১৮৯৯ সাল। রবার্ট জোহান কোলডিউইর মতো একজন সেলফ-ট্রেইনড প্রত্নতত্ত্ববিদের কৌতুহলকে নিবৃত্ত করবার সাধ্য কারই বা আছে! বাইবেলে বার বার উল্লেখ হয়েছে একটি নাম, একটি শহরের নাম। সেই শহরটি খুঁজতেই বের হয়েছেন আজ কোলডিউই। হিসাব-নিকাশ করে একটি জায়গা বেছে নিয়েছেন তিনি। সেখানেই আপাতত খননের কাজ শুরু করবেন। জায়গাটি বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ৫৯ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।

১৮৯৯ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত খনন কাজ চালিয়েছিলেন কোলডিউই, বইয়ের সেই শহরটিকে খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে। টানা পনেরো বছর কাজ করে আস্তে আস্তে খুঁজে বের করেছেন তিনি শহরটির ধ্বংসাবশেষ। অবশেষে শুধু নাম জানা শহরটির অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছে সমগ্র বিশ্ব। শহরটির নাম ব্যবিলন।

রবার্ট জোহান কোলডিউইর ব্যবিলন শহর যিনি খুজে পান

রবার্ট জোহান

ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে ওঠা মেসোপটেমীয় সভ্যতার সবচেয়ে বিশাল জনসংখ্যাসমৃদ্ধ শহর হচ্ছে ব্যবিলন। ইউফ্রেটিসের তীরবর্তী এই শহরটির গোড়াপত্তন হয় আক্কাদীয় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর হাত ধরে।

অনেকের মতে, ব্যবিলন নিজেই একটি সভ্যতা এবং রাজা ডুঙ্গির মৃত্যুর পর সুমেরীয় সভ্যতার ধ্বংসই ব্যবিলনের জন্ম দেয়। তবে ব্যবিলনকে প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজা হাম্মুরাবি। রাজা হাম্মুরাবির সময়ের ব্যবিলনকে বলা হয় ‘পুরাতন ব্যবিলন’।

দেবতা মারদুকের উপাসনাকারী রাজা হাম্মুরাবি ছিলেন প্রজাবৎসল ও জ্ঞানী। তার সময়ে কৃষিকাজ, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তখন মেসোপটেমিয়া ছিলো সবচেয়ে সুশৃঙ্খল সভ্যতা, আর ব্যবিলন ছিলো তার প্রাণ।

ব্যবিলন শহরের শাসক

হাম্মুরাবির শাসনামলে মহা শক্তিধর হয়ে ওঠে ব্যাবিলনিয়া সাম্রাজ্য; Image Source: Ancient Pages

সুমেরীয় রাজা ডুঙ্গি সর্বপ্রথম আইন প্রণয়নের নিয়ম চালু করেছিলেন, কিন্তু তা ছিলো মৌখিক। রাজা হাম্মুরাবিই সর্বপ্রথম আইনকে লিখিত রূপ দেন। মানুষের সমান উঁচু গাঢ় সবুজ রঙের পাথরের স্তম্ভে তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ২৮২টি আইন। তার প্রণীত আইনের প্রভাব পরবর্তী হিব্রু সভ্যতা, ফিনিশীয় সভ্যতা, এশিয়া মাইনর, এমনকি আধুনিক কালেও পরিলক্ষিত হয়। আইন কোডিফাই বা বিধিবদ্ধকরণের জন্য হাম্মুরাবি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। হাম্মুরাবির আইনের সবচেয়ে চমৎকার বিষয়টি হলো নারীর সম্পত্তি ও অন্যান্য অধিকার নিশ্চিতকরণ। এটা প্রমাণ করে যে, তার সময়ে নারীদের মর্যাদা ছিলো অনেক বেশি।

হাম্মুরাবির মৃত্যুর পর পুরাতন ব্যবিলনীয় সভ্যতা বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। এর প্রায় এক হাজার বছর পর রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার পুনরায় ব্যবিলনীয় সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই পর্যায়কে বলা হয় ‘নব্য ব্যবিলনীয় সভ্যতা’, যা মূলত ক্যালডীয় সম্প্রদায়ের মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো।

নব্য ব্যবিলনে শিল্প ও সংস্কৃতির নবজাগরণের যুগ সূচিত হয়েছিলো। এ সময়ই রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার ভাস্কর্য ও স্থাপনাগুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যবিলনের দেয়াল, টাওয়ার অফ বাবেল, ইশতার গেইট এবং ঝুলন্ত বাগান।

সর্বপ্রথম সমগ্র ব্যবিলনকে দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত করেছিলেন রাজা হাম্মুরাবি। পরবর্তীতে রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার চল্লিশ ফুট উঁচু তিনটি বৃত্তাকার দেয়াল তৈরী করেছিলেন ব্যবিলনকে কেন্দ্র করে।

ব্যবিলনের টাওয়ার অব বাবেল

টাওয়ার অব বাবেল; Image Source: Google Art Project

দৃষ্টিসীমার চেয়েও উঁচু টাওয়ার অফ বাবেল ছিলো স্বর্গে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম ব্যবিলনীয়দের জন্য। অনেকে অবশ্য ধারণা করেন, এটি মূলত ছিলো দেবতা মারদুকের একটি বিখ্যাত মন্দির।

প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য হলো ব্যবিলনের ঝুলন্ত বাগান, যেটি রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার তার স্ত্রী আমিতিসের জন্য তৈরী করেছিলেন। মাটি থেকে ৮০ ফুট উচ্চতায় তৈরী এই অদ্ভূত সুন্দর বাগানে রাজা হাজার রকমের গাছ লাগিয়েছিলেন এবং একটি চমৎকার ওয়াটার লাইনও যুক্ত করেছিলেন এর সাথে।

ব্যবিলনের দ্বিতীয় রাজা নেবুচাদনেজার

রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার, যিনি কারো কাছে নায়ক আবার কারো কাছে খলনায়ক; Image Source: Ancient World History

ষাঁড়, সিংহ ও ড্রাগনের ছবি সম্বলিত লাপিস লাজুলি দিয়ে তৈরী উজ্জ্বল নীল রঙের ইটে নির্মিত হয়েছিলো ব্যবিলনের আভ্যন্তরীণ শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার। প্রেম, যৌনতা ও যুদ্ধের দেবী ইশতারের নামে এর নাম রাখা হয়েছিলো ইশতার গেইট। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, চমৎকার সুন্দর এই ফটকটিই প্রাচীন ব্যবিলনের প্রধান আকর্ষণ ছিলো।

চমৎকার এই ব্যবিলন শহরের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য ও চাকচিক্য শহরটির প্রতিরক্ষার গুরুত্বকে ছাপিয়ে গিয়েছিলো। আমুদে ও বেখেয়ালি জাতিতে পরিণত হয়েছিলো শহরের মানুষ। আর তাই ব্যবিলনের পতন হয়েছিলো পানির মতো সহজ। পারস্য সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট খুব সহজেই প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ব্যবিলনের পাহারাবিহীন দরজা দিয়ে।

ব্যবিলন তার প্রতিরক্ষা দেয়াল নিয়ে এতোই গর্বিত ছিলো যে, মহান সম্রাট সাইরাসের আগমনে তারা ভ্রূক্ষেপও করে নি। কিন্তু বুদ্ধিমান সাইরাস আঁটলেন অন্য ফন্দি। শহরের মধ্য দিয়ে বহমান ইউফ্রেটিস নদীর প্রবেশপথে নির্মিত দরজাটিতে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিলো না। তাই সাইরাস অপেক্ষা করলেন ব্যবিলনীয়দের একটি উৎসবমুখর দিনের জন্য। সমস্ত শহর যখন উৎসবে মজে ছিলো, ঠিক তখন পানির নিচ দিয়ে ভেতরে গিয়ে সাইরাসের একজন সৈন্য সেই দরজাটি খুলে দিয়েছিলো। ব্যস, শহরের মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাইরাস বিনা বাধায়ই প্রবেশ করেছিলেন ব্যবিলনে এবং সেই সাথে পতন ঘটেছিলো প্রাচীন ইতিহাসের এক আকর্ষণীয় সভ্যতার।

 

 

রেফারেন্স: