আমার বাবা ড. আশরাফ সিদ্দিকী গত ২০ মার্চ আমাদের সবাইকে ফেলে চলে গেছেন অনন্তের দেশে। কদিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে পিতৃবিয়োগের শোকের সাথে সমঝোতা করার একটা পথ খুঁজে পেয়েছি। নিজের ভেতর অনুভব করতে পেরেছি, তিনি কাটিয়ে গেছেন এক পরিপূর্ণ জীবন। সে জীবন তো শোকে কাতর হবার নয়, সে তো উদ্‌যাপনের, সে তো অন্যকে উজ্জীবিত করার। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে আজ আমরা সবাই গৃহবন্দী। সবার মনে নানা শঙ্কা। এ রকম অবস্থায় সবাইকে বুকের বোঝা কমিয়ে একটু হালকা হতে সাহায্য করার জন্য আমি লিখছি আমার বাবার বিয়ের উপাখ্যান।

১৯৫০ সাল, পাকিস্তান ও ভারত সবে ব্রিটিশ উপনিবেশমুক্ত হয়েছে। অবিভক্ত ভারতের প্রতিশ্রুতিময় কবি আশরাফ সিদ্দিকী বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তালেব মাষ্টার ও অন্যান্য কবিতা’ ভীষণ সাড়া জাগিয়েছে সর্বত্র। গ্রাম্য পাঠশালার তালেব মাষ্টার, কৃষক রহিসুদ্দিন বা কুদ্দুস বয়াতির কঠিন-করুণ রোমাঞ্চহীন খাঁটি বাস্তবতায় ভরা কবিতাগুলো তরুণদের মধ্যে বেশ আলোড়ন তুলেছে। বিদগ্ধ নারীকুলের কাছেও তৈরি করেছে বিশেষ আবেদন। কবি আশরাফের এই সময়কার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তিনি তখন কল্পনার পুরুষ। তাঁর লেখা ছাড়া কোনো পত্রিকা, কোনো সাময়িকী, মাসিক বা বিশেষ সংখ্যা বের হতো না। তাঁর কণ্ঠস্বর তখন পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে রেডিওর মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সরকারি কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেওয়া হয়ে গেছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দুই বছরের জন্য লোকসাহিত্যে তাঁর গবেষণায় সহযোগিতা করার জন্য ডেপুটেশনে আশরাফ সিদ্দিকীকে নিয়ে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক হিসেবে তিনি হয়ে ওঠেন বেশ জনপ্রিয়।

স্ত্রী সাইদা চৌধুরীর সঙ্গে আশরাফ সিদ্দিকী

এ তো খুবই স্বাভাবিক যে পরিবার চাইবে তাঁকে দ্রুত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করতে। বাবা সাত্তার সিদ্দিকী মেয়ে দেখার দায়িত্ব দিলেন আশরাফের মামা আবদুল হামিদ চৌধুরীকে। তাঁরই সন্তান আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ইডেন কলেজের শিক্ষিকা আফিয়া খাতুন (আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এম শামসুল হকের স্ত্রী) প্রস্তাব নিয়ে এলেন। তিনি বলেন, ‘সাজাহান ভাই, আশরাফের জন্য উপযুক্ত পাত্রী আমি পেয়ে গেছি। সাইদা আমার প্রাক্তন ছাত্রী। শি ইজ আ বর্ন লিডার। ভাষার প্রশ্নে মেয়েদের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদ ঘটে ইডেন কলেজে। তার নেতৃত্ব দিয়েছিল এই সাইদা। সে তো এ জন্য এক্সপেল্ড পর্যন্ত হতে যাচ্ছিল। তা ছাড়া ইডেন কলেজের ঘোড়ার গাড়িগুলো মেয়েদের চাদর দিয়ে ঘিরে নিয়ে আসত। এই মেয়ে একদিন সেই চাদর খুলে দিয়ে বলে, “আবরুর নামে গাড়ির ভেতর জন্তুর মতো সেদ্ধ হতে হতে আর আসব না।”

সে ইংরেজির অধ্যাপক সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল খান সাহেব আবদুর রব চৌধুরীর মেয়ে। মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব এলে রব চৌধুরী সাহেব সোজা বলে দিতেন, “বিয়ে পাসের আগে আমার বাড়ির কোনো মেয়ের বিয়ে আমি দেব না।” সাইদা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এমএ পড়ছে। তাই প্রস্তাব দেওয়ার এখনই মোক্ষম সময়।’

রাজি হয়ে গেল আশরাফ সিদ্দিকীর পরিবার। পূর্বনির্ধারিত দিনে দাদা তাঁর ভাই-ভাগ্নেদের নিয়ে চলে এলেন আমার নানার বাড়ি ৩৭ নাজিমুদ্দিন রোডে। কথাবার্তা সুন্দরভাবেই হলো। না হয়ে উপায় কী? ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আফিয়া খাতুন, আবদুল হামিদ চৌধুরী ও আবু সাঈদ চৌধুরী। সব কথার শেষে আমার দাদা বললেন, ‘মা জননীকে কি আমরা একটু দেখতে পারি?’ আর যাবে কোথায়? নানা বেশ গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, ‘মেয়ে দেখিয়ে মেয়ের বিয়ে আমার পরিবার দেয় না। আমাকে দেখে বিচার করবেন বিয়ে দেবেন কি দেবেন না। দাদা আর কথা বাড়াননি।’

কিন্তু সেই সময়ের জনপ্রিয় রোমান্টিক কবির কি আর তাতে মন ভরে? তার ভীষণ ইচ্ছা ছিল তার ভাবী বধূকে একবারটি দেখবেন। সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। তিনি পড়ান বাংলা বিভাগে, ভাবী বধূটি পড়ে ইতিহাস বিভাগে। বন্ধুবান্ধবকে দায়িত্ব দিলেন, ‘শিগগিরি খোঁজ লাগাও, কবে কোথায় সাইদার ক্লাস।’ খোঁজ পাওয়াও গেল। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন না হলে যা হয়, প্রতিবারই শোনেন, এই তো ছিল, এখনই চলে গেছে। বাবার বন্ধু সাবের রেজা করিম বললেন, দেখতে বোধ হয় বিশেষ ভালো নয়! তাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আরেক বন্ধু জানাল, ‘খবর পেয়েছি গায়ের রংটা পাকা নয়।’ বাবার মনের অবস্থা বেশ সংকটপূর্ণ। একে নিজে ধবধবে ফরসা, অন্যদিকে সে যুগের গ্রামের ছেলের কাছে সুন্দরের সংজ্ঞার সঙ্গে গায়ের রং অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল।

স্ত্রীর ছবি হাতে আশরাফ সিদ্দিকী

একদিন ক্লাস নিচ্ছেন, হঠাৎ খবর এল, তার ভাবী বধূটি ক্লাস করছে। তৎক্ষণাৎ ছাত্রছাত্রীদের নয়-ছয় বুঝিয়ে দৌড়ে গেলেন বর্তমান মেডিকেল কলেজের গেটের কাছে ইতিহাস বিভাগে। দুর্ভাগ্য কাকে বলে, প্রফেসর কোনো কারণে আজ ক্লাস আগে ছেড়ে দিয়েছেন। ছাত্রছাত্রী ছত্রভঙ্গ। একে-তাকে জিজ্ঞাসা করতে করতে পার হয়ে গেল আরও কিছুটা সময়। একজন কেউ হাত তুলে দেখাল, ওই তো সাইদা। সেদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন, একটি মেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠছে। পেছন থেকে দেখা গেল তার আজানুলম্বিত ঘন কালো রেশমি চুল। পরনে চিকন পেড়ে সাদা শাড়ি। সে এক অপরূপ দৃশ্য। গাড়িতে ওঠার জন্য হাত দিয়ে দরজাটা ধরেছিল সে। পেছন থেকে বাবা দেখলেন তার হাত। সে হাত কাঁচা সোনার রঙের। একনিমেষে সব টেনশন প্রশমিত হয়ে গেল। পেছন থেকেই যে এত ভালো লাগা দিতে পারে, সামনে থেকে সে তো তাকে মুগ্ধ করবেই। নিশ্চিন্ত মনে বিয়ের পিঁড়িতে চড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন কবি আশরাফ।

এর মধ্যে একদিন দুই সাংবাদিক কোনো ম্যাগাজিনের জন্য এল আশরাফ সিদ্দিকীর ইন্টারভিউ নিতে। সঙ্গে চাই ছবিও। বাবা খুশিমনে ইন্টারভিউ দিলেন। তাঁর বিবাহ প্রসঙ্গও এল, উত্তর দিলেন, ছবির জন্য বিভিন্ন পোজও দিলেন। সেই ইন্টারভিউ কিন্তু আর ছাপা হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা গেল সেই ছবি ও ইন্টারভিউর কথা ব্যঙ্গ করে করে চলছে আশরাফ সিদ্দিকীর পিণ্ডি চটকানো। বাবা ভাবতেই পারেননি, এরা সাংবাদিক নন, একজন তাঁর শ্যালক ফিজিকসের ছাত্র লতিফ চৌধুরী, আরেকজন তাঁর স্ত্রীর সমবয়সী চাচা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আলীম চৌধুরী। দুলাভাইকে বোকা বানিয়ে শালা-শালিদের সে কী তুমুল আনন্দ! বাবার সঙ্গে তাঁর শালা-শালিদের ছিল দারুন দুষ্টুমির সম্পর্ক। কাঁচা মরিচের শরবত থেকে শুরু করে কি না খাইয়ে ঠকিয়েছে তারা! বাবার এতে কোনো আপত্তি ছিল না। তিনি যেকোনো শালির হাত পাকড়ে ধরে বলতেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—

‘মোটা পণ লালসায় মন ভোরো না,  

শালি যেথা নেই, সেথা বিয়ে কোরো না।’

মায়ের পিঠাপিঠি বোন লুলু খালা। তিনি রুসমতের দিন বাবার মাকে প্রথম দেখার দৃশ্যটা অভিনয় করে দেখাতেন। সাট করে তার নিজের শাড়ির আঁচলটাকে রুমালের মতো করে নিজের মুখের সামনে ধরতেন আর দাঁড়িয়ে দুই হাত ও দুই পা ঠক ঠক করে কাঁপাতেন। বলতেন, ‘আয়নাতে তোদের মায়ের মুখ দেখিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখলেন দুলাভাই? উত্তর দিতে তো পারলই না, বরং কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। তোদের বাবাকে নিয়ে আমাদের সে কি হাসি!’

তাঁর অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতায় আমাদের মনে হতো, আমরাও যেন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত।

যাহোক, তাদের বিয়ে তো হয়ে গেল ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৫১ সালে। কদিন পর এল নতুন বছর। মহাখুশিতে বাবা তার ছাত্র পড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটলেন। চোখেমুখে নববিবাহিতের সুখ। গিয়ে দেখেন নতুন বছরে তিনি খেতাব পেয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা তাঁর নাম দিয়েছে: ‘বানরের গলায় মুক্তোর মালা’। এতে বাবাকে কোনোদিন অখুশি হতে দেখিনি, হাসতে হাসতে বলতেন:  ‘আমি মুক্তোর মালা তো পেয়েছি’!

আমার মায়ের বিয়ের শাড়িটা আমার কাছে, ওড়নাটা ছোট বোনের কাছে, গহনাগুলো ভাইয়ের বউদের কাছে। আমরা সবাই খুব যত্নের সঙ্গে সেগুলো সংরক্ষণ করছি। মাকে

নিশ্চয়ই অপরূপ সুন্দর লেগেছিল বিয়ের দিন! ছোটবেলায় মা-বাবার বিয়ের এত গল্প শুনেছি যে আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, আমি তাঁদের বিয়ে দেখেছি। সবাই খুব হাসত আমার কথা শুনে। একটু বড় হবার পর বেশ রাগই হতো। এটা ভারি অন্যায়। আমার মা-বাবার বিয়ে, আর আমি দেখতে পাব না, তা কেন হবে? মায়ের পেটের ভেতর থেকেই আমি তাঁদের বিয়ে দেখেছি বলে দাবি করতে শুরু করলাম।

সাইদা চৌধুরী

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে’ গানটা আজও শুনলে আমার মনে হয় একটা শব্দ ভুল গাইছে। ওটা হবে ‘অলিরও কথা শুনে আলম হাসে’। আমার নানাবাড়িতে ওভাবেই গাওয়া হতো। কারণ, আমার মায়ের ডাকনাম অলি, আর বাবার আলম। আজও তাদের ওই গানের সময়ের বাঁকা হাসি আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা।  মা-বাবার ভালোবাসার আরেকটা চিত্র ফোটা আছে শরতের সকালে। মা ভোরে উঠে জুঁই ফুল তুলে এনে বাবার পড়ার টেবিলে রেখে যেতেন। আর বাবা সেই ফুলের গন্ধ নিতে নিতে রচনা করতেন কোন কবিতা বা শেষ করতেন লোকসাহিত্যের কোনো বই।

আমার বড় ভাই বলে যে বাবাকে নাকি সে ঈর্ষান্বিতও হতে দেখেছে। আমার মা ছিলেন দেবরদের প্রিয় ভাবি। ফলে পারিবারিক আড্ডায় গান গাইতে গিয়ে তরুণ দেবরেরা ভাবিকে একটু বেশি পাত্তা দিলে বাবা নাকি বলতেন, বেশি আদিখ্যেতা হচ্ছে। মা নাকি সম্রাজ্ঞীর মতো হাসতেন, ভাবটা: তুমি একা নও সিদ্দিকী সাহেব, আমার আরও গুণমুগ্ধ আছে।

বাবার সঙ্গে মায়ের আরেকটা ঠাট্টা আমার খুব মজা লাগত। তিনি বলতেন, ‘সিদ্দিকী সাহেব, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে কিন্তু আসলে আজও হয়নি। কারণ, বিয়ের সময় আমি তো কবুল বলিনি, বলেছেন আমার খয়েরপুরের দাদি। তুমি তো আসলে তাকেই বিয়ে করেছ।’

আজ মা নেই, মায়ের সেই দাদিও নেই, মায়ের ভাই পদার্থবিদ ড. লতিফ চৌধুরী নেই, স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী নেই, শিক্ষিকা আফিয়া খাতুন নেই, বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নেই। যুদ্ধে হারিয়েছি শহীদ ড. আলীম চৌধুরীকে। কিন্তু রয়ে গেছে পারিবারিক আড্ডার সেই হাসির রোল। ছোট ছোট কথা, আনন্দ আর ঠাট্টা।

আমাদের ছেড়ে মা চলে গিয়েছিলেন ২৪ বছর আগে। বনানীতে মায়ের কবরেই আমরা বাবাকে শুইয়ে দিয়েছি। আমরা তার পাঁচ সন্তান, সেখানে গিয়ে যখন দাঁড়াই, যেন শুনতে পাই, মা বলছেন, ‘সিদ্দিকী সাহেব এসেছ? এসো, এসো। এত দেরি করলে যে, বাচ্চারা ছাড়ছিল না বুঝি? দেখো, বরাবরের মতো আমি তোমার জন্য সব কেমন গুছিয়ে রেখেছি। কবিতা লিখতে তোমার এতটুকু অসুবিধে হবে না। চেয়ে দেখো, আমাদের মাথার ওপর শিউলি গাছ। কী মশাই, দেখলে তো শিউলি ফুলের গন্ধটাও জুগিয়ে রেখেছি। এখন বলো আমাকে ছাড়া তুমি কি হতে পারতে আজকের আশরাফ সিদ্দিকী?’