মন্তু নামের একজনের সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৮০ সালে, আমার পানচিনিতে। তখন সে ছিপছিপে গড়নের, ধবধবে ফরসা, ঢেউ খেলানো চুলে ছোট খোপা করা, পিঠ টানটান করে বসা, স্মিত হাসির এক পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই মহিলা। মিনা করা সবুজ জড়ি পাড়ের শাড়ির সঙ্গে মেলানো পান্না বসানো ব্রেসলেট, কানের টপ আর আংটিতে কোথাও কোন বাড়াবাড়ি নেই! আছে বিশেষ এক ব্যক্তিত্ব। আংটি পরানোর সময় আদরমাখা গলায় বলল, ‘কেঁদো না বেটা, তুমি তো আব্রারকে চেনোই, আর আমরাও তোমাকে অনেক আদর করব। হ্যাঁ, এই মন্তুই আমার শ্বাশুড়ি।

বিয়ের পর আমিও মন্তুর ২৩/১ ওয়ারী স্ট্রিটের বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের একজন হলাম। মন্তুরা কর্তা-গিন্নি একমাত্র ননদ ও চাচাতো ননদসহ নিচতলায় থাকে। খাওয়া, বসার ঘর নিচেই, আর আছে বিশাল এক বারান্দা; তার সামনে সবুজ ঘাস আর গাছে গাছে ঘেরা মাঠ। আমরা—তার ছেলে আর ছেলেবউরা দোতলা আর আড়াইতলায় থাকি। অসময়ে চলে যাওয়া ভাসুরের তিন সন্তানকেও মন্তু নিজ সন্তানসম মমতায় মানুষ করেছে। দিনভর বহু আত্মীয়ের আনাগোনায় ভরা মন্তুর সংসার। সাত বছর ছিলাম মন্তুর সংসারে। একটু একটু করে পরিচয় হয়েছিল বালিকা মন্তু, বয়সন্ধিকালের মন্তু, নববধূ মন্তু, পরিণত বয়সের মন্তু, আর শাশুড়ি মন্তুর সঙ্গে।

তার পোশাকি নাম ছিল সোফিয়া সুলতানা। বড় বোন মায়ার সঙ্গে মিলিয়ে তার ডাকনাম রাখা হয়েছিল মমতা। বাবার আদরে মমতা কবে মমতু হয়েছিল কারও মনে নেই। তবে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে মমতু হয়ে গেল মন্তু! আমরা প্রায়ই মন্তুর মা নায়না (বেগম সাইদা খাতুন) আর খালা ময়নার সাহচর্য পেতাম। নায়না স্মিতহাসির স্বল্পভাষিণী আর ময়না নানা ঐতিহাসিক গল্পে ঠাসা এক কলকলিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। দুজনই বেড়ে উঠেছে হুগলি শহরে। তাদের চলা-বলায় একটা দ্যুতি ছিল। কিসের সে দ্যুতি, তা ঠিক ঠাহর করতে পারতাম না। এটুকু বুঝতাম, এটা শুধু আভিজাত্যের দ্যুতি নয়, এ আরও কিছু। উৎস আবিষ্কারে খুব বেশি সময় লাগেনি। তাদের জমিদার পিতা সৈয়দ আহমদ আলি, শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়ার অন্যতম সহযোগী। তিনি সে স্কুলের প্রথম গভর্নিং বডির সেক্রেটারি ছিলেন। নায়না আর ময়না সেই স্কুলের প্রথম পাঁচজন ছাত্রীর দুজন। আমার দুই নানিশাশুড়ির মধ্যে দেখতে পেয়েছিলাম বেগম রোকেয়ার শিক্ষার আলো।

মন্তুর বাবাকে সবাই চেনে। ফরিদপুরের জমিদার ময়জুদ্দিন বিশ্বাসের বড় ছেলে বলে শুধু নয়, তাঁকে সবাই চেনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের ন্যাশনাল কমিটির মেম্বার হিসেবে, প্রাদেশিক আইনসভায় উচ্চকক্ষের একজন জাতীয় প্রতিনিধি হিসেবে। ব্ল্যাক হোল আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে। তার বাবা আর কেউ নন, মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী লাল মিয়া (আবদাল্লাহ জহিরুদ্দিন)। মন্তু বলত, ‘আমাদের কলকাতার পার্ক সার্কাস রোডের বাসায় বিখ্যাত সব রাজনীতিবিদ আসতেন।’ শুধু কলকাতার বাড়ি কেন, তাদের ফরিদপুরের বাড়ি ময়েজ মঞ্জিল কত ইতিহাসের সাক্ষী। লাল মিয়ার উদ্যোগে ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কাউন্সিলের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ফরিদপুরে। গান্ধীজি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষ বসু, কাজী নজরুল ইসলাম আর সরোজিনী নাইডু সেই উপলক্ষে এসেছিলেন ময়েজ মঞ্জিলে। ১৯২৪ সালে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনও হয় ফরিদপুরে। সেই সভায় শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় নাকি সভাপতিত্ব করেছিলেন আর স্বল্প সময়ের জন্য রবীন্দ্রনাথও এসেছিলেন সে বাড়িতে। সেসব অবশ্য মন্তু জন্মানোর আগের কথা। ১৯৩৪ সালে অল ইন্ডিয়া মোশান পিকচার কনফারেন্স যেবার ফরিদপুরে হলো, তখন তাদের ময়েজ মঞ্জিলে পৃত্থীরাজ কাপুর, লীলা দেশাই, কানন দেবী, প্রমথেশ বড়ুয়াসহ আরও কতজন এসেছিলেন! তখন মন্তুর বয়স মাত্র ৪ বছর।

ওয়ারীর বাড়ি

এক শুক্রবারে দুপুরের খাবারের পরে জম্পেশ আড্ডা হচ্ছিল। মন্তুর ছোট বোন পিকু আর চাচাতো বোন সুলতানা গল্প জুড়েছিল। মন্তুসহ তারা তিনজন খাটে শোয়া আর আমরা এদিক ওদিক গুটি শুটি মেরে বসা। উঠে এলো মন্তুর বিয়ের গল্প। জানলাম মন্তুর তখন মাত্র ১৩ বছর বয়স। সে বলল, ‘বড় আপার বিয়ের সব প্রস্তুতি নিচ্ছি, এর মাঝে শুনি আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। বেথুনে মাত্র ক্লাস এইটে পড়ি। রাগটা দ্বিগুণ হলো, যখন শুনলাম আমার আর বড় আপার বিয়ে একই সঙ্গে হবে। যা যা মজা করব ভেবেছিলাম, সব ভণ্ডুল হয়ে গেল।’ সুলতানা খালা বললেন, ‘মন্তু, তোর মনে আছে, আমি দৌড়ে এসে তোকে বলেছিলাম, দুই জামাই-ই এসে গেছে! তাদের একজন সিগারেট খায় আর একজন নস্যি নেয়।’ আমার শাশুড়ির চোখে-মুখে ১৩ বছরের কিশোরী ফিরে এল। ‘আমি তো সে কী আল্লাহ আল্লাহ করছি, আমার বরটি যেন সিগারেট খায়! নাহ্, আমার দোয়া কাজে লাগেনি। বাসরঘরে দেখি, আমার স্বামীটিই নস্যি নেন। তোমার শ্বশুরের চেয়ে আমার তো দুলাভাইকেই (আহসান আহমেদ আশক) বেশি পছন্দ হয়েছিল। তিনি যেমন লম্বা, তেমন ফরসা, আর কী ভালো উর্দু কবিতা লিখতেন!’ সুলতানা খালা তেড়ে উঠে বললেন, ‘আমি কিন্তু সাত্তার দুলাভাইয়ের দলে, মন্তু। তুমি পছন্দ করো না জেনে এককথায় কেমন নস্যি ছেড়ে সিগারেট ধরলেন।’ পঞ্চাশোর্ধ্ব শাশুড়িও ষোড়শীর মতো আরক্ত হলো। মাথা নেড়ে অস্বীকার করে বলল, ‘আমার জন্য নয়, তার পেটের সমস্যার জন্য ডাক্তার বলেছিল বলে তিনি সিগারেট ধরেন।’ আমরা সবাই উচ্চহাসিতে ফেটে পড়লাম।

অল ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স আ্যসোসিয়েশনে যোগ দিতে আসা অতিথিরা

কোনো এক বিকেলে নিচের বারান্দায় মন্তু আর আমার শ্বশুরের সঙ্গে চা খেতে খেতে জেনেছিলাম মন্তুর সঙ্গে তার স্বামীর প্রথম দৃষ্টি বিনিময় কিন্তু বিয়ের রাতে নয়। ফ্রক পরা মন্তুর যখন ৭ বছর বয়স, সে তাদের কলকাতার বাড়ির বড় খাবার টেবিলে উঁবু হয়ে বসে ছবি আঁকছিল। ১৭-১৮ বছরের এক যুবক এসে তাকে বলল, ‘খুকি, তোমার বাবা কোথায়? তাকে একটা চিঠি দিতে হবে যে।’ মন্তু আঁকা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমাকে নামিয়ে দিন, আমি ডেকে আনছি।’ সেই তরুণ যুবকটি আর কেউ নন, আমার শ্বশুর মশাই। তিনি নাকি কোলে করে ছোট্ট মন্তুকে টেবিল থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন।

কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে আবদুস সাত্তার চৌধুরীদের তিন ভাইয়ের বিশাল তিনতলা বাড়ি। সেখানেই মন্তুর বিবাহিত জীবন শুরু। দেশ বিভাগের কারণে ঘরবাড়ি, ব্যবসা সব ফেলে তাদের চলে আসতে হয়েছিল। সেই থেকে তাদের সংসার ২৩ ওয়ারী স্ট্রিট।

মন্তু যদি এ যুগে জন্মাত, এটা অবধারিত যে এই উপমহাদেশের একজন সেরা জুয়েলারি ডিজাইনার হতো। অদ্ভুত সুন্দর গহনা ডিজাইন করতে পারত সে। সবার বিয়ের গহনা বানানোর ভার তার ঘাড়েই পড়ত। আমার বিয়ের পর, সোনার দোকানে গেলে কোক খেতে দেয়—এই লোভে মন্তুর সঙ্গী হতাম। কে সি রায় আর তার ভাইয়ের জড়োয়া হাউস, এই দুটো দোকানেই যেত মন্তু। দোকানমালিকদের তার প্রতি একটা সমীহ লক্ষ করতাম। ভাবতাম, এত গহনা গড়ায়, সে জন্য বোধ হয়। পরে একদিন কে সি রায় বললেন, বউমা, তোমার শাশুড়ির সাহসের গল্প কিছু জানো? রায়টের সময় কী করেছিলেন, জেনে নিয়ো। কদিন পরে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল তাদের সমীহের কারণ। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে কাশ্মীরে হজরত বাল মসজিদ থেকে হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর চুল চুরি হবার ঘটনাকে উপলক্ষ করে কিছু রাজনীতিবিদ, ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে দাঙ্গায় উসকে দেয়। আগুনে ঘি পড়েছিল, যখন আইয়ুব খান ঢাকা বিমানবন্দরে বলে গেলেন, এই ঘটনাকে ঘিরে পাকিস্তানের মুসলমানদের যে প্রতিক্রিয়া হবে, তার জন্য সরকার দায়ী থাকবে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে তত দিনে আমার জানা হয়ে গেছে, ঢাকায় এই দাঙ্গার একটা বড় টার্গেট ছিল বণিক শ্রেণি। তারা আশায় ছিল, হিন্দুরা দেশ ছাড়বে এবং তাদের সম্পত্তিগুলো দখল করে নেবে।

আমার শ্বশুরের অনেক সহকর্মীই হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এদিকে স্বর্ণকার কে সি রায় পরিবারও বিপদে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় নিজেদের অসহায় অবস্থার কথা মনে পড়ল মন্তুর। কী ভয়াবহ সেই ৭২ ঘণ্টা! তার পরপর বাবা হলেন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির সম্পাদক (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, প ১৯)। মন্তু আর তার স্বামী ১৯৬৪ সালের রায়টের সময় অনেককে নিয়ে এল নিজ বাড়িতে। কে সি রায়ের দুই ভাই, তাদের স্ত্রী-সন্তানও ছিল তাদের মধ্যে। অনেক সোনা-গহনা সঙ্গে করে আনতে পারলেও কিছু রয়ে গিয়েছিল উত্তর মৈসুণ্ডিতে। তাদের অনুরোধে ছোট ছেলে সোয়েব বাজারের ছালা ভরে নিয়ে এল সব গহনা। ছোট বাচ্চাদের যাতে কেউ চিনতে না পারে, তাই সব মুসলমান নাম দেওয়া হয়েছিল। এক বিকেলে বাচ্চারা মাঠে খেলছিল। তাদের একজন এসে খবর দিল, ‘খাকি পোশাক পড়া উর্দু কথা বলা দুজন এসে তোমার শ্বশুরকে খুঁজছেন।’ সবাই প্রমাদ গুনল। মন্তু একে একে দুই মেলাল। এত লোকের খাবার ব্যবস্থা করা, যে সে কথা তো নয়। সকালে বাজার করতে ঠাটারি বাজার পাঠিয়েছিল। মাছ, মুরগি, শাকসবজি, যা পেয়েছে সবই তুলে এনেছিল। সে জায়গা নাকি ছিল রণক্ষেত্রের সাজে। বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল, সেখান থেকেই কেউ পিছু নিয়েছিল। খবর বের হয়ে গেছে। আমার শ্বশুর নিচে নামার পর সামান্য বাক্য বিনিময় হলো। তারপরই তাদের একজন বললেন, ‘কে সি রায় কেয়া আপকি ইধার ঠায়রা?’ শ্বশুর মশাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। অতিথি দুজন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, ‘চৌধুরী সাহাব, ঘাবড়াইয়ে মাত। হাম দোনোকো ওয়াইফ উনকা কাস্টমার হ্যায়। হামলোগ সামান লেনেকে লিয়ে আয়া হ্যায়।’ সবাই হাপ ছেড়ে বাঁচল!

কংগ্রেস প্রাদেশিক সম্মেলন

পরিণত বয়সের মন্তুর সাহসের আরও কিছু গল্প আছে। ১৯৬২ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। মাহমুদ হোসেনকে সরিয়ে ড. ওসমান গনিকে উপাচার্য করা হয়েছে। ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন। ছাত্ররা তদানীন্তন গভর্নর আবদুল মোনেম খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চায় না। হরতাল, ছাত্র অসন্তোষ ইত্যাদির মুখে সমাবর্তন আর হতে পারেনি। তবে এর রেশ পোহাতে হয়েছিল সব ছাত্রনেতাকে। তাদের বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি হয়েছিল। আমার শ্বশুরের ভাগনে আমিনুল ইসলাম হিরু সে সময় ওয়ারীর বাসায় থেকে ঢাকা কলেজে পড়ত। তার ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিসে যাতায়াত ছিল। সেখানে গেলে কোন হলে কবে রেইড হবে, তার কিছু খবর পাওয়া যেত। সেসব খবর ক্লাস করে ফেরার পথে হলে গিয়ে ছাত্রনেতাদের জানিয়ে দিয়ে আসত। সে যা-ই হোক, অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু হবার পরে ছাত্রনেতারা যখন আশ্রয় খুঁজছে, তখন এই আমিনুল ইসলাম তার মামিমা অর্থাৎ মন্তুর শরণাপন্ন হয়।

মন্তুর স্বামী তখন ব্যবসার কাজে খুলনায় গেছেন। ‘হিরু আমাকে বলার পর আমার আবারও আব্বার কথা মনে পড়ে গেল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি বহুবার জেলে গেছেন। আমি তাদের নিয়ে আসতে বললাম।’ আঙুল তুলে মন্তু আমাকে দেখাল, বলধা গার্ডেনের দিকে। ‘দেয়ালের পাশে একটা মই রেখে দিলাম। পুলিশ এলে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে মই বেয়ে বলধা গার্ডেনে চলে যাবে। তারপর সেখান থেকে পালিয়ে যাবে।’ ওয়ারীর এই বাড়িতেই ৫-৭ দিন পালিয়ে থাকল ছাত্রলীগের জিএস ও ডাকসুর ভিপি শেখ মনি, এফএইচ হলের ভিপি কে এম ওবায়েদুর রহমান এবং ঢাকা হলের ভিপি বরগুনার আসমত আলি সিকদার। সারা দিন তারা ঘরেই থাকত। একদিন রাতে গোপন মিটিং করতে বের হয়েছিল। খবর এল পুরান কোর্টের সামনে থেকে তিনজনকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।

মন্তুকে নিয়ে আমি সবচেয়ে গর্বিত হই তার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরের ভূমিকার জন্য। ২৭ মার্চে যখন কারফিউ উঠল, মন্তু তার সেজ ছেলে আব্রারকে পাঠিয়ে আহমদ ছফাকে নিয়ে আসে ওয়ারীতে। এখান থেকেই উনি চলে যান কলকাতায়।

প্রৌঢ়ত্বে মন্তু

আরেকটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল মন্তু আর তার স্বামী আবদুস সাত্তার চৌধুরীকে। মার্চ মাসের ২৯ তারিখ নাগাদ মন্তুর আত্মীয় মমিনুল হক খোকার শ্বশুরবাড়ি মারফত বার্তা এল, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেলকে নিয়ে তার স্বামীর ছোটবেলার বন্ধু সাত্তার ভাইয়ের বাসায় কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে চান। তখন তাঁরা মমিনুল হক খোকার শ্বশুর বাড়িতেই আছেন। মমিনুল হকের শ্বশুরবাড়ি এবং আমার শ্বশুরবাড়ির একই প্রাচীর। নিরাপত্তার কারণে স্থান পরিবর্তনের কথা যখন ভাবছেন, তখন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীই জোর দিয়ে বলেন যে, ‘আমি সাত্তার ভাইয়ের বাসায় যেতে চাই’ (মমিনুল হক, অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল: বঙ্গবন্ধু তার পরিবার ও আমি, প ১৪৫ )। আমার শ্বশুর বলেন, ‘আমি যখন ব্যাপারটা তোমার শাশুড়িকে জানাই, তখন এ-ও বলি, তোমার এক ছেলে পাকিস্তানে আটকা, আরেক ছেলে ২৫ মার্চে নওগাঁতে বিয়ে খেতে গিয়ে নিখোঁজ। হয়তো বর্ডার ক্রস করে গেছে। ভেবে বলো, কী করা উচিত। আর্মি জানতে পারলে সবাইকে শেষ করে দেবে। তোমার শাশুড়ি একটুও সময় নেননি। বলেছেন, “বিপদে তোমার বন্ধুর পরিবার তোমার ওপর ভরসা করেছে। তাদের নিয়ে এসো। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।”’ দুই বাড়ির মাঝের প্রাচীরের অংশবিশেষ ভেঙে মানুষ যাওয়ার মতো ফাঁক তৈরি করা হলো। তিন দিনের মতো তাঁরা মন্তুর অতিথি হয়ে ছিলেন। ওপরতলায় মাঝের ঘরে থাকতেন সবাই। শুধু শেখ জামাল থাকত আড়াইতলার ঘরে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে আমার শ্বশুরকে ডেকে পাঠান। তিনি পৌঁছালে সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু নাকি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘সাত্তার, সারা দেশ তো পড়ে ছিল। কিন্তু তোমার ভাবি বিশ্বাস করেছিলেন তোমাকে।’

মন্তু কিন্তু মিটিং, মিছিল এমনকি ট্রাকে চড়েও আন্দোলন করেছে। স্বাধীনতার পরে তার পাকিস্তানে আটকে পড়া বড় ছেলেকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে অনশনও করেছে।

আমি যে সময় ও কালে বড় হয়েছি, সে সময় সমাজ আশা করত, মেয়েরা বিয়ের পরে শাশুড়িকে মায়ের জায়গাতেই বসাবে। আমার কিন্তু কখনোই তা মনে হতো না। আমার মনে হতো, শাশুড়ি কখনোই মা হয় না। সেটা আরেকটা সম্পর্ক, সেখানে শ্রদ্ধা আছে, ভালোবাসা আছে, তার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, আবার একই সঙ্গে তার সন্তানকে স্বামী হিসেবে পেতে গিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্বও আছে। যে শাশুড়ি ও বউ সে সম্পর্কটা প্রজ্ঞার সঙ্গে গুছিয়ে নিতে পারে, সেই শাশুড়ি-বউ তো একে অপরের পরম বন্ধু!

আমি তো তাকে বন্ধুই ভাবতাম। অকপটে সবকিছু তাকে বলতে পারতাম। ফাহিম মামার (রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ফাহিম হোসেন চৌধুরী) হলুদে এক মাঝবয়সী লোকের আমার দিকে বারবার তাকিয়ে থাকার মতো ঘটনা নিয়ে হো হো করে সে আমার সঙ্গে হাসতে পারত। অনর্গল তার জীবনের সব গল্প বলতে পারত আর আমার গল্পগুলো আগ্রহ নিয়ে শুনত। কত সহজে প্রশংসা করতে পারত! পরম আদরে শাহি টুকরা, দহি বড়া, জাফরানের ফিরনি বা খাসির রেজালা রান্না শিখিয়ে দিত। তার আলমারি খুলে তার সব গহনাগুলো পরতে আমার এতটুকু সংকোচ হতো না। যা পছন্দ নয়, তেমন আবদার ভয় না পেয়ে নাকচ করতে পারতাম। প্রায়ই বলত, ‘হিরের নাকফুলের লোভ দেখিয়েও তোমাকে নাক ফুটো করাতে পারলাম না।’

কত মজার স্মৃতি তার সঙ্গে! তার হজে যাওয়া উপলক্ষে বোনেরা যখন জোর করছিল ফিরে এসে চাদর পরতে হবে, না হলে অন্য পুরুষ তাকে দেখে ফেলবে, আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলতে পারতাম, ‘জোয়ান অবস্থায় যখন সবাই আপনাকে দেখত, তখন পরেননি এখন কিছুতেই পরবেন না। কেউ আপনাকে দেখবে না।’ মন্তু দারুণ কৌতুকে বলতে পারত, ‘কেন, বুড়ো লোকেরাও বুঝি আমাকে দেখবে না?’ আমি পাল্টা উত্তর দিতে পারতাম, ‘বুড়ো লোকেরা আরও বেশি বাচ্চা মেয়েদের দিকে তাকায়, আপনাকে দেখবে না, তাই পরতে পারবেন না চাদর।’

১৯৯১ সালে মাত্র ৬০ বছর বয়সে হঠাৎ করেই চলে গেল মন্তু ওরফে মমতা ওরফে সোফিয়া সুলতানা ওরফে আমার শাশুড়ি। আমরা তখন অস্ট্রেলিয়াতে। তার ছেলে আব্রার পিএইচডি শেষ করে ফেলেছে। আমার থিসিস জমা দেওয়ার আর মাত্র এক মাস বাকি। জমা দিলেই তো দেশে ফিরে যাব! দেখতে পাব সবাইকে! সে চলে যাওয়ার মাত্র এক দিন আগে আব্রার এক বন্ধুকে বলছিল, ‘আম্মাকে ফোনে বলে রেখেছি ফুলকপি আলু টমেটো আর মটরশুঁটি দিয়ে রুই মাছ রেঁধে রাখতে। ভাগ্যবিধাতা নিশ্চয়ই তখন হেসেছিল! কী আশ্চর্য, একেবারে কোনো রকম বিদায় না নিয়েই, ফুলকপি আলু দিয়ে রুই মাছ না খাইয়েই চলে গেল সে। আমার কত গল্প ছিল, শোনানো হল না। কী শৌখিন ছিল সে! তার জন্য ধবধবে সাদার ওপর পিচ রঙের কাটওয়ার্ক করা বেডস্প্রেড কিনেছিলাম। কী খুশিই না হতো পেলে! তাকে দেওয়া হলো না। সে চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে আফসোস হতো, নাক ফুটোটা করলেই তো পারতাম। তার শখ মেটাতে দু-একবার টিকলি পরলেই তো পারতাম। খুব বেশি কিছু তো সে চায়নি কখনো।

কত বছর পার হয়ে গেছে সে চলে যাওয়ার পর। ভাবতে বেশ লাগে, আমি এখন তার চেয়ে এক বছরের বড়। তার বয়স ৬০-এ থেমে গেছে, আমার এখন ৬১। এখন আমরা আর অসম বয়সী বন্ধু নই। সমবয়সী সখি।