মহাভারতের প্রভাবশালী নারী চরিত্রের মধ্যে একটি হচ্ছে রাজমাতা সত্যবতী । তিনি ছিলেন স্বয়ং মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষী বেদব্যাসের মাতা। কৌরব, পান্ডব বংশের সূচনা তথা সমগ্র মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহের সূচনা তাঁর মাধ্যমেই শুরু হয়। হস্তিনাপুরের মহারাজা শান্তনুর তাঁকে বিবাহ করার পর থেকে নাটকীয়তা শুরু হয় কুরু রাজবংশে, যার সমাপ্তি হয় কুরুক্ষেত্রের মহাসমরে। সত্যবতীর জন্ম বিষয়ে যে আখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় তাঁর জন্ম সাধারন মার্তৃগর্ভে হয় নি। তাঁর জন্ম দৈবিক। চেদি দেশের রাজা উপরিচর, অদ্রিকা নামক অপ্সরার ব্রহ্মশাপ, শ্যেনপক্ষী ও যমুনা নদী তাঁর জন্মের প্রভাবক। পরে উপরিচর রাজার আদেশে এক মৎসজীবী ধীবর তাঁকে লালনপালন করতে থাকেন। তিনি অত্যান্ত রুপবতী,গুনবতী ছিলেন। কিন্তু শৈশব থেকে ধীবরের ঘরে লালিত পালিত হওয়ার কারনে তাঁর শরীর থেকে মৎসের আঁষটে গন্ধ পাওয়া যেতো। এইজন্য তাঁর নাম ছিলো মৎসগন্ধা। সত্যবতী যমুনা নদীতে যাত্রীদের খেয়া পার করতেন। একদিন সেখানে বশিষ্ঠ মুনির পুত্র পরাশর মুনি নানা তীর্থ ভ্রমন করতে করতে উপস্থিত হলেন।অনিন্দ্য সুন্দরী সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পরাশর মুনি তাঁর কাছে নিজের বংশধর পুত্র কামনা করেন।

সত্যবতী ও বেদব্যাস; Image source: Wikimedia

আসলে সেই সময়ে ব্রাহ্মণরা সমাজে খুবই সম্মানিত ছিলেন।তাঁদের সকল চাহিদা পূরন করতে হত।সত্যবতী লোকলজ্জার ভয় পেলে পরাশর মুনি অন্ধকারচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তারপরও সত্যবতী কুমারী কন্যার এইরুপ কার্য সমাজে কলঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কা করলে, পরাশর মুনি তাঁকে বর দেন এই বলে যে, তাঁর ইচ্ছা পূরন করলেও সত্যবতী সমাজে কুমারী হিসেবেই পরিচিত থাকবেন। সত্যবতীর পরাশর মুনির ইচ্ছা রক্ষার্থে এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। যমুনার কোনো এক দ্বীপে সেই পুত্রের জন্ম ও লালনপালন হয় বলে তাঁর নাম রাখা হয় দ্বৈপায়ন। আর তাঁর কালো গাত্রবর্ণের কারনে আরেক নাম হয় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।সেইসময়ে এরকম ঘটনা অস্বাভাবিক ছিলো না। এরকম অনেক উদাহরন পাওয়া যায়। প্রাপ্তবয়স্ক হলে এই পুত্র মার্তৃ আদেশে তপস্যারত হন। পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদকে ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব বেদ এই চারভাগে ভাগ করে বেদব্যাস নামে সমাজে পরিচিত হন। সত্যবতী কিন্তু কখনও তাঁর পুত্রকে অস্বীকার করেন নি।বরং কুরুবংশের বিভিন্ন প্রয়োজনে তিনি ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হন।তো, পরাশর মুনির বরে সত্যবতীর গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়ে গিয়ে সুঘ্রাণ চলে আসে। এক যোজন দূর হতে তাঁর সুঘ্রাণ পাওয়া যেতো বলে তাঁকে যোজনগন্ধা বলেও লোকে ডাকত।

মহাভারতের সত্যবতী

এইদিকে হস্তিনাপুরে কুরু বংশের মহৎপ্রাণ রাজা শান্তনু তখন রাজত্ব করছেন। তাঁর সাথে বিভিন্ন ঘটনায় দেবী গঙ্গার পূর্বে বিবাহ হলে সেখানে রাজকুমার দেবব্রতের জন্ম হয়।এক শর্তের কারণে দেবী গঙ্গা রাজা শান্তনুকে ছেড়ে চলে গেলে কুরুরাজ্য রাণীশূন্য হয়ে পড়ে।সেসময়ে সমাজে প্রচলিত ছিলো, যে রাজার রাণী থাকে না, সেই রাজ্যে সমৃদ্ধিও আসে না। আবার রাজা শান্তনুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে নি:সঙ্গতাও পেয়ে বসে।গুনবাণ ও মহাবীর পুত্র, রাজত্ব থাকার পরও তিনি একাকী বোধ করতে লাগলেন।তিনি দেবব্রতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্তও করান। এরপর একদিন যমুনার তীরে ঘুরতে ঘুরতে অত্যান্ত সুগন্ধ অনুভব করলেন এবং তার অনুসরন করে সত্যবতীর সন্ধান পান। সত্যবতীর রূপ দেখে মুগ্ধ শান্তনু তাঁকে স্ত্রী রুপে পেতে চাইলেন। তখন সত্যবতী রাজাকে তাঁর পিতা ধীবর নেতা দাশরাজের সাথে কথা বলতে বলেন। শান্তনু সত্যবতীর পিতার কাছে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তিনি মহারাজ শান্তনুকে দুইটি শর্ত দেন। সত্যবতীকে মহারাজ শান্তনুকে ধর্মপত্নী হিসেবে গ্রহন করতে হবে এবং সবচেয়ে গুরুতর শর্ত ছিলো শান্তনুর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবব্রতকে বাদ দিয়ে সত্যবতীর সন্তান সন্ততীকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করতে হবে।প্রিয় পুত্রকে এভাবে বঞ্চিত করতে রাজি হতে পারলেন না রাজা শান্তনু। কিন্তু সত্যবতীকে ভুলতেও পারছেন না।সবসময় মন মড়া হয়ে থাকলেন। বিচক্ষণ যুবরাজ ঠিকই আন্দাজ করতে পারলেন পিতার মনের অস্থিরতা। পিতাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে রাজা শান্তনু পুত্রকে বললেন যে, শাস্ত্রে আছে যার একটি পুত্র জীবিত থাকা আর পুত্র না থাকা উভয়েই সমান। শান্তুনু পুত্রকে জানালেন যে তিনি নিজের মৃত্যুর পর বংশের কথা ভেবেই চিন্তিত। দেবব্রত মহারথী, ভীষন যোদ্ধা, দেবতারাও তাঁর সাথে যুদ্ধে হার মানতে বাধ্য কিন্তু তারপরও তাঁর কোনো অনিষ্ট হলে শান্তনু রাজার বংশনাশ হবে-এ চিন্তাতেই তিনি বেশি আচ্ছন্ন । পিতার এ কথা শুনে দেবব্রত পিতাকে পুনরায় বিবাহ করতে অনুরোধ করেন।কিন্তু শান্তনু সেটাও মানতে পারেন না। দেবব্রত কিন্তু ঠিকই খোঁজ নিয়ে পিতার মনপীড়ার কারন বের করলেন।তিনি সত্যবতীর পিতার কাছে গিয়ে তাঁর কন্যাকে পিতার জন্য চাইলেন। সত্যবতীর পিতা জানালেন যে তাঁর কন্যার জন্মদাতা পিতা মহারাজ উপরিচর তাকে আগেই বলেছেন যে, রাজা শান্তনুই তার কন্যার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা দেবব্রত।দেবব্রত থাকতে সত্যবতীর কোনো পুত্র সিংহাসন লাভ করতে পারবে না। একথা শুনে দেবব্রত মৃদু হেসে জানালেন তিনি পিতার সুখের জন্য সিংহাসন ছাড়তে রাজি আছেন কিন্তু সত্যবতীর ধুরন্ধর পিতা এ আশ্বাসেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি জানালেন দেবব্রতের সদিচ্ছার ব্যাপারে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু কাল দেবব্রতের সন্তান যদি তা মেনে না হয়, যদি সে বা তার বংশধরেরা যদি নিজেদের অধিকারের জন্য যুদ্ধে জড়ায়, সে ব্যাপারে ও আশ্বাস চান তিনি।

দেবব্রতের ব্রহ্মচর্যের ভীষণ প্রতিজ্ঞা; Image source: Wikimedia

তখন দেবব্রত তাঁর জীবনের সবচাইতে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।তিনি তাঁর মাতা গঙ্গাকে স্বাক্ষী রেখে শপথ নেন ব্রহ্মচর্যের। তাঁর এই কঠিন প্রতিজ্ঞায় সবাই খুব সন্তুষ্ট হনএবং দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেন। পিতা খুশি হয়ে তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দেন। তিনি সংসারে পরিচিত হন “ভীষ্ম” নামে। এরপর সত্যবতী ও রাজা শান্তনুর বিবাহ হয়। তাঁদের চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুইটি পুত্র জন্মের পর রাজা শান্তনু দেহ ত্যাগ করেন।চিত্রাঙ্গদকে কুরু বংশের সিংহাসনে বসানো হয় কিন্তু একই নামের এক গান্ধর্বের সাথে অনর্থক যুদ্ধে মৃত্যুবরন করেন চিত্রাঙ্গদ। তখন সত্যবতী ও ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসান। এদিকে কাশী রাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকার স্বয়ংবরের খবর শুনে সত্যবতী ভীষ্মকে পাঠান তাঁদেরকে স্বয়ংবর থেকে তুলে আনতে।পরবর্তীতে ভীষ্ম তিন রাজকন্যাকে তুলে নিয়ে আসলে অম্বিকা আর অম্বালিকার সাথে সত্যবতী বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলেও যক্ষ্মা রোগে বিচিত্রবীর্য প্রাণ ত্যাগ করেন।কুরুবংশের যখন ঘোর সংকটকাল উপস্থিত হয় তখন সত্যবতী ডেকে পাঠান তাঁর প্রথম পুত্র মহর্ষী বেদব্যাসকে। সমাজের নিয়োগ প্রথা অনুযায়ী বেদব্যাসের ঔরষে যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুরের জন্ম হন। তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে সত্যবতী শাস্ত্রমতে পান্ডুকে রাজা করেন।

সত্যবতী

পান্ডু বিবাহ করেন কুন্তীভোজ রাজ্যের রাজকন্যা কুন্তীকে, যদিও তিনি যাদব বংশের ছিলেন এবং মদ্র দেশের রাজকন্যা মাদ্রীকে। ধৃতরাষ্ট্রের জন্য রাজমাতা সত্যবতী শত পুত্রের বর প্রাপ্তা গান্ধারীর জন্য ভীষ্মকে গান্ধার রাজ্যে পাঠান। এরমধ্যে পান্ডু কিমিন্দম ঋষি কর্তৃক অভিশাপ পেয়ে বনবাসে দুই স্ত্রীসহ গমন করেন। সেখানে পাঁচ পান্ডবের জন্ম হওয়ার পরপরই অভিশাপের কারনে পান্ডু ও মাদ্রী দেহত্যাগ করলে কুন্তী সহ পাঁচ পান্ডবকে হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে আনেন রাজমাতা।এদিকে শত কৌরবের জন্মও হয়েছে। রাজপ্রাসাদে প্রথম থেকেই দুর্যোধনসহ কৌরবরা মামা শকুনীর প্রোরোচনায় পান্ডবদের সাথে শত্রুতায় নিয়োজিত হয়। সত্যবতী কুরুবংশের উত্তরাধিকারী চেয়েছিলেন কিন্তু একশ পাঁচ রাজপুত্রের এমন রেষারেষী তিনি কখনও চাননি।তিনি পান্ডুর মৃত্যুতে খুবই শোকাতুরা হয়ে পড়েন।

তিনি কুমারদের হিংসাত্মক মনোভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এরপর পুত্র বেদব্যাস তাঁকে জানান যে অতি শিঘ্রই তাঁর প্রিয়জনেরা একে অপরকে যুদ্ধে শেষ করবে, যা তিনি বৃদ্ধ বয়সে সহ্য করতে পারবেন না।ফলে রাজমাতা সত্যবতী পুত্রবধূ অম্বিকা আর অম্বালিকাকে নিয়ে বনে গিয়ে তপস্যা শুরু করেন এবং শিঘ্রই ইহলোক ত্যাগ করে স্বর্গীরোহন করেন। সত্যবতীর পালক পিতার অন্যায় চাওয়াই বঞ্চিত করেছিলো সবচাইতে যোগ্য রাজকুমার দেবব্রত ভীষ্মকে।তাঁর নিজ পুত্ররা কেউই সিংহাসনে স্থায়ীভাবে আসীন হতে পারেন নি।তাঁর স্বামীর বিখ্যাত কুরুবংশ দুই শাখায় ভাগ হয়ে যায় এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একপক্ষ আরেকপক্ষকে শেষ করে দেয়। হয়ত সত্যবতীর পিতার শর্ত ঠিক ছিলো নিজ কন্যার ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু পরবর্তীকালে তা ভীষন অনর্থ ঘটায়। যদি সত্যবতীর পিতা অন্যায় এ শর্ত না দিতেন শান্তনু রাজাকে তবে হয়তো মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে মোড় নিতো। কিন্তু নিয়তির বিধিলিপি পূর্ব হতে বোঝা মানুষের অসাধ্য।