ভারতবর্ষের রেওয়াহ প্রদেশ। এক বিশাল রাজকীয় অনুষ্ঠান চলমান। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে গানের আসরের জন্য। কিন্তু গায়িকা জনসমক্ষে আসতে রাজি নন। সাফ জানিয়ে দিলেন যে, ঘোমটার আড়াল থেকে গান গাইবেন তিনি। রেওয়াহ প্রদেশের মহারাজা প্রথমে অপমানিত বোধ করলেন এবং রাগান্বিত হলেন। একজন সামান্য গায়িকার আবার মানুষের সামনে আসতে সমস্যা কি! গায়িকা কিন্তু তখনও অনড় তার সিদ্ধান্তে। জানালেন, তাকে দেয়া মুদ্রা ফেরত দিয়ে তিনি এই অনুষ্ঠান ত্যাগ করতেও রাজি আছেন, তবুও জনসমক্ষে গান তিনি গাইবেন না। মহারাজার বেশ কৌতূহল হলো। তিনি জানতে চাইলেন গায়িকার পরিচয়। জবাব আসলো, গায়িকার পরিচয় হলো, তিনি এলাহাবাদের ময়ূরকন্ঠী জানকী বাই।
সুখ্যাত গায়িকা জানকী বাইয়ের পরিচয় শুনে মহারাজা ঘোমটার আড়াল থেকেই তার গান শুনতে সম্মত হলেন। গান ধরলেন জানকী বাই। তার সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে বিমোহিত হলেন মহারাজাসহ আসরের সবাই। বিমুগ্ধ মহারাজা জানকী বাইয়ের সাথে আলাপ করতে চাইলেন, জানতে চাইলেন তার জনসমক্ষে না আসার কারণ। জানকী বাই জানালেন, তার আরেকটি পরিচয় হলো ‘ছাপ্পান ছুরিওয়ালি’। চেহারায় ৫৬টি ছুরিকাঘাতের দাগ রয়েছে তার। এই দাগ নিয়ে জনসাধারণের সামনে আসতে তিনি সম্মত নন। সব শুনে রেওয়াহ এর মহারাজা জানকী বাইকে বললেন, তার গায়কী ও সুরেলা কন্ঠস্বর তার চেহারার যে কোনো ক্ষতকে ছাপিয়ে যেতে সক্ষম। তিনি জানকী বাইকে মূল্যবান উপহার দিয়ে সম্মানিত করলেন।
১৮৮০ সালে জন্ম জানকীর। তবে জানকী থেকে জানকী বাই হয়ে ওঠার গল্পটি মসৃণ নয়। মা, বাবা, ভাই ও বোন নিয়ে সুখের সংসারে সচ্ছলভাবেই দিন কাটছিলো জানকীর। ছেলেবেলা থেকেই তার ছিলো সঙ্গীতচর্চার প্রতি প্রবল আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকেই কিছু দিন তালিম নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো কিশোরী জানকীর। তবে জানকীদের সুখের সংসারে কাল হয়ে এসেছিলো এক নারী, যার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলে এনেছিলেন জানকীর বাবা শিব বালক রাম।
কিছু দিন যেতেই জানকীর সৎ মার পরকীয়া শুরু হয় এক পুলিশ কনস্টেবলের সাথে। বাবা-মার অনুপস্থিতিতে একদিন জানকী তাদের দুজনকে আপত্তিকর পরিস্থিতিতে দেখে ফেললে তার মুখ চিরতরে বন্ধ করার জন্য সেই পুলিশ কনস্টেবল সুযোগ মতো এক দিন জানকীকে ৫৬ বার ছুরি দিয়ে আঘাত করে। সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও এই আঘাতের দাগ জানকীকে বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। সেই থেকেই গানের পাখি জানকী হয়ে যায় ‘ছাপ্পান ছুরিওয়ালি’।
ছাপ্পান ছুরিওয়ালি জানকীর জীবনে এর পর সূচনা হয় আরেকটি অধ্যায়ের। এই ঘটনার পর জানকীর সৎ মা পালিয়ে যায় এবং জানকীর বাবাও নিখোঁজ হয়ে যায়। তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়া জানকীর মা মানকির জায়গা হয় পতিতালয়ে। মানকির জন্য এই পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন হলেও জানকী পেয়ে যায় এক নতুন জীবন, যে জীবনে তার সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গীতই হয়ে ওঠে তার একমাত্র গন্তব্য। নতুন এই যাত্রাপথেই জানকী থেকে তিনি হয়ে ওঠেন জানকী বাই।
এলাহাবাদের নিষিদ্ধ পল্লীতে আগমনের পর জানকীর সৌভাগ্য হয় লখনৌ ও গোয়ালিয়রের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ হাসসু খানের সংস্পর্শে আসার। ধীরে ধীরে ইংরেজি, উর্দু, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন জানকী বাই।
মনোমুগ্ধকর কণ্ঠস্বর দিয়ে গানের আসরগুলো জমিয়ে তুলতে শুরু করলেন জানকী বাই। নাকি কন্ঠের পরিবর্তে অকৃত্রিম কণ্ঠের ব্যবহারে গানের সুরকে অত্যন্ত যত্ন করে ধরে রাখার ব্যাপারটিই জানকী বাইকে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিলো।
গ্রামোফোন কোম্পানির ইতিহাসে জানকী বাই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। ১৯১১ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত গ্রামোফোন কোম্পানি জানকী বাইয়ের অসংখ্য গান রেকর্ড করেছিলো। তবে গ্রামোফোনে তার গান প্রথম বার রেকর্ড হয় ১৯০৭ সালে। প্রথম রেকর্ডের ২২টি গান বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করায় পরের বছর আরো ২৪টি গান রেকর্ড করা হয়। প্রথম দিকে জানকী বাইকে পারিশ্রমিক দেয়া হয় ৯০০ টাকা। পরবর্তীতে ১৯১০ সালে এই পারিশ্রমিক পরিণত হয় ১৮০০ টাকায়, যা প্রথম পারিশ্রমিকের দ্বিগুণ। গানের শেষে দীপ্ত কণ্ঠে জানকী বাই বলতেন, ‘মাই নেইম ইজ জানকী বাই এলাহাবাদী’।
সে সময়ের আরেকজন আলোচিত ও বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন গওহর জান। প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের বদলে গওহর জানের সঙ্গে এক আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জানকী বাইয়ের। ১৯১১ সালে তৎকালীন বিখ্যাত এই দুই নারী এক সঙ্গে দিল্লি দরবারে আয়োজিত সম্রাট পঞ্চম জর্জের আগমনী অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মাতিয়ে তুলেছিলেন সবাইকে।
উর্দু ভাষায় কবিতা লিখেও জানকী বাই বিপুল সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার উর্দু ভাষার এসব কবিতা নিয়ে সংকলিত হয়েছিলো ‘দিওয়ান-ই-জানকী’ নামের একটি কাব্যগ্রন্থ।
এলাহাবাদের আইনজীবী আব্দুল হকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো জানকী বাইয়ের। তার এই সংসার দীর্ঘস্থায়ী না হলেও পরবর্তী জীবনটা তিনি একজন দানশীল নারী হিসেবে অতিবাহিত করেছেন। গরীব-দুঃখী মানুষ, মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থী, মসজিদ, মন্দির সব খানে দান করেছেন তিনি। তার গড়ে তোলা ‘জানকী ট্রাস্ট’ আজও কাজ করে যাচ্ছে পুরোদমে।
মাত্র ৯০০ টাকা পারিশ্রমিক থেকে শুরু করে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলো তার সম্মানী। ১৯৩৪ সালে মারা যান কিংবদন্তি গায়িকা জানকী বাই। তার এক শিষ্যের উদ্যোগে এলাহাবাদ কবরস্থানে কবর দেয়া হয় তাকে।
কথিত আছে, ছেলেবেলায় তিনি বারাণসীতে যেখানে থাকতেন, সেখানকার একটি কুয়ার পানি পান করেই তার কণ্ঠস্বরে এত মিষ্টতা এসেছে। বর্তমানে কুয়াটি পানি-শুন্য। যদিও এ ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে একটি কাল্পনিক ধারণা হবারই সম্ভাবনা বেশি, তবে আজও নাকি তার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে তার সুরেলা কণ্ঠের গান ভেসে আসে লোকেদের কানে। হয়তো এ কোনো বিভ্রম, কিংবা শিল্পীর প্রতি ভক্তদের অগাধ ভালোবাসারই প্রতিফলন। হয়তো আধুনিক এই প্রজন্মের গায়িকা হলে জানকী বাইকে আমরা তার প্রাপ্য যথার্থ সম্মানের স্থানে নিয়ে যেতে পারতাম। উপমহাদেশের এই কিংবদন্তি নারীরা আমাদের সকলের গর্ব।
রেফারেন্স: