন৷ সর্বশেষ নায়েবে নাজিম নবাব গাজীউদ্দিন ছিলেন এ অঞ্চলের সবচেয়ে কুখ্যাত নবাব।। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এবং অত্যাচারী। ঢাকার নায়েবে নাজিমরা মূলত সমাজের এক ধরণের বিশেষ ধারা মেনে চলত। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে তৎপর থাকতে দেখা যেত তাদের। কিন্তু গাজীউদ্দিনের এর কোন বালাই ছিল না। তিনি বাঈজী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। কাড়ি কাড়ি টাকা নিজের বিলাসব্যসনে নষ্ট করতেন বলে তিনি সমাজে পাগলা নবাব নামে পরিচিতি পান। অর্থের অপচয়ের দরুন শেষমেশ নাজিমউদ্দিন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি অপুত্রক হয়ে মারা গেলে ইংরেজ সরকার নিমতলী প্রাসাদের সবগুলো প্রাসাদ দখলে নিয়ে নিলামে তুলে। নিলামে প্রাসাদের ভবনগুলো চলে যায় ভিন্ন ভিন্ন লোকের হাতে৷ ঢাকার পানি ব্যবসায়ী মৌলভী মঈনুদ্দিন মৌলভী পনির প্রাসাদের বারোদুয়ারা অংশটি কিনে নেন। প্রাসাদের বাকি ক্রেতারা ভবনের বিভিন্ন অংশ গুড়িয়ে দেয়। অবশিষ্ট থাকা কুঠিতে বেশ কিছুদিন বসবাস করেন ঢাকার ধনাঢ্য জমিদার মীর আশরাফ আলীর জামাতা আলে আবু সাঈদ। মঈনুদ্দীনের পর বারোদুয়ারা একে একে হাতবদল হয় গোপীকৃষ্ণ সেন, রূপলাল দাস এর কাছে। এরপর আবার এই ভবন সরকারি খাসে পরিণত হয়৷ ঊনিশ শতকের আশিদ দশকে ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের নববিধান সম্প্রদায় নিমতলী কুঠিকে তাদের সদর দফতরে রূপান্তর করে। ব্রাহ্মণদের বসবাসের কারণে দীর্ঘদিন নিমতলী কুঠি পরিচিত ছিল বিধান পল্লী নামে। ঢাকার সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে নিমতলী প্রাসাদ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। ঢাকার নায়েবে নাজিমদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন শিয়া মুসলিম। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ অঞ্চলে মুহররমের মিছিল জনপ্রিয় হয়ে পড়ে৷ এর ধারাবাহিকতায় ইদ মিছিলেও নায়েবে নাজিমরা অর্থ যোগান ও উৎসাহ দিতে শুরু করেন৷ ঢাকার এ ঐতিহ্যবাহী দুই উৎসব নিমতলী প্রাসাদ থেকে শুরু হয়ে হোসনী দালান, বেগম বাজার, চকবাজার হয়ে আবার নিমতলী প্রাসাদে গিয়ে শেষ হত।
মূল প্রাসাদের তেমন কোন নিদর্শনই আর এখব অবশিষ্ট নেই। নিমতলী দেউড়ি, বারোদুয়ারি ভবন কোনরকমে টিকে আছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০০২ সালে এ প্রাসাদের অংশবিশেষকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তির আওতায় সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি পুরো প্রাসাদকে সংস্কার করে এখানে একটি স্থায়ী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ পাঠকরা চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন ঢাকার ঐতিহাসিক এ ভবন। এজন্য আপনাকে ঢাকার যেকোন জায়গা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলে আসতে হবে। অমর একুশে হলের ঠিক বিপরীতেই দাঁড়িয়ে আছে শত শত বছর আগের স্মৃতি ধারণ করা নিমতলী প্রাসাদ!
তথ্যসূত্র
ঢাকার খেরোখাতা ইতিহাস ও ছবিতে- মুন্সী আরমান আলী, পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৬
ঢাকাঃ স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা ১৪৭-১৪৮
শহরের নাম ঢাকা ঐতিহ্যের নাম ঢাকা-মোঃ মোশাররফ হোসেন,সুলতানা জাকিয়া বেদৌরা-পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮
বাংলাপিডিয়া