১০৯৬ সালে কোন রকমের প্রশিক্ষণ ছাড়াই সাধারণ জনগণকে নিয়ে সংগঠিত পিটারের “জনগণের ক্রুসেড” ব্যর্থ হলে (পড়ুন: ক্রুসেড – ১ম পর্ব), ইউরোপের গীর্জা, কাউন্ট, ডিউক, এবং ব্যারনদের নেতৃত্বে গঠিত হলো সুসজ্জিত “প্রথম ক্রুসেড”। এই “প্রথম ক্রুসেডে” যে সব অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তি (কাউন্ট, ডিউক, ব্যারন) যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল টুলুজের চতুর্থ রেমন্ড (Raymond IV of Toulouse), বুইলনের গডফ্রে (Godfrey de Bouillon) এবং তার ভাই বোলূনের বাল্ডউইন (Baldwin of Boulogne), টারান্টোর বোহেমন্ড (Bohemond of Taranto) এবং তার ভাগ্নে ট্যানক্রেডের (Tancred) নেতৃত্বে ইতালী-নর্মান বাহিনীর পাশাপাশি রবার্ট কার্থোজ (Robert II of Normandy), ব্লোইসের স্টিফেন (Stephen of Blois), ভার্মান্ডোইসের হিউ (Hugh of Vermandois ) এবং ফ্ল্যান্ডার্সের দ্বিতীয় রবার্টের (Robert II of Flanders) অধীনে উত্তর ফরাসি এবং ফ্লেমিশ বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন সশস্ত্র দল। মোট ক্রুসেডারের সংখ্যা তখন দাঁড়ায় আনুমানিক এক লক্ষ। অভিজাত শ্রেণীর নেতৃত্বে এই বিশাল বাহিনী অগ্রসর হতে থাকে কনস্টান্টিনোপলের (আজকের ইস্তানবুল) দিকে।
১০৯৬ সালের শেষ দিকে প্রথম ক্রুসেডের সৈন্যরা বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে পৌঁছুতে শুরু করে। ভার্মান্ডোইসের হিউ প্রথমে কনস্টান্টিনপোলে পৌঁছায় নভেম্বর মাসে। তারপর বুইলনের গডফ্রে তার ক্রুসেডার নিয়ে আসে ডিসেম্বরের বড়দিনের সময়। ১০৯৭ সালের মে মাসে নর্মান্ডির রবার্ট এবং ব্লোইসের স্টিফেনের নেতৃত্বে ক্রুসেডের শেষ অংশটি বাইজেন্টাইন রাজধানীতে এসে পৌঁছায়। ততদিনে টারান্টোর বোহেমন্ড, ফ্ল্যান্ডার্সের দ্বিতীয় রবার্ট এবং টুলুসের চতুর্থ রেমন্ড ইতিমধ্যেই তাদের ক্রুসেড বাহিনী নিয়ে বসবরাস নদী অতিক্রম করে কনস্টান্টিনপোলে অবস্থান করছে। এদিকে বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেক্সিয়াস কোমনেনোস (Alexios I Komnenos) প্রায় ছয় মাস ধরে বিশেষভাবে চিন্তিত কি করে কনস্টান্টিনপোলে অবস্থানরত ক্রুসেডের অহংকারী অভিজাত শ্রেণীর নেতাদের এবং তাদের অবাধ্য সৈন্যদেরকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন। তিনি দু’টো অঙ্গীকার নেন ক্রুসেডার নেতাদের কাছ থেকে। প্রথমতঃ ক্রুসেডাররা বাইজেন্টাইন সম্রাটের প্রতি থাকবে সব সময় অনুগত; এবং দ্বিতীয়তঃ তারা যেসব বাইজেন্টাইনদের হারানো অঞ্চল তুর্কী সেলজুকদের (Seljuk) কাছ থেকে পুনোরুদ্ধার করবে, তা’ ফিরিয়ে দিবে বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেক্সিয়াসকে। ক্রুসেডার নেতারা শর্তগুলো মেনে নেয় বিনাশর্তে।
সম্রাট আলেক্সিয়াস ক্রুসেডারদেরকে ১০৯৭ সালের বসন্ত কালের আগে এশিয়া মাইনরে যেতে বারণ করেন। বাইজেন্টাইনরা ভালো করেই জানতো, শীতকালের এশিয়া মাইনরের বৈরী আবহাওয়া কতো বিপদজনক হতে পারে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডারদের জন্য। তিনি ক্রুসেডারদেরকে প্রথমে তুর্কী সেলজুক শহর Nicaea আক্রমণ করতে পরামর্শ দেন। তুর্কী সেলজুকরা ১০৯৬ সালের সিভেটোর যুদ্ধে (Battle of Civetot) পিটারের “জনগণের ক্রুসেড” দলটিকে পরাজিত করে এতোটাই উচ্ছ্বসিত এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল যে, তারা Nicaea শহরটিকে অরক্ষিত রেখেই চলে যায়। এই সুযোগে ক্রুসেডাররা ১০৯৭ সালের মে-জুন মাসে সেলজুক সৈন্যদের পোশাক পরে বসবরাস নদী অতিক্রম করে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে। অতি সহজেই তারা দখল করে ফেলে সেলজুক শহর Nicaea। অঙ্গীকার অনুযায়ী তারা শহরটি ফিরিয়ে দেয়া হয় বাজেন্টাইনদের কাছে।
ক্রুসেডার মূল সেনাবাহিনী ১০৮৪ সাল থেকে মুসলিম নিয়ন্ত্রণে থাকা সাবেক বাইজেন্টাইন শহর অ্যান্টিওকের (Antioch) দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু বাল্ডউইন অ্যান্টিওকের দিনে না যেয়ে তার দল নিয়ে এডেসা (Edessa) শহরে প্রবেশ করে। শহরটি ছিল জেরুসালেম যাবার পথ থেকে অনেক পূর্বে। এডেসার তখন শাসনকর্তা ছিল সনাতন গ্রীক অর্থোডক্স খ্রীষ্টান টরোস (Toros)। ব্যাল্ডউইনের উদেশ্য ছিল তার একান্ত নিজের শাসনের জন্য সেলজুকদের একটি এলাকা দখল করা। টরোস অত্যন্ত ভীত হয়ে বাল্ডউইনকে আপ্যায়ন করে তার রাজ্যে, এবং অঙ্গীকার করে সে বাল্ডউইনকে তার উত্তরাধিকার নিযুক্ত করবে। তার মৃত্যূর পর বাল্ডউইনই হবে এডেসার শাসনকর্তা। কিন্তু বাল্ডউইন মনে মনে এতে সন্তুষ্ট হতে পারে নি, এবং টরোসের মৃত্যূ পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য্যও তার ছিল না। এই সময়ে শহরে শুরু হয় এক জন-অসন্তোষ। সেই অসন্তোষে টরোস হয় নিহত। অনেকের ধারণা, ব্যাল্ডউইনই ছিল ঐ অসন্তোষ এবং টরোসের মৃত্যূর পরিকল্পনাকারী। বাল্ডউইন শহরটি দখলে করে নিজেকে এডেসার শাসনকর্তা ঘোষণা করে। এডেসা ছিল ক্রুসেডারশাসিত প্রথম এলাকা। এর আগে ক্রুসেডরা কোন অঞ্চল শাসন করে নি।
এদিকে ক্রুসেডাররা ১০৯৭ সালের অক্টোবরে অ্যান্টিওক অবরোধ শুরু করে। আন্টিওকের সেলজুক গভর্নর ইয়াগহি-সাইয়ান (Yaghi-Siyan) আট মাস এই অবরোধে বসে থেকে ক্রুসেডারদেরকে এক চরম দুর্দশাগ্রস্থ অচলাবস্থায় নিয়ে যায়। খাদ্যের অভাবে অনেক ক্রুসেডারের মৃত্যু হয়। অনেকে আবার কোন রকমে বেঁচে ছিল শুধুমাত্র বন্য গাছের পাতা খেয়ে। ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঐ কঠিন সময়ে ক্রুসেডাররা তাদের বীরত্ব দেখিয়েছে অসীম, এবং সংকল্পেও তারা ছিল অটুট। ক্রুসেডারের নেতা বোহেমন্ড, রেমন্ড এবং গডফ্রে প্রত্যেকেই অবরোধকারী এক একটি ক্রুসেড দলের সার্বিক দায়িত্বে ছিল।
ক্রুসেডারদের অবরোধের সার্বিক পরিস্থিতি যখন খুবই নাজুক, শহরের নাইরোজ নামের এক আর্মেনীয় প্রহরীকে বোহেমন্ড উৎকোচ দিয়ে শহরের গেট খুলতে রাজী করায়। নাইরোজ ছিল খ্রীষ্টান থেকে ধর্মান্তরিত এক আর্মেনীয় মুসলমান। রাতের অন্ধকারে নাইরোজ দূর্গের উপর থেকে দড়ির মই ফেলে দূর্গের প্রাচীর ঘেঁষে। পূর্ব-পরিকল্পনানুযায়ী সেখানে অপেক্ষমান ক্রুসেডাররা চুপিচুপি সেই মই বেয়ে দূর্গে প্রবেশ করে দূর্গের ফটক দেয় খুলে। দূর্গে ঢুকে পড়ে বাকী ক্রুসেডার সৈন্যরা।
১০৯৭ সালের ২ জুন ক্রুসেডাররা শহরে প্রবেশ করে নির্বিচারে প্রায় সব মুসলমান বাসিন্দাদের হত্যার পাশাপাশি তারা বিভ্রান্ত হয়ে প্রচুর গ্রীক, সিরিয়ান,এবং আর্মেনীয়ান খ্রীষ্টানকেও হত্যা করে। এই সময় অ্যান্টিওকের গভর্নর ইয়াগহি-সাইয়ান কবুতরের মাধ্যমে সাহায্য চেয়ে সংবাদ পাঠায় ইরাকের মসুলের শাসনকর্তা সেলজুক আতাবেগ কেরবোঘার (Kerbogha) কাছে। ১০৯৮ সালের ৫ই জুন কেরবোঘা শহরটি পুনরুদ্ধারের এ বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে ক্রুসেডারদেরকে আন্টিওক দূর্গের ভেতরে অবরোধ করে ফেলে। অবরোধটি এতোই কার্যকরী ছিল যে, ক্রুসেডাররা কিছুদিনের মধ্যেই এক মারাত্মক দূর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়, কারণ বাহির থেকে দূর্গে খাদ্য সরবরাহ পুরোপুরিই বন্ধ করে দেয় কেরবোঘার বাহিনী।
যখন ক্রুসেডাররা নিশ্চিত পরাজয়ের পথে, তখন তারা অপেক্ষায় ছিল কোন এক অলৌকিক ঘটনার। ঘটলোও তাই। এক পাদ্রী এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে একটি ক্রস রেখে আসলো। তারপর সে ক্রুসেডারদেরকে জানালো, স্বপ্নে যীশু এসে তাকে বলেছে, যে ক্রস দিয়ে যীশুকে হত্যা করা হয়েছে, তা’ নিকটবর্তী একটি জায়গায় মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পাদ্রী তার লুকিয়ে রেখে আসা ক্রুসের জায়গাটির ঠিকানাও দিয়ে দিলো তাদেরকে। তার কথামতো ক্রুসেডাররা সেখান থেকে উদ্ধার করে আনে পাদ্রীর লুকানো সেই ক্রস। তারা বুঝতেও পারলো না যে, এটি ছিল পাদ্রীর সাজানো ঘটনা। এই ঘটনায় সাংঘাতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রুসেডাররা আন্টিওকের দূর্গ থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে, দূর্গের বাহিরে অবরোধকারী কেরবোঘার মুসলমান সৈন্যরা হয়ে পরে অসহিষ্ণু। কেরবোঘারের সাথে মনমালিন্য হওয়ায় কয়েকজন সেনাপ্রধান অবরোধ ত্যাগ করে। কেরবোঘারের সৈন্যবাহিনী হয়ে পড়ে অসহিষ্ণু এবং শৃঙ্খলাহীন।
২৮শে জুন ক্রুসেডাররা এই সুযোগে অনেক ঝুঁকি নিয়ে আচমকা দূর্গ থেকে বের হয়ে কেরবোঘার অপ্রস্তুত এবং অসংগঠিত সৈন্যদের আক্রমণ করে বসে। ক্রুসেডারদের এই অতর্কিত আক্রমণে কেরবোঘারের সৈন্যরা হকচকিয়ে গিয়ে পালিয়ে যায়। ক্রুসেডারদের হয় অপ্রত্যাশিত জয়। এই জয়টি তাদের জন্য তখন ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ক্রুসেডাররা যদি দূর্গে বসে থাকতো, নিশ্চিত তাদের হতো মৃত্যূ। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত পুরো ক্রুসেড বাহিনী।
আন্টিওক জয় করলেও প্রতিজ্ঞামতো ক্রুসেডাররা শহরটিকে বাইজেন্টাইনদের কাছে ফিরিয়ে দিলো না। ১০৯৮ সালের বাকী ছয় মাস তারা আন্টিওকেই ছিল। নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনার পর শহরটির শাসনভার দেয়া হলো টারান্টোর বোহেমন্ডকে। ক্রুসেডারদের অ্যান্টিওক অভিযানটির প্রধান বৈশিষ্টগুলো ছিল: বিশ্বাসঘাতকতা, গণহত্যা এবং বীরত্বের একটি প্যাটার্ন, যা ভবিষ্যতের সংঘর্ষগুলোর উপর ফেলেছিলো অনেক প্রভাব। অ্যান্টিওক দখল করে ক্রুসেডাররা তাদের পশ্চিমে নির্বাধায় রসদ এবং শক্তিবৃদ্ধির সরবরাহের পথটি করেছিল সুরক্ষিত।
১০৯৯ সালের জানুয়ারী মাসে ক্রুসেড বাহিনী চললো তাদের মূল লক্ষ্যে: জেরুসালেম। যাত্রাপথ ছিল লেভানটিন উপকূল (Levantine Coast)। ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের অংশকে বলা হয় লেভান্ট বেসিন বা লেভানটিন সাগর, যা’র উত্তরে তুর্কী, দক্ষিণে মিশর, পূর্বে সিরিয়া, লেবানন, এবং প্যালেস্টাইন (ছবিতে দেখুন)। লেভানটিন উপকূলটি ক্রুসডারদের তুর্কীর অ্যান্টিওক থেকে সিরিয়া, লেবানন হয়ে সোজা নিয়ে যাবে জেরুসালেম। এই উপকূলে কোথাও তাদের তেমন কোন বড় রকমের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয় নি। বরং ক্রুসেডারদের ভয়ে সাধারণ মানুষ যাত্রাপথে তাদেরকে করেছে অনেক সহায়তা। পথে ক্রুসেডাররা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের ছোটছোট শহর এবং গড়ে তুলেছে তাদের ক্রুসেড রাজ্য। ১০৯৯ সালের জুন মাসে অনেক চরাই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে ইউরোপের ক্রুসেড উপনীত হলো জেরুসালেমের দ্বারপ্রান্তে। শহরটিকে ক্রুসেডরা অবরোধ করে রাখে পাঁচ সপ্তাহ। শহরটি তখন ছিল শিয়া মুসলমান ফাতেমীয়দের অধীনে। ফাতেমীয়রা ২৭ বছর পর তুর্কী সেলজুকদের কাছ থেকে জেরুসালেম পুনর্দখল করে নেয় মাত্র এক বছর আগে, ১০৯৮ সালে। ফাতেমীয়দের সাথে সেলজুকের যুদ্ধে শহরটির প্রতিরক্ষা দেয়ালগুলো হয়ে পড়েছিল দূর্বল।
ক্রুসেডাররা শহরটিতে প্রবেশ করেই চালায় নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ। ১০৯৯ সালের জুলাই মাসে জেরুসালেমের বেশীরভাগ মুসলমান এবং ইহুদিকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে। এ হত্যাযজ্ঞে খ্রীষ্টানরাও রক্ষা পায় নি, কারণ জেরুসালেমের সব সম্প্রদায়ের মানুষ (ফিলিস্তিনি) দেখতে এবং পোশাকে ছিল প্রায় একই রকম। ক্রুসেডাররা প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে খ্রীষ্টানদের চিনতে ব্যর্থ হয়। এ নির্মমতা চলে দশ দিন। উদ্দেশ্য, জেরুসালেম থেকে ফিলিস্তানি মুসলমান, প্রাচ্যের খ্রীষ্টান (Eastern Christians) এবং ইহুদিদের সম্পূর্ণভাবে উৎখ্যাত করা। এ মর্মে গেস্টা ফ্রানকোরামের (Gesta Francorum) প্রত্যক্ষদর্শী এক লেখক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে গেছেন যে, আল-আকসার আশেপাশের এলাকা ইহুদি এবং মুসলমানদের রক্তে ক্রুসেডারদের পায়ের গোঁড়ালি পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিলো। বলা হয়ে থাকে, নিহতদের মাথার খুলি দেয়ালের ইটের মতো একটির উপর অন্যটি সারি বেঁধে রাখলে, দেয়ালটির দৈর্ঘ্য হতো জেরুসালেমের প্রাচীরের চেয়েও দীর্ঘ। অনেক ইউরোপিয়ান ইতিহাসবিদের মতে, ঐ সময় ক্রুসেডাররা জেরুসালেমে কমপক্ষে এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। যারা ভাগ্যগুনে বেঁচে ছিল, সে সব মুসলমান, প্রাচ্যের খ্রীষ্টান এবং ইহুদিদের জোর করে বের করে দেয়া হয় শহর থেকে। ধ্বংস করা হয় মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো। আল-আক্বসা মসজিদকে রূপান্তরিত করা হয় পশুর আস্তাবলে।
ইউরোপ থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা শুরু হলো ইউরোপিয়ান অধিবাসী। জেরুসালেমের নিহত মুসলমান, ইহুদি এবং প্রাচ্যের খ্রীষ্টানদের পরিত্যাক্ত বসতবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এসব ইউরোপিয়ান অভিবাসীদের বরাদ্দ দেয়া হলো বিনামূল্যে। ক্রুসেডারদের এই অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন রোপন করলো ঐ অঞ্চলে ভবিষ্যতের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং দীর্ঘ বিরোধের বীজ।
প্রথম ক্রুসেডের জেরুসালেম জয় ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমতঃ এই বিজয়টি ছিল ইউরোপিয়ান ধর্মীয় লক্ষ্য এবং রাজনৈতিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন। দ্বিতীয়তঃ ক্রুসেডারদের এই জয়কে দেখা হয় মুসলমানদের অন্তর্কলহের এক শাস্তি হিসেবে। ইসলাম ধর্মের মূল দর্শন এবং জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনার জন্য তখন এই শাস্তি ছিল মুসলমানদের প্রাপ্য। প্রথম ক্রুসেড আপাতঃ দৃষ্টিতে সফল মনে হলেও, এটি ছিল জেরুসালেমকে ঘিরে সুদীর্ঘ এক তিক্ত সংগ্রামের নাটকীয় সূচনা মাত্র। এ লগ্ন থেকে শুরু হলো মুসলিম পুনরুজ্জীবনের উপাখ্যান এবং অধিকৃত প্রাচ্যে ক্রুসেডারদের টিকে থাকার কঠিন সংগ্রাম। আগামী দু’শো বছর লুন্ঠিত নগরীকে ফিরে পাবার এক নিরন্তর সংগ্রামের ভিত্তি রচিত হলো এখান থেকেই।