আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার ফতেয়াবাদ পরগনার জালালপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ফতেয়াবাদের অধিপতি মজলিস কুতুবের একজন অমাত্য। আলাওল একজন অভিজাত পারিবারের সন্তান । ছোটবেলা থেকে তিনি বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষা খুব ভালভাবে শেখেন। যুদ্ধবিদ্যা ও সঙ্গীত এর উপরও তাঁর জ্ঞান ছিল।

কবি আলাওলঃ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, Stay Curioussis

 

একবার বাবার সঙ্গে নৌকা করে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় সে ও তাঁর বাবা পর্তুগিজ জলদস্যুদের দিয়ে আক্রান্ত হন। এতে তাঁর বাবা নিহত হন এবং আলাওলকে আহত ও বন্দি অবস্থায় আরাকানে (বার্মা) নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল কম। আরাকানে তিনি একজন দেহরক্ষী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরে মহন্তের বাড়ীতে নাটগীত ও সঙ্গীত শিক্ষকের কাজ করেন। এসময় তাঁর কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটলে প্রধান অমাত্য কোরেশী মাগন ঠাকুরের (১৬৪৫-৫৪) সাহায্যে তিনি আরাকানের রাজদাবারে কাজ পান । পরে একে একে সৈয়দ মুসা (রাজ-অমাত্য), সুলায়মান (প্রধান অমাত্য), মুহাম্মদ খান (সৈন্যমন্ত্রী) ও মজলিস নবরাজ (রাজস্বমন্ত্রী) কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে। প্রায় চারশ বছর আগের কথা। মোঘল স¤্রাট শাহজাহানকে বন্দী করে দিল্লির ক্ষমতা দখল করেন তার পুত্র আওরঙ্গজেব। তার বিরোধীতা করেছেন শাহজাহানের অপর তিন পুত্র দারাশিকো, মুরাদ আর শাহ সুজা। তাই তো আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়া তাদের। পরাজিত হয়ে মারা যান দারা শিকো আর মুরাদ। শাহ সুজা তখন বাংলার শাসনকর্তা, বর্তমান চাঁপাই-নবাবগঞ্জ সীমান্তের পাশেই মালদহের কাছাকাছি তার রাজধানী ছিল।

পদ্মাবতী কবিতা

আওরঙ্গজেব সুজাকে ধরার জন্যে বাহিনী পাঠালেন, সুজা প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমান ঢাকার ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে আরাকানে (বর্তমানে মায়ানমার) পাড়ি জমান। আরাকানে গিয়েও সুজা বাঁচতে পারেননি। সেখানকার রাজা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেন।১৬৫৯-৬০ সালে শাহ সুজা রোসাঙ্গে (আরাকান) আশ্রয়প্রার্থী হন এবং বিদ্রোহ করে সপরিবারে নিহত হন। এ বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আলাওল ৫০ দিন কারাভোগ করেন এবং আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে ভিক্ষা করে স্ত্রীপুত্রসহ প্রায় দশ বছর অতিবাহিত করেন। শেষ বয়সে আধ্যাত্মিক গুরু মসউদ শাহ্ তাঁকে ‘কাদেরী’ খিলাফত প্রদান করেন।

শাহ সুজা

মধ্যযুগের, কবিদের মধ্যে আলাওলই সবচাইতে বেশী বই রচনা করেন। তাঁর কাব্যসংখ্যা প্রায় সাত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-পদ্মাবর্তী, সপ্তপয়কর, সিকান্দরনামা, নীতিকাব্য তোহফা এবং সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য রাগতালনাম। এছাড়াও বৈষ্ণবপদের তাঁর কিছু গীতিকবিতা আছে। রাগতালনামা ও গীতিকবিতাগুলি তাঁর মৌলিক রচনা, অন্যগুলি অনুবাদমূলক। রাগতালনামা ও গীতিকবিতাসমূহ তাঁর প্রথম দিকের রচনা। তাঁর কাব্যগুলির মধ্যে পদ্মাবতী শ্রেষ্ঠ রচনা। নাগরিক শিক্ষা, বৈদগ্ধ্য ও অভিপ্রায় তাঁর কাব্যেও ভাব-ভাষা-রুচিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। দরবার-সংস্কৃতির সবদিকেই তাঁর রচনায় দেখতে পাওয়া য়ায়। তাঁর লেখায় কাব্যিক আবেগ বৌদ্ধিক চেতানার মিশ্রন দেখা যায়-এই কারণে তাঁকে ‘পন্ডিতকবি’ বলা হয়।