ছেলেবেলা থেকে আমার গড়ে উঠবার প্রতিটি ধাপে আমার অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করবার ক্ষেত্রে, আমার অনুধাবন ও উপলব্ধিকে গঠনমূলক রূপ প্রদানের ক্ষেত্রে এবং আমার স্বশিক্ষাকে পরিপূর্ণ করবার ক্ষেত্রে বেশ ক’জন ব্যক্তির অবদান রয়েছে। এই তালিকায় অবশ্যই আমার মা, বাবা, খালাসহ পরিবারের কয়েক জন তো অন্তর্ভুক্ত আছেনই, তবে পরিবারের বাইরেও একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম আমি এতে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। তিনি হলেন আমার আদর্শ, আমার শিক্ষিকা মিসেস কাজী আনোয়ারা মনসুর।
বিভিন্ন সময়ে এই কিংবদন্তী নারীকে আপনারা তার সন্তানদের লেখনীর মাধ্যমে জেনে থাকবেন নিশ্চয়ই। তবে আজ আমি মিসেস মনসুরকে একজন শিক্ষার্থীর চোখে দেখাতে এসেছি। এ কথা কারো অজানা নয়, ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ এর যাত্রাটা তার হাত দিয়েই শুরু। তবে এই যাত্রার পথটি কিন্তু মিসেস মনসুরের জন্য একদমই মসৃণ ছিলো না।
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক, শিক্ষক ও সমাজকর্মী শহিদুল আলম হলেন মিসেস মনসুরের একজন কৃতী সন্তান। মায়ের স্মৃতি নিয়ে লেখা তার ‘দ্য লাস্ট গুডবাই’ থেকে মিসেস মনসুরের জীবন-যুদ্ধ নিয়ে বেশ অনেকটাই জানা যায়। মাত্র ১৪ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ঢাকার আজিমপুরে ‘আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা এই নারীর স্নাতক পাসের গল্পটিও ছিলো এক লুকোচুরি। শাশুড়িকে না জানিয়ে স্বামী ও দেবরের সহায়তায় লুকিয়ে লুকিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা এই নারীর ছাত্রদের মাঝে স্বশিক্ষার উদগীরণ ঘটানোর আকাঙ্ক্ষাকে কোনো ভাবেই দমিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি।
‘আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন স্কুল’ থেকে এক সময় তার এই প্রতিষ্ঠানটি রূপ নেয় ‘অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়’-এ, যেটি আজকের ‘অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ’। আমিও এই প্রতিষ্ঠানেরই একজন গর্বিত ছাত্রী, যার জীবনে দীর্ঘ ৩০ বছর প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা মিসেস মনসুর অনুপেক্ষনীয় এক ছাপ রেখে গেছেন।
‘বড় আপা’ বলে ডাকতাম তাকে আমরা। এক অদ্ভূত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমাদের বড় আপা। আমাদের মাঝে কি করে যেনো অপরের শুভাকাঙ্ক্ষী হবার প্রবণতা তৈরী করে দিয়েছিলেন তিনি। তার জন্য কঠিন কিছুই যেনো ছিলো না। যে দিন যে শিক্ষক অনুপস্থিত থাকতেন, সেই শিক্ষকেরই পাঠের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতেন বড় আপা মিসেস মনসুর। নৃত্যের শিক্ষিকা অনুপস্থিত থাকলে নিজেই কোমরে শাড়ির আচল গুঁজে নাচতে শুরু করে দিতেন ক্লাসে।
দশ বছর আগে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছেড়ে আসা আমি যে দিন স্কুলের ৪৮ তম বার্ষিকীতে উপস্থিত হয়ে সাগ্রহে মাইক্রোফোনে কথা বলতে শুরু করলাম, সে দিনও বড় আপা ঠিকই আমায় চিনে ফেলেছিলেন। হঠাৎ ডেকে উঠলেন, “তুই সাঈদার বেটি না?” আমাদের বড় আপা ঠিক এমনই ছিলেন, স্নেহ-মাখা শাসনে পারদর্শী অপ্রত্যাশিত এবং প্রীতিজাগানিয়া নারী।
আমার মা যে দিন মারা গেলেন, সে দিন আমাদের বাড়িতে হঠাৎ বড় আপাকে দেখে অন্য রকম এক শক্তি পেয়েছিলাম। ওনাকে কম-বেশি সবাই চিনতেন। সবাই এসে ওনার সাথে কথা বলছিলেন, আর উনি আলতো হাতে সবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। কথা শেষ করে মা’র মাথার কাছে এসে বসে ব্যাগ থেকে কোরআন বের করে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বললেন, “সাঈদার বাচ্চাদেরকে একটু দেখি তো!” আমরা সবাই তার কাছে গেলাম। তিনি বললেন, “মায়ের জন্য একটু কোরআন খতম দিয়ে দিও”। কি অদ্ভূত মমতাময়ী! তার ছাত্রীরা তার কাছে আপন সন্তানের মতোই প্রিয় ছিলো।
শিক্ষক তো এমনই হতে হয়। দিনের প্রায় ৮ ঘন্টা সময় যার কাছে অতিবাহিত হয়, তিনিই তো পারেন জীবনের মূল্যবান এই সময়টাকে যত্ন করে গুছিয়ে দিতে। তবে সেই যোগ্যতা কিন্তু সবার থাকে না, আমাদের বড় আপার ছিলো। তার এই যোগ্যতাই আজ আমার স্মৃতিকে জীবন্ত করে তুলছে।
তাঁবুর নিচে ক্লাস করানোর মাধ্যমে অগ্রণী স্কুলের যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। একমাত্র তারই যোগ্যতায় বোর্ডে স্ট্যান্ড করবার দক্ষতা অর্জন করেছিলো আমাদের স্কুল। আমাদের স্কুল ঢাকার অন্যতম সেরা স্কুলে পরিণত হয়েছিলো। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নাটক, কবিতা আবৃত্তি -এমন কোনো বিষয় ছিলো না, যেখানে আমাদের স্কুল মেধা স্থান অর্জন করে নি। অন্ততপক্ষে আজকের দুনিয়ার ২০ জন সেলিব্রেটি ঘরানোর ব্যক্তি আমাদের স্কুলেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রজ্ঞা লাবণী থেকে শুরু করে তারানা হালিম -এদের প্রত্যেকেই ছিলেন অগ্রণী স্কুলের বিদ্যার্থী। হবেই বা না কেনো? একজন সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে তার সুপ্ত সত্ত্বাকে টেনে বের করে আনার শিল্প জানা ছিলো আমাদের বড় আপার এবং সফলভাবে তিনি নিজের ছাত্রীদের ভেতরে এই অন্তঃর্নিহিত সত্ত্বার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
বড় আপা নিজের এই শিল্পকে প্রকাশ্যে আনবার জন্য এক অভিনব কায়দায় আমাদের স্কুল পরিচালনা করতেন। একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সমগ্র স্কুলকে তিনি চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। না, শ্রেণীভিত্তিক ভাগ নয়, এ ছিলো দক্ষতাভিত্তিক ভাগ। প্রতিটি ক্লাস থেকে বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষার্থীকে তিনি নির্দিষ্ট শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কোনো দল ছিলো কবিতা আবৃত্তিতে পারদর্শী, কোনো দল মঞ্চ-নাটকে, কোনো দল গানে, আবার কোনো দল নাচে দক্ষ। ভিন্ন ভিন্ন ক্লাস ও বয়সের শিক্ষার্থীদের একই শ্রেণীভুক্ত করে তাদের মধ্যে এক উপভোগ্য প্রতিযোগিতা তৈরী করে দিতেন বড় আপা। ভিন্ন বয়সী একই কাতারের শিল্পী তৈরী করতে একেবারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনি যদি বড় আপার সাহচর্য্যে থাকতেন, তবে আপনার ভেতরের যে সুপ্ত প্রতিভার খোঁজ আপনি নিজেও কখনো জানতেন না, তার সাথে তিনি ঠিকই আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হতেন।
স্কুলে তার গঠনকৃত সেই বিশেষ চারটি দলের নেতৃত্ব দেয়া হতো সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষার্থীদেরকে। আস্তে আস্তে বাচ্চাগুলো বড় হতে হতে এমন ভাবে গড়ে উঠতো যে, সিনিয়ররাই জুনিয়রদেরকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং এর মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে সক্ষম হতো। বড় আপার এই স্ট্র্যাটেজির কারণে সম্পূর্ণ চাপটা কখনোই শিক্ষকদের ওপর গিয়ে পড়তো না।
প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট একটি দলের দক্ষতা আমরা দেখতে পেতাম। মাসের চার সপ্তাহে চারটি দলের ক্রিয়া-কলাপে আমাদেরকে বাধ্যতামূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হতো। পাঠ্যবইভিত্তিক পড়াশোনার চেয়ে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকেই বেশি মূল্যায়ন করতেন আমাদের বড় আপা।
বড় আপার স্কুলে কোনো শিক্ষকের ফাঁকিবাজি করে ছাড় পাবার কোনো উপায় ছিলো না। তিনি স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই শিক্ষকদের সম্পর্কে মন্তব্য, কিংবা নালিশ জমা নিতেন বেনামে। অন্য কারো হাতের লেখার মাধ্যমে নিজের মনের কথাটি লিখে নির্ভয়ে জমা দিয়ে আসতাম আমরা, যেনো কোনো প্রমাণ কেউ খুঁজে পেতে না পারে। এমন দলিলবিহীন নালিশের পরামর্শ আমাদেরকে খোদ বড় আপাই দিয়েছিলেন।
ঠিক এমন করেই অসংখ্য শিক্ষকও গড়ে তুলেছিলেন তিনি নিজের হাতে, যারা আজও আমাদের আদর্শ। এসব শিক্ষকের উপদেশ-বাণী শুনলে আজও সারা গায়ে শিহরণ বয়ে যায়।
সারাক্ষণ এর-ওর নালিশ এবং বিদ্রোহী আন্দোলনে দস্যুগিরি করে বেড়ানো এই আমাকেও বড় আপাই তৈরী করেছিলেন। কিছু হলেই স্কুল মাতিয়ে ফেলা আমাকে ডেকে যখন তিনি বলতেন, “এই গুণ্ডি, ক্লাসে যা!”, তখন সেই মৃদু তিরস্কারটিই মধুর বলে মনে হতো।
হঠাৎ একদিন ক্লাস থেকে আমাকে ও আমার খালাতো বোনকে বড় আপার রুমে ডেকে নেয়া হলো। যখন জানতে পারলাম আমার ডিপিআই খালা এসেছেন বলেই বড় আপা আমাদেরকে তলব করেছেন, তখনও মুগ্ধ হয়েছিলেম। আমরা প্রত্যেকেই বড় আপার পরিবার ছিলাম, শুধু স্কুলের ছাত্রী নয়। আমাদের সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। আমরা বড় আপার শাসনও পেয়েছি, আবার তার বাসার চা-রুটিও খেয়েছি। আমার বাবা আশরাফ সিদ্দিকী সে সময় বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হওয়ার সুবাদে আমিও বড় আপার লাইব্রেরীটা বাংলা একাডেমীর সৌজন্যে অসংখ্য বই দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলাম। কি এক আবেগ যে কাজ করতো বড় আপার প্রতি, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অসুস্থ হয়ে গেলে বড় আপার খোঁজ নেয়া এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আরো যত্নবান হতে উৎসাহিত করা –এ সব কিছুই যেনো আমার আবেগকে প্রতিনিয়ত তার প্রতি নতুন ভাবে তৈরী করেছে।
সারা জীবন বাম দিকে লুঙ্গির মতো কুচি করে সুতির শাড়ি ও এক জোড়া পাম্প শু পরে জাদু ছড়িয়ে বেড়ানো এই মহীয়সী নারীই ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। বেগম রোকেয়ার আদর্শে বড় হওয়া মিসেস মনসুরের মতো নারীরাই আমাদেরকে সমাজসেবা ও মানবসেবার পথে উদ্বুদ্ধ করেছে।
আজ আমার স্কুলের বাচ্চাদের সাথে আমিও গান গাইতে কিংবা নাচতে শুরু করে দেই হঠাৎ হঠাৎ। এই বাচ্চাগুলো অবাক চোখে যখন মুগ্ধতা নিয়ে আমার পানে চেয়ে থাকে, তখন আমার মনে পড়ে যায় বড় আপার কথা। তার কাছ থেকেই তো শিখেছি কি করে শিক্ষা দিতে হয়, কি করে নিজের পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে ছাত্রদের উৎসাহিত করতে হয়। বড় আপা যেমনটা ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ গড়ার কারিগর, আমিও ঠিক তেমনটাই হতে চেয়েছি সব সময়।