আমাদের আজকের বাংলাদেশ, আগে ছিলো বৃহত্তর বঙ্গদেশের একটি অংশ যার নাম ছিলো পূর্ব বাংলা। আর পশ্চিম দিকের অংশের নাম পশ্চিম বাংলা, এটি ভারতের একটি রাজ্য। এই দুই বাংলায় হিন্দু আর মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো প্রায় সমান। কিন্তু ১৮৮০ সালের দিকে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের ছাড়িয়ে যায়। তখন মুসলমানরা বাস করতো পূর্ববাংলায় আর হিন্দুরা পশ্চিম বাংলায়।দু ই বাংলায় একটাই ভাষা ছিলো, বাংলা ভাষা।

আগে সমাজের উপর তলায় ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আর অল্প কিছু উর্দুভাষী মুসলমান। বাকি শতকরা ৯০ জনেরও বেশি গ্রামের মুসলমান ও নীচু জাতের হিন্দু। তারা লেখাপড়া খুব সামান্য জানতেন। এরা প্রায় সবাই ছিলেন, চাষী, জেলে, নাপিত, কামার, কুমোর, তাঁতি, ছুতোর ইত্যাদি। লেখাপড়া না শিখে তারা বংশ পরস্পরায় এই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো।

অবিভক্ত বঙ্গদেশের মানচিত্র

ইংরেজ আমলে সামাজের চেহারা পাল্টে যেতেই রাজধানী কলকাতায় ব্যবসা- বানিজ্য এবং শিক্ষার নতুন পথ খুলে গেলো। এর সুযোগ নিলেন কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। তারা ছিলেন ব্রাহ্মণ, বৈদ্য আর কায়স্থ। লেখাপড়া শিখে শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়েছেন। তারা ছিলেন মোট হিন্দুর পাঁচভাগের একভাগ, সংখ্যার দিক দিয়ে তারা কম ছিলেন কিন্তু তারা ছিলেন ধনী এবং প্রভাবশালী।

উঁচু শ্রেণীর মুসলমানেদের সংখ্যা ছিলো আরো কম, মোট মুসলমানদের শতকরা দুভাগের চেয়েও কম। তারা শহরে বাস করতেন, অনেকেই ছিলেন জমিদার বা শিক্ষার সাথে জড়িত কোন পেশায়। তারা উর্দু ভাষায় কথা বলতেন, এবং তাদের অনেকেই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করতেন না। তখন সরকারী ভাষা ছিলো ফার্সি। তারা যথাক্রমে ফার্সি ভাষায় শিক্ষিত ছিলেন এবং আর্থিক দিক দিয়ে ছিলেন ধনী অথবা মধ্যবিত্ত।  অন্যদিকে সাধারণ মুসলমানরা বাস করতেন গ্রামে এবং বাংলায় কথা বলতেন। তাদের পেশা থেকে যা রোজগার করতেন তাতেই কোনরকমে দিন চালাতেন কিন্তু পেশা বদল করা বা লেখাপড়া করার কথা চিন্তা করতেন না।

প্রথম শহীদ মিনার, তৈরি করার তিনদিন পর যা ভেঙ্গে ফেলেছিলো পুলিশ।

ইংরেজরা এদেশে এসেছিলেন ব্যাবসা করতে, এদেশ শাষণ করতে নয়। ১৬৯০ সালে গঙ্গার ধারে দক্ষিন বাংলার তিনটি গ্রাম — কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি কিনে নিয়ে সেখানে তারা ব্যবসার কেন্দ্র খুলে বসেন। কিন্তু স্বার্থে লাগে তখন, যখন ১৭৫৬ সালে বঙ্গদেশের নবাব সিরাজদৌল্লার সাথে গোল বাধে। সে বছর নবার কলকাতা আক্রমণ করে বহু ইংরেজকে হত্যা করেন। পরের বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে নবাবের যুদ্ধ হয় এবং নবাব হেরে যান, এবার ব্যবসায়ী ইংরেজরা হয়ে উঠেন বঙ্গদেশের শাষণকর্তা।

১৭৫৭ সালের পরেও ইংরেজরা পনেরো বছর নবাবদের নাম মাত্র শাষক হিসাবে রেখেছিলেন। তখন রাজধানী ছিলো মুর্শিদাবাদে, এরপর রাজধানী স্থানান্তর করা হয় কলকাতায়। সেখানে যারা বাস করতেন তারা বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু। মুসলমান যারা ছিলেন, তারা ছিলেন আধা বাঙ্গালী, উর্দুতে কথা বলতেন। তখন কলকাতায় বাঙালি সমাজে বিরাট পরিবর্তন আসে। ইংরেজদের সাথে হিন্দুরা ব্যবসা করে একটা বড় ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তৈরি হয়। এই ব্যবসায়ীদের অনেকেই আবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে জমিদারী কিনে জমিদার হন। এই সময় ঘটে শিক্ষার বিস্তার। ইংরেজি শিখলেই খুব সহজে চাকরি করে দ্রুত ধনী হওয়া যেতো। যেমন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষেরা খুলনায় বাস করতেন। তারা ছিলেন গরীব ব্রাহ্মন, কলকাতার জেলেদের ডাকে তারা সেখানে পুরোহিত হিসাবে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু তারা শুধু পুরুতগিরি করতেন না, তাদের মধ্য কেউ কেউ ইংরেজি শিখে, ব্যবসা করে খুব অল্প সময়ে ধনী হন। এমনকি কেউ কেউ ফরাসি ভাষা শিখে ফরাসিদের সাথে ব্যবসা করেন, চাকরি করেন এবং জমিদারি কিনে জমিদার হন।

ইংরেজি শিখলে রাতারাতি ধনী হওয়া যেতো সেটা ঠিক, কিন্তু নিম্নবর্নের মুসলমান বা হিন্দুরা সেটা শেখার সুযোগ পান নি। কলকাতার জমিদার ও ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু, এভাবে নতুন যে বাঙালি সমাজ গড়ে উঠলো তার নেতা হলেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। পুরা উনিশ শতক ধরে চলে তাদের প্রতিপত্তি। তাদের প্রজা ছিলেন, নিম্নশ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমান। প্রজাদের উপর এই জমিদাররা করতেন অত্যাচার ও শোষণ। এরফলে উনিশ শতকের শেষদিকে পূর্ব বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠে।

এদিকে যখন শিক্ষার সুযোগ পেয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা চাকরি পেলেন, ধনী হলেন, তখন তারাই শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের বিকাশ ঘটান। অন্য দিকে, ইংরেজি শিক্ষা গ্রহন না করায় মুসলমানরা অশিক্ষিত ও গরীব রয়ে যায়। এই বৈষম্যের ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠে এবং তারা একসাথে বসবাস করতে আপত্তি জানান।

অবশ্য এর পিছনে রাজনৈতিক কারনও ছিলো। যেমন শাষনের প্রথম একশো বছর ইংরেজরা দেশী কোন মানুষের বিরোধীতার মুখামুখি হন নি। কিন্তু ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় দেশীয় সৈন্যরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহটি সিপাহি বিপ্লব নামে পরিচিত। ইংরেজরা এটি খুব কঠিন হাতে দমন করেছিলেন। এই বিদ্রোহে বঙ্গদেশের কোন শিক্ষিত হিন্দুর সমর্থন ছিলোনা, যেহেতু ইংরেজদের কারনেই তাদের ভাগ্যের উন্নতি হয়েছিলো তাই তারা ইংরেজদের সমর্থন করেছিলেন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, এর ঠিক দশ বছর পর হিন্দুরা দেশকে ভালোবাসতে শুরু করলেন, নিজেদের হিন্দু পরিচয়কে বড় করে তুললেন। দেশটা যে ইংরেজরা চালাচ্ছেন সেটা তাদের পছন্দ হলোনা। নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তারা ‘হিন্দু মেলা’ করে সেখানে হিন্দুদের বীরত্ব ও কীর্তির প্রদর্শনী করলেন, নিজেদের পত্রিকা বের করলেন, দেশপ্রেমের গান লিখলেন।

তবে জাতি হিসাবে তারা তখন শুধু হিন্দুদের বোঝাতেন, মুসলমান নয়।  বছর দশেক পরে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ‘ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেন কিন্তু সেটা ছিলো হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান। তারা সরাসরি স্বাধীনতার দাবী করলেন না। ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে গঠিত হলো ‘ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’, এটি ছিল সত্যিকারের একটি রাজনৈতিক দল।এই দলেরও প্রায় সব সদস্য হিন্দু ছিলেন।আর নেতাদের বেশির ভাগ ছিলেন বাঙ্গালী হিন্দু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র- ছাত্রীদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

তবে তারা যে মুসলমানদের ইচ্ছা করে বাদ দিয়েছিলেন তা নয়, আসলে তখন মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতন মানুষ খুব কমই ছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া শুরু করলেন। কেবল রাজনৈতিক অধিকার নয়, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের জন্য তারা চাকরিও বেশি দাবি করলেন। তারা সরাসরি ইংরেজদের আক্রমন না করে, আগেকার মুসলিম শাষনের সমালোচনা করা শুরু করলেন ফলে অনেকের মধ্যে মুসলমান বিদ্বেষ দেখা দিলো। সাধারন মুসলমানদের প্রতিও তুচ্ছ – তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাতেন, তাদের গালি দিতেন ‘ যবন’ বলে। এর মধ্যে একটা ঘৃণার ভাব প্রকাশ পেতো। বিশেষ করে হিন্দু লেখকদের লেখায় এবং আচরনে এই বিদ্বেষ প্রকাশ পেতো। তখনকার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টাপাধ্যায় তার উপন্যাস ও অন্যান্য লেখায় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন।

সিপাহি বিপ্লবের পরে ইংরেজরা দেশ শাষণের নতুন কৌশল নিলেন। তারা ঠিক করলেন, হিন্দু এবং মুসলমান উভয়কে উভয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন।  হিন্দুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা খুব বেশি হওয়ায় মুসলমানদেরকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের করার প্রয়োজন দেখা দিলো। এই নীতিকে বলা হতো ‘ ডিভাইড আ্যান্ড রুল। কিন্তু বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমানদের কাজে লাগানো এত সহজ ছিলোনা। কারন তখনকার মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন— শিক্ষাদীক্ষা, টাকা -পয়সা, এবং সামাজিক অবস্থানে।  ইংরেজরা মুসলমানদের খানিকটা সু্যোগ সুবিধা দিয়ে তাদের সামাজিক অবস্থান উন্নত করতে চাইলেন। এই বাড়তি সুবিধা দেওয়াকে ন্যায্য প্রমান করার জন্য ১৮৭২ সালে উইলিয়াম হান্টারকে দিয়ে মুসলমানদের সম্পর্কে একটি বই লেখান—-‘ ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ নামে।

এখানে হান্টার দেখিয়েছেন, ইংরেজ আমলে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় সামাজিক দিক দিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং পিছিয়ে আছেন। সরকার মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে চেষ্টা করলেন এবং চাকরিতে একই যোগ্যতা সম্পন্ন হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে মুসলমান প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেয়ার নীতি অবলম্বন করলেন। ছোটখাটো কিছু চাকরিও দেয়া হলো তাদের।

শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য কিছু মক্তব – মাদ্রাসাও খোলা হলো। ফলে ১৮৯০ এর দশক থেকে শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে কিছু সচেতনতা দেখা দিলো। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সমাজের মুসলমান নেতারা সাধারন শিক্ষার বদলে দাবি করেছেন মক্তব- মাদ্রাসার শিক্ষা অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা।এই শিক্ষার মান তখন খুব নিচু ছিলো।তখনকার শিক্ষা বিভাগের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারন প্রাইমারিতে যে ছাত্ররা পড়তো, তারা চিঠি লিখতে ও সাধারন অঙ্ক করতে পারতো। কিন্তু মক্তবের ছাত্ররা চিঠি লেখার কিংবা সাধারন অংক করার মতো শিক্ষা পেতোনা।

সরকার বিশ শতকের প্রথম ২০/৩০ বছর মুসলমানদের উপরে তোলার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেন, শিক্ষা বিভাগে মুসলমান কর্মচারী নিয়োগ দেন। মক্তব- মাদ্রাসার জন্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করেন।এমন কি ১৯২০ এর দশকে মুসলমান শিক্ষামন্ত্রীও নিয়োগ করেন, যাতে তিনি তার ব্যক্তিগত  আগ্রহ ও উদ্দ্যোগ দেখান।

এতকিছুর পরেও বিশ শতকের প্রথমদিকে মুসলমানদের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।গ্রামের মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা দেখা যায়নি, যদিও বা কেউ সচেতন  হতেন, তাহলেও শহরের স্কুলে পড়ানোর মতো তাদের আর্থিক সঙ্গতি ছিলোনা। ইংরেজী শিক্ষা ছিলো ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার। উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, ১৮৭২ সালে জেলা স্কুলগুলিতে নবম – দশম শ্রেণীতে বেতন ছিলো চার টাকা। তখন দীন মজুরদের সারাদিনের রোজগার ছিলো দু আনা। কাজেই সাধারন চাষী মুসলমানদের ইচ্ছা থাকলেও ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে পড়ানো সম্ভব ছিলোনা। তখন ইংরেজি শেখার কেন্দ্র ছিলো কলকাতা, যেখানে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমান খুব কমই ছিলো। সেখানকার অভিজাত মুসলমানরা ইচ্ছা করেই ইংরেজি শিখতেন না, কারন ইংরেজরা মুসলমান নবাবকে পরাজিত করে বঙ্গদেশ দখল করায় ইংরেজদের শত্রু বলে মনে করতেন।

মুসলমানরা নেতারা অনেকে পিছিয়ে থাকার মতো আত্মঘাতী অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা সহজে বংলাকে মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকার করতে চাননি। কেউ কেউ ছেলেদের পড়াতে চেয়েছেন আরবি- ফার্সী, ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারেও উৎসাহ দেখান নি। অর্থাৎ যে বিষয়ে পড়লে চাকরি পাওয়া যাবে, আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে, সে বিষয়ে তাদের আগ্রহ ছিলোনা।

১৯২২ সালে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বাঙালি মুসলমান নেতাদের খুব আপত্তি ছিলো। ফজলুল হক তখন বরিশালের অধিবাসী ছিলেন, তিনি ব্যবস্থাপক সভায় বাংলার বিরোধীতা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, কয়েক মাস পরে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার বিরুদ্ধে মুসলমান ছাত্রদের উৎসাহ দিয়েছিলেন।

সত্যি বলতে কি কেবল মুসলমান নেতারাই নন, সাধারন মুসলমানদের অনেকেই মনে করতেন, বাংলা হিন্দুদের ভাষা, মুসলমানদের নয়। বিশ শতকের গোঁড়ায় লেখাপড়ায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানরা কতটা পিছিয়ে ছিলেন এই তথ্যে সেটা বোঝা যায়——

১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ও বঙ্গের মুসলমান পুরুষদের লেখাপড়ার হার :

হিন্দুদের হার                          মুসলমানদের হার

সাধারন শিক্ষা – ২১.৮ %।            ৯.৭ %

ইংরেজি শিক্ষা – ৯.৭ %                 . ৮৫ %

উচ্চশিক্ষায় মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে ছিলেন। ১৮৫৭ সাল থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে পাঞ্জাব থেকে বার্মা পর্যন্ত বিরাট এলাকায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা বিএ পাশ করেছিলেন, তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩৩৮ জন ( শতকরা ৪.৫)। তারপরও মুসলমানরা স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে মক্তব- মাদ্রাসার মধ্যে বন্দী রেখে আত্মঘাতী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

বাংলা ও ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে তাদের মনোভাব সত্যিকার অর্থে উন্নতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বঙ্গদেশে মুসলমানদের শাষন আরম্ভ হয় ১২০৪ সালে। তখন থেকে এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়।দেশীয় লোকদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে প্রমান পাওয়া যায় যে, দেশীয়রা ছিলেন নামে মাত্র মুসলমান, তখনও তারা পূর্বপুরুষদের আচার- অনুষ্ঠান পালন করতেন, আগের পেশায় জীবিকা অর্জন করতেন এবং বাংলায় কথা বলতেন। নিজেরা আরব- ইরান থেকে এসেছেন, একথা চিন্তাও করতেন না। কিন্তু উনিশ শতকে যখন তাদের মধ্যে সামান্য পরিমানে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়লে তখন তাদের চিন্তায় পরিবর্তন এলো। তখন শিক্ষিত মুসলমানরা নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে সচেতন হলেন।

মুসলমানদের প্রতি হিন্দু লেখকদের বিজাতীয় মনোভাব এবং বাংলা ভাষায় হিন্দু উপকরণ মুসলমানদের বাংলা শিখতে এবং বাঙালি বলে ভাবতে বাধা দিতো। ফলে, হিন্দু কবি সাহিত্যিকরা ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষায় এগিয়ে ছিলেন বলেই তখনকার বাংলা সাহিত্যে গড়ে তোলেন। এর সাথে মুসলমান সমাজের কোন যোগাযোগ ছিলোনা।

অন্যদিকে মুসলমানরা লেখাপড়ার দিকে না যাওয়ায় , উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে তারা কোন অবদান রাখতে পারেন নি। ফলে মুসলমানদের ভিতরে এক ধরনের হীনতার মনোভাব তৈরি হয়। এমন কি, তারা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসাবে অস্বীকার করেছিলেন।

বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যারা মধ্যযুগে বিদেশ  থেকে এসে বঙ্গদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন, তারা এদেশেই বিয়ে করেছিলেন এবং তাদের সন্তানরা কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই বাঙালি হয়ে পড়েন, তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলা ভাষাকে নিজেদের ভাষা হলে মানতে পারেন নি এবং বঙ্গদেশকে নিজেদের দেশ হিসাবে স্বীকার করেন নি।

এইসব বিদেশ থেকে আসা মুসলমানরা বেশিরভাগ বাস করতেন শহরে, কথা বলতেন উর্দুতে এবং নিজেদেরকে আশরাফ বা অভিজাত বলে দাবি করতেন। কিন্তু শতকরা ৯৮ ভাগ মুসলমান বাস করতেন গ্রামে, কথা বলতেন বাংলায়, আর জীবিকা নির্বাহ করতেন জমি চাষ করে। আশরাফরা ঢালাওভাবে গ্রামের মুসলমানদের আতরাফ বা  নিম্নশ্রেনীর মুসলমান বলতেন এবং অবজ্ঞার চোখে দেখতেন।

২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

বাংলাভাষী মুসলমানরা বাস করতেন পূর্ববঙ্গে এবং আর উর্দুভাষীরা বেশিরভাগই বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গে।  অবাঙালি মুসলমানরা শিক্ষা এবং আর্থিক দিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বাংলাভাষী মুসলমানরা যখন লেখাপড়ায় এগিয়ে আসলেন, তখন তাদের মনে ভাষার ব্যাপারে একটি মনোভাব কাজ করতো। উর্দু- ফার্সি- আরবি ভাষার সাথে ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছিলো। হয়তো বা এটিও একটি কারন, যে কারনে বহু বাঙালি মুসলমান মূল ধারার শিক্ষাকে প্রাসঙ্গিক মনে করতেন না। মক্তব- মাদ্রাসায় বাংলা ভাষা পড়ানো হতোনা। বাংলার প্রতি সবচেয়ে বিরোধীতা ছিলো মোল্লা- মৌলবিদের, তারা বাংলাকে হিন্দুর ভাষা বা ‘কুফুরি জবান’ অর্থাৎ কাফেরের ভাষা বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। তারা যেহেতু আরবি- ফার্সি- উর্দু জানতেন, তাই ধর্মীয় ব্যবসা এবং প্রতিপত্তি স্থায়ী করার জন্য তারা এমন কথা বলতেন।

বাংলা ভাষার এতো বিরোধীতা সত্ত্বেও বিশ শতকের গোঁড়ায় শিক্ষিত মুসলমানদের অনেকেই বাংলা শেখার প্রয়োজন মনে করেন। তারা অনুভব করেছিলেন বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া না শিখলে তাদের পক্ষে ব্যাপক হারে শিক্ষিত হওয়া সম্ভব নয়। সৈয়দ এমদাদ আলী ছিলেন সেকালের একজন প্রধান লেখক। তিনি লিখেছিলেন, ‘বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাঙ্গলা এ বিষয়ে কোন মতদ্বৈত থাকা উচিত নয়।’

তখনকার এই বিতর্কে মওলানা আকরাম খাঁও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯১৮ সালের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষনে অত্যন্ত জোরালো গলায় বলেছিলেন, ‘দুনিয়াতে অনেকরকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙ্গালী  মুসলমানের ভাষা কি? উর্দু না বাঙ্গলা ? এই প্রশ্ন তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত।’

শেখ আবদুল গফুর জালালী এবং মহম্মদ শহীদুল্লাহও মোটামুটি একই সময়ে বাংলার সমর্থনে বক্তব্য রেখেছিলাম। বিতর্কের শেষে, বাঙালি মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে শুধু মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকার করে নেন নি, ভালোও বেসেছিলেন।

মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের একটি লেখা—

‘আমি ভিখারী হইতে পারি, দুঃখ অশ্রুর কঠিন ভারে চূর্ণ হইতে আপত্তি নাই। আমি মাতৃহারা অনাথ বালক হইতে পারি— কিন্তু আমার শেষ সম্বল — আমার ভাষাকে ত্যাগ করিতে পারিনা। আমার ভাষা হরন করিয়া আমার সর্ব্বস্ব হরন করিও না। তিরিশের দশকে এসে বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলমান সমাজের দ্বিধাদন্দ্ব কেটে যায়। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় আবার তা ফিরে আসে ভিন্ন চেহারায়। তবে মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা কিনা— তখন আর আর এই বিতর্ক ফিরে আসেনি।

 

তথ্য ঋণ

গ্রন্থ — মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস লেখক — গোলাম মুরশিদ