পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে দক্ষিণ হিমালয়ের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। স্থানটি বর্তমান নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। পাল বংশীয় দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল ৭৭০ সাল হতে ৮১০ সালে এই বিহার ও মন্দির নির্মাণ করেন। পাহাড়পুর ও তৎসংলগ্ন স্থানের নাম ছিল সোমপুর (চাঁদের শহর)। এ জন্য পাল আমলে বিহারটি সোমপুর মহাবিহার নামে পরিচিত ছিল। বিহারটির দাপ্তরিক নাম ছিল ধর্মপাল মহাবিহার। কারণ বিহারটির নির্মাতাই ছিলেন সম্রাট ধর্মপাল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ধ্বংসাবশেষের ওপর ধুলোবালি জমে এখানে বিশাল আকৃতির পাহাড়ের আকার ধারণ করেছে। আর এভাবেই এই স্থানের নাম হয়েছে পাহাড়পুর।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

বিহারের একাংশ

দূর হতে দেখলে মনে হয় সমতল ভূমির ওপর এই বিহার পাহাড়ের মতহ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মপাল মহাবিহারটি অষ্টম-নবম শতকে নির্মিত হয়। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের আগে এই স্থানের বটগুহালী বিহার নামে একটি জৈন ধর্মীয় বিহার ছিল। যা হোক কিভাবে বটগুহালী বিহার ধ্বংস হয়েছিল আজ তা বলা কঠিন। তবে সেই গুপ্ত আমলেই যে সোমপুর পাহাড়পুর অঞ্চল ধর্মীয় শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। পরবর্তীতে পালদের দুর্বলতা বা পতনের কারণে বিহারটির সেই রমরমা ভাব টিকে থাকেনি।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

সোমপুর মহাবিহার প্রাঙ্গণের দেয়াল

পাহাড়পুর বিহারের গৌরব অনেক কালের। হাজার বছরেরও আগে এখানকার বিহারে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জনের আশায় নানা দেশ থেকে লোকেরা ভীড় জমাতো। অতীশ দীপঙ্কর এবং পন্ডিত বোধিভদ্রের মত মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বিহারের সাথে। এখানকার ছাত্ররা ধর্মতত্ত¡, জ্যোজির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, ভাষা বিজ্ঞান প্রভৃতি নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতো। এখানে রচিত হয়ে শুরু করেছেল বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদের একটি মূল্যবান  পুঁডিথ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা আছে। পাহাড়পুর সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বুকানন হ্যামিলটন সাহেবের জার্নালে। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহোম ১৮৭৯-৮০ সালে পাহারপুর পরিদর্শন করেন। তখন পাহারপুর ছিল ঘন ঘন জঙ্গলে ঘেরা। কানিংহোম হাতির পিঠে চড়ে এখানে এসেছিলেন।তিনি মজুর দিয়ে পাহারপুর ঢিবির চারপাশ পরিস্কার করান।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম

পরবর্তিকালে দিঘাপতিয়ার রাজা শরঃকুমার রায়ের অর্থানুক’ল্যে পাহারপুরে প্রতœতাত্তি¡ক খনন কাজ শুরু হয়েছিলো ১৯২২-২৩ সালে। এই খননের যৌথ উদ্যোক্তা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়  ও বরেন্দ্র গবেষনা সমিতি।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

বিহারের ভেতরের দিক

বিশাল চারকোনা ক্ষেত্রে জুড়ে পাহারপুরের বিহারযা উত্তর দক্ষিণে ৯২২ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট বিস্তৃত। ভবনের পেছনের দেওয়াল ১৬ ফুট চওড়া।এই বিহারেরচারদিকে রয়িছে ১৭৭ টি ভিক্ষু কক্ষ। কক্ষের দৈর্ঘ্য ১৪ ফুটের বেশী নয়।প্রথমে কক্ষগুলো ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হতো। পরবর্তি সময়ে কক্ষগুলোর মধ্যে নির্মিত বেদী দেখে মনে হয় ধর্মীয় কাজই কক্ষগুলোর মূল উদ্দেশ্যে পরিণত হয়।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

বিহারের দেয়াল

বিহারের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে সুউচ্চ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ যা পাহাড়ের মতই দেখায়। উচ্চতা ৭০ ফুট। বিহারের বেতরে ছোট ছোট মন্দির, ভোজনশালা, রান্নাধর, কূপ এবং অন্যান্য অট্রালিকার সমাবেশ দেখা যায়। কেন্দ্রীয় বহুতল মন্দিরটি ক্রুশাকৃতির এবং ধাপে ধাপে উঁচু করে পোড়ামাটির ফলকটিত্র দিয়ে মন্দিরের বইরের দেওয়াল সাজিয়ে তোলা হয়েছে। ফলকগুলোতে কলসী কাঁখে রমণী, সন্তান কোলে জননী, গ্রাম্য বধু, লাঙ্গল কাঁধে কৃষক প্রভৃতি দৃশ্য চিত্রায়ন করা হয়েছে। এছাড়া প্রাণী ও উদ্ভিদের নানা ছবি যেমন, পদ্মফুল, লতাপাতা, বাঘ, সিংহ, হাতি মোষ, বানরসহ নানা দেব-দেবীর মূর্তি সম্বলিত চিত্রফলক এখানে আছে যা সত্যিই অসাধারণ।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম

বিহার পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, এখানে পানি নিষ্কাশনের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। সর্বত্র ছিল নর্দমার ব্যবস্থা। এখানে প্রধান মন্দিরের চারদিকে ৬৩ টি পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছে। খননের মাধ্যমে আরো পাওয়া গেছে অসংখ্য মুদ্রা। এদের অনেকগুলোই মুসলমান যুগের। ১৭২ হিজরীর (৭৮৮ খ্রি.) বাগদাদের খলিফা হারুন-উর-রশিদের একটি মুদ্রা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পাল রাজাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি গোলাকার তামারমুদ্রা এখানে আবিষ্কৃতি হয়েছে। অন্যান্য প্রত্নসম্পদের মধ্যে তার শাসন ও শিলালিপি প্রধান। পাহাড়পুর খননকালে ৪ টি শিলাস্তম্ভ হতে জানা যায় যে, শিলাস্তম্ভগুলো বুদ্ধ বা ত্রিরতের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। খ্রিষ্টীয় দশম হতে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে এই শিলাস্তম্ভগুলি নির্মিত।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

নাগ, প্রস্তরমূর্তি, পাহাড়পুর

এখানে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি বিশালাকার ব্রোঞ্জেরর বুদ্ধমূর্তি, অভঘমুদ্রায় দাঁড়ানো বুদ্ধ, হরগৌরী, দন্ডায়মান জৈনমূর্তি, ব্রোঞ্জের কুবের ও গণেশ মূর্তি, বুদ্ধ দেবের মস্তক উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বড় বড় মাটির সঞ্চয়পাত্র হতে শুরু করে ছোট ছোট মাট্রি প্রদীপ, বিভিন্ন জন্তুর প্রতিকৃতি, হাড়ি –পাতিল তৈরীর হাতিয়ার, চাকতি, সিলমোহর, গোলাকার গুটিকা প্রভৃতি অসংখ্য পোড়ামাটির দ্রব্যও পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত হয়েছে।

পাহাড়পুরের কথা, Stay Curioussis

তীর-ধনুক, পোড়ামাটির ফলক, পাহাড়পুর

পাহাড়পুরে রয়েছে একটি মনোরম তথ্যবহুল জাদুঘর যা সকলের দুষ্টি আকর্ষণে সক্ষম। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে পাহাড়পুরকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়।