আপনি টনি জাইলসকে চেনেন? মাত্র ৪২ বছর বয়সে সবকটি মহাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন এই ব্যক্তি, এমনকি গিয়েছেন অ্যান্টার্কটিকাতেও। ইতিমধ্যে ট্রাভেল ডায়েরিতে ১৩০টি দেশের নাম। বিশ্বের দুর্গম সব স্থান তিনি একা একাই জয় করেছেন। BBC travel show ২০১৯ সালে তাঁকে নিয়ে করেছে ডকুমেন্টারি।
কিংবা মিশেলকে মনে আছে? প্রচণ্ড মুডি ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত মেয়েটিকে বাড়ির লোক আলাদা করে রেখেছিল সবার থেকে। বাবা মা অবধি তার খবর রাখতো না। সেইসময় দেবরাজ সাহাই নামক এক শিক্ষকের আবির্ভাব। বারো বছর চেষ্টা করে সে গ্রাজুয়েট হয়েছিল।
কিংবা সেই মহিলার নাম নিশ্চই সবার জানা? প্রখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন যাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর দুটি সর্বশ্রেষ্ট চরিত্রের মধ্যে একজন। প্রথম জন নেপোলিয়ন যিনি গায়ের জোরে পৃথিবী দখল করতে চেয়ে বিফল হয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় জন, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন হেলেন কেলার; যিনি মনের জোরে পৃথিবী জয় করতে চেয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন।
হেলেন কেলারের জন্ম ১৮৮০ সালের ২৭শে জুন আমেরিকার আল বামা রাজ্যের টাস্কম্বিয়ায়। মা ছিলেন কেট অ্যাডামস কেলার আর বাবা কর্নেল আর্থার কেলার। ছোট থেকে সুস্থ স্বাভাবিক হেলেন এক অজানা শারীরিক অসুস্থতায় মাত্র ১৯ মাস বয়সে সম্পূর্ণভাবে অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। ধীরে ধীরে যত আলোকজ্জ্বল পৃথিবীর শব্দ ও আলো তার কল্পনা থেকে হারিয়ে যেতে থাকে ততই অবোধ্য হয়ে উঠতে থাকে হেলেন। এইসময় অ্যান সালিভানের আবির্ভাব হেলেনের জীবনে। ৮ বছর বয়সের হেলেনের শিক্ষার ভার নেন কুড়ি বছরের অ্যান। অ্যান নিজেও তখন দুর্বল দৃষ্টিশক্তি নিয়ে লড়াই করছেন রোগের বিরুদ্ধে।
অ্যানের কাছেই শুরু হয় হেলেনের ব্রেইল শিক্ষা। ঠোঁটের ওপর হাত রেখে তার নাড়াচাড়া অনুভব করে শব্দ শিখতে থাকে হেলেন। এরকমই একদিন জলের কলের তলায় হাত রেখে অ্যান হেলেনকে শেখায় ঠাণ্ডা তরল পানীয়টির নাম। খুব কম সময়ের মধ্যে অনেকগুলো শব্দ শিখে যায় সে। দশ বছর বয়সে হেলেন চেষ্টা শুরু করেছিল কথা বলার এবং তার জন্য Horace Mann School-এ কিছু প্রশিক্ষণ নিলেও সারাজীবন হেলেন তার কথা বলার দক্ষতা নিয়ে নাখুশ ছিলেন।
১৪ বছর বয়সে নিউ ইয়র্কের রাইট হুমারসন স্কুলে ভর্তি হন হেলেন। তারপর ১৯০০ সালে Radcliffe কলেজে ভর্তি হন আর ১৯০৪ সালে সেখান থেকেই প্রথম deafblind মানুষ হিসেবে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। Radcliffe কলেজে পড়ার সময়ে হেলেন তার আত্মজীবনী লেখার কাজে মনোনিবেশ করেন। প্রথমে ব্রেইলি টাইপরাইটারে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে পরে সাধারণ টাইপরাইটারে কপি করতেন। ১৯০৩ সাল নাগাদ বই হয়ে বেরোয় ‘The story of my life’। তারপর ধীরে ধীরে লেখেন ‘Out of the dark’, ‘Optimism; an essay’, ‘The World I Live In’, ‘The Song of the Stone Wall’, ‘My Religion’, ‘Helen Keller in Scotland’, ‘Helen Keller’s Journal’, ‘Let Us Have Faith’, ‘Teacher’, ‘Anne Sullivan Macy’, The Open Door’ ইত্যাদি। ‘The story of my life’ এখনও অবধি বিশ্বের ৫০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং এখনও প্রিন্ট হয়ে চলেছে।
হেলেন কেলার সবসময় চাইতেন লেখক হিসেবে পরিচিত হতে তা সত্ত্বেও ইতিহাস তাঁকে একজন সমাজসেবী, রাজনীতিক হিসেবেও মনে রাখবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার যোগদানের বিরোধিতা করেছিলেন কেলার। সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের সমস্যায়, মহিলাদের ক্ষেত্রে এবং আমেরিকার ব্লাইণ্ড ফাউণ্ডেশনে তাঁর ৪০ বছরের কাজ তাঁকে অমর করে রেখেছে।
হেলেন কেলার-এর কাজ শুধু তাঁর নিজের দেশেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল আরো অনেক দেশেও। বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত গরীব দেশগুলির প্রতি তাঁর আলাদা টান ছিল। তাই ১৯৪৬ সালে যখন তাঁকে American Foundation for Overseas Blind ( বর্তমানে Helen Keller International)-এর আন্তর্জাতিক কাউন্সিলর বানানো হল; কেলারের সামনে একটা নতুন দরজা খুলে গেল। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৭ কেলার ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বিশ্বে। ১৯৪৮-এ আমেরিকার প্রথম গুড উইল অ্যাম্বাসাডার হিসেবে তিনি জাপানযাত্রা করেন। ট্যুরটি অসম্ভব সফল ছিল। কাতারে কাতারে মানুষ শুধু তাঁকে দেখতে এসেছিল।
১৯৫৫-তে ৭৫ বছর বয়সে প্রায় পাঁচ মাস ধরে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছেন তিনি। দেখা করেছেন দরিদ্র, দুঃস্থ, অসহায়দের সঙ্গে। হেলেনের কাজের সুবাদেই ১৯৩৫ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ‘সোস্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ সাইন করেন। যাতে unemployment insurance, retirement funds অফার করা হয় দিব্যাঙ্গদের জন্য, সেইসঙ্গে অন্ধ মানুষদের ‘disabled ‘ ক্যাটাগরির আওতায় আনা হয় যাতে তাঁরা সেই সুযোগ সুবিধা পেতে পারেন।
হেলেন কেলার যেখানেই হাত ছুঁয়েছেন, রেখে যেতে চেয়েছেন তাঁর প্রতিভার অক্ষর। তিনি নিজে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, সঙ্গীত উপভোগ করতেন বাদ্যযন্ত্রের উপর হাত রেখে। হাতের ছোঁয়া দিয়ে শ্রবণের কাজ করতেন, মানুষের সঙ্গে করমর্দন করলে বলে দিতে পারতেন আগের পরিচিত কি না? সাঁতার কাটা, নৌকা চালানো, দাবা খেলা, তাস খেলা এবং ঘরে বসে নকশি কাঁথা সেলাই করতে পারতেন। ফুলের পাপড়ি স্পর্শ করে ফুলের রং বলে দিতে পারতেন। তিনি নারী ও কালো মানুষের অধিকারে সর্বদা সচেতন ছিলেন। তিনি বলতেন “প্রতিটি জিনিস এমন ভাবে ছুঁয়ে দেখবে, যেন তোমার স্পর্শশক্তি অবলুপ্ত হবে আগামীকালই।”
৮ বছর বয়স থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত আমৃত্যু হেলেন কেলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করে গেছেন। দেখা করেছেন রুজভেল্ট, চার্চিল, নেহেরুর মত লিডার এর সঙ্গে। আবার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, চার্লি চ্যাপলিন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেনরি ফোর্ডের মত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক সম্মান পেয়েছেন। পেয়েছেন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ্ ফ্রীডম’, ফ্রান্সের ‘লিজিয়ন অফ্ অনার’, ‘লিয়নস হিউ মানিটারিয়ান’ অ্যাওয়ার্ড।
হেলেন কেলারের জীবনে অ্যান সালিভান না এলে অসম্পূর্ণ থাকতো একটা জীবনযাত্রা। হেলেন নিজেই লিখেছিলেন, তিনি যে বিশ্বের মানুষের সামনে দাঁড়াতে পেরেছেন তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব পারকিনস ইনস্টিটিউটের অ্যান সালিভানেরই। ১৯৩৬-এ অ্যান এর মৃত্যুর পর পলি থম্পসন অ্যানের জায়গা নেন। বহুদিন বাদে ১৯৬৮-তে ৮৮ বছর বয়সে হেলেনের মৃত্যুর পর তাঁকে অ্যান ও পলির পাশেই St. Joseph’s Chapel of Washington Cathedral-এ কবর দেওয়া হয়।
লেখার শেষে আবার প্রথমে ফিরে যাওয়া যাক। টনি জাইলসকে মনে আছে? ভূপর্যটক মানুষটিও হেলেন কেলার এর মত অন্ধ ও বধির। তবুও বিশ্বজয় থেমে থাকেনি। কিংবা মিশেল। যদিও সে কোনো রক্তমাংসের মানুষ না। বিখ্যাত হিন্দি ছবি ব্ল্যাক-এর প্রধান চরিত্র। যে ছবিটি হেলেন কেলারের জীবনকে অনুসরণ করেই বানানো। এরকম ভালোবাসা আর পরিকাঠামো দিয়ে হয়তো আমরাও অনেক হেলেনকে খুঁজে পেতে পারি ভবিষ্যতে; যিনি দেশে দেশে দৃষ্টিহীনদের স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছেন।
লেখা – Nisha Nill Mitra
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel