সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি
সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।।
দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি
সেই দেশ লব যুঝিয়া।।
সেই ‘জনমপথিক’ মানবগোষ্ঠীর কথা ভেবেই যেন বিশ্বপথিক রবিকবির কলম থেকে বেরিয়েছিল এমন বিশ্ববীক্ষা।
প্রকৃতই জনমপথিক জনগোষ্ঠী, জিপসী, আসল নাম রোমানি। মূলতঃ যাযাবর সম্প্রদায়, বাস বিশ্ব জুড়েই। তবে বলকান উপদ্বীপে সবচেয়ে বেশি, তারপর মধ্য ইউরোপে। আজকের স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া, ইউক্রেন ও পূর্ব ইউরোপের জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ রোমানি।
মনে করা হয়, ষষ্ঠ শতক থেকে একাদশ শতকের মধ্যেকার কোনো এক টালমাটাল সময়ে নিজেদের ‘দেশ’ উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা অঞ্চল ছেড়ে বরাবরের মতো অজানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল একদল ‘বিশ্বপথিক’ মানুষ।
কি কারণে এই অদ্ভুত অভিপ্রয়াণ তা ঠিক ঠিক জানা না গেলেও অনেকেই মনে করেন মোহাম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণ অথবা এ ধরণের অন্য কোনো গোলযোগে বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়েছিল তারা।
একাদশ শতকের প্রখ্যাত পারসিক লেখক ফিরদৌসির ‘শাহনামা’তে এক মজার গল্প পাই:
“পারস্যের সাসানীয় সম্রাট বাহারাম গর (421—439 সাধারন অব্দ) নিজে একজন সঙ্গীত প্রিয় মানুষ ছিলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল, সমস্ত মানুষই আসলে সঙ্গীতের সমঝদার, কিন্তু গরিব মানুষেরা শুধুমাত্র তাদের দারিদ্রের কারণে সঙ্গীত সুধা থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। তাই তিনি সঙ্গীতের ধাত্রীভূমি ভারতের সম্রাটকে অনুরোধ করেন, দশ হাজার বাঁশি বাদক ও সঙ্গীত শিল্পীকে পারস্যে পাঠাতে। ভারত সম্রাট পারস্য নরেশের অনুরোধ রক্ষা করতে সত্যি সত্যিই দশ হাজার গায়ক বাদককে পারস্যে পাঠান! সম্রাট বাহারাম গর খুশিমনে প্রত্যেক শিল্পীকে একটি করে ষাঁড় ও গাধা এবং একবস্তা করে দানাশস্য দেন, যাতে এরা চাষাবাদ করে নিজেদের ভরণ-পোষণ করতে পারে। পরিবর্তে এই শিল্পীদের কাজ হবে রাজ্যময় ঘুরে ঘুরে দরিদ্র পারসিকদের গান শোনানো! কিন্তু বছর না ঘুরতেই দেখা গেল, মানুষগুলো চাষাবাদ তো করেই নি, বরং প্রাপ্ত শস্য ও মাংস খেয়ে ফেলেছে। বাহারাম গর প্রচন্ড রেগে গিয়ে প্রত্যেককে গাধার পিঠে চাপিয়ে পারসিক সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকে তাড়িয়ে দিলেন।“
চতুর্দশ শতকে ইউরোপের মাটিতে একদল যাযাবর কে দেখা গেল, যারা ইজিপ্ট থেকে এসেছে এবং বহু বছর আগে ছোট্ট যীশুকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে মিশরের সুলতান নাকি তাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন! খ্রিস্টান ইউরোপে খাতির যত্নের অভাব হলো না, এদের নামকরণ হলো জিপসী। ইজিপসিয়ান থেকে জিপসিয়ান, সেখান থেকে জিপসী। কিন্তু এই মানুষগুলো তো আর মিশরীয় নয়, তাই এরা নিজেদের জিপসী না বলে রোমানি বলতো, আর সংক্ষেপে রোমা।
রোমানিরা নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে আসার সময় অন্য যেকোনো জাতির মতো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকগান এবং একান্ত নিজস্ব দক্ষতা। সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে, হারিয়েছে নিজেদের ভাষা, কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টায় বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। রোমানি কালচার।
রোমানি সংস্কৃতির এক বিশেষ দিক হলো ‘হাত দেখা’। তাই ইউরোপ জুড়ে রোমানিরা ভবিষ্যৎ বক্তা বা গণতকার রূপে পরিচিতি পায়। এছাড়াও টুকিটাকি হস্তশিল্প, নিজস্ব লোকসঙ্গীত, ভেষজচর্চা ছিল এদের জীবিকা নির্বাহের উপায়।
ইউরোপে রোমা উপস্থিতি সম্বন্ধিত প্রথম লেখা পাওয়া যাচ্ছে 1322 সালে। এসময় আয়ারল্যান্ড থেকে জেরুজালেম যাওয়ার পথে সাইমন সেমিওনিস নামে এক তীর্থযাত্রী ক্রেট অঞ্চলের ক্যানডিয়া শহরে এদের দেখেন।
1350 সালে স্যাক্সোনির লুদলফ এদের ম্যান্ডাপোলস বা ভবিষ্যৎ বক্তা রূপে উল্লেখ করেন।
ইউরোপে ‘ছোট্ট যীশুর রক্ষাকর্তা’ জাতি জিপসীদের প্রাথমিক আপ্যায়নটুকু ভালো হলেও পরবর্তীকালে চরম লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। 1385 সালেই ওয়ালাচিয়াতে রোমানি ক্রীতদাস কেনাবেচার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সময়ে সময়ে এদের বহিষ্কারের নির্দেশ এসেছে। 1510 সালে সুইজারল্যান্ডে, 1554 সালে ইংল্যান্ডে, 1589 সালে ডেনমার্কে রোমানিদের দেখতে পাওয়া মাত্রই হত্যার রাজকীয় আদেশনামা বেরোয়, আর ক্রীতদাস বা ভুমিদাস হিসেবে চালান দেওয়া তো এদের বিধিলিপি হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যযুগের নির্মমতার মাঝে একমাত্র ভালো খবর আসছে 1595 সালে, স্টেফান রাজভান নামে এক রোমানি ক্রীতদাস মুক্তিলাভ করে মোলডাভিয়ার Voivode বা যুবরাজ হচ্ছেন! গোড়া থেকেই পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি রোমাদের প্রতি বেশি সহনশীল হওয়ায় রোমা বসতি পূর্বের দেশগুলিতে বেশি দেখা যাচ্ছিল। রাশিয়ার জারিনা ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এক রাজকীয় আদেশনামায় রোমানিদের দয়া করে ‘Crown Slaves’ এর পর্যায়ে উন্নীত করেন, যার অর্থ দাঁড়ায় ভুমিদাসদের তুলনায় খানিকটা ভালো অবস্থা!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোমানিরা ইহুদিদের মতোই ভয়াবহ অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। ‘পোরাজমোস’ বা রোমানি হোলোকাস্ট এ 1935—1945 সালের মধ্যে দুই লক্ষ কুড়ি হাজার থেকে পনেরো লক্ষ রোমানিকে Einsatzgruppen অর্থাৎ নাৎসি প্যারামিলিটারী ডেথ স্কোয়াড নৃশংসভাবে হত্যা করে।
একটু ভালো থাকার আশায় যে মানুষগুলো দেশ ছাড়লো, আফগানিস্তান, ইরান, এশিয়া মাইনর, বলকান হয়ে ইউরোপে এক অবিশ্বাস্য অভিপ্রয়াণ করলো, তাদের উত্তরপুরুষদের মনুষ্যতর পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ইউরোপীয় অতিমানবিক সভ্যতার এতটুকু কুন্ঠাবোধ হলো না। নিয়তির কি পরিহাস!
সিনতি (সিন্ধি ???) হলো রোমানিদের এক উপবিভাগ। এদের অপর এক শাখা ডোমারি। আজও রোমানি সমাজে জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতার মতো ভারতীয় প্রথা বিদ্যমান। বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ, একান্নবর্তী পরিবার প্রথা রোমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসছে। এরা দেবতাকে বলে দেবলা। মৃতদেহ দাহ করা এমনকি খ্রিস্টান রোমানিদের সেন্ট সারাকে সারা ই কালী বলে উল্লেখ তাদের ভারতীয়ত্বের পরিচয়ই বহন করে। 1782 সালে জোহান ক্রিশ্চিয়ান প্রথম রোমানি ও ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যেকার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। পরবর্তীতে দেখা যায় ভিলি, গুজরাটি, খান্দেশি (মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চলের কথ্যভাষা), রাজস্থানী ও পাঞ্জাবি ভাষার সাথে রোমানি ভাষার প্রচুর মিল রয়েছে।
রোমানি সংস্কৃতি আলোচনা করতে গেলে গানকে কোনোমতেই উপেক্ষা করা যাবে না, কারণ রোমানি চেতনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গান বাজনা। রোমানি লোকসঙ্গীত ইউরোপের সঙ্গীত চর্চাকে বারে বারে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্বখ্যাত ফ্লেমেনকো গান ও নাচের শৈলীতে রোমা সংস্কৃতির প্রভাব প্রচুর। নিজস্ব লোকগানে রোমানিরা দ্রুতলয়ের মেলোডি, সঙ্গে জিভ ও টাকরার শব্দ, হাততালি ও সরু একরকম লাঠির ঠকাঠক আওয়াজে এক অপরূপ সুরমূর্ছনা সৃষ্টি করে। হাঙ্গেরির Bela Bartok, Franz Liszt, রোমানিয়ার Georges Enesco, ফ্রান্সের Bizet – এদের মতো ইউরোপের বহু কালজয়ী সুরকার নিজেদের সৃষ্টিকে রোমানি সুরতরঙ্গে জারিত করেছেন। আর এক আছে ভায়োলিন। রোমাদের ‘নিজস্ব’ বাদ্যযন্ত্র। রোমারা বিশ্বাস করে ভায়োলিন তাদের সৃষ্টি। আর এই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে তারা তৈরি করেছে “The Creation of the Violin” নামে লোককথা:
“এক দরিদ্র নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান কামনায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একদিন “মাতুয়া”র দেখা পেলো। মাতুয়া দুঃখের কথা শুনে তাদের বাড়ি ফিরে গিয়ে একটা গোটা পেঁপে কেটে তার মধ্যে দুধ ঢেলে সন্তানহীনা মহিলাকে পান করতে বললেন। দম্পতি মাতুয়ার কথামতো কাজ করায় যথাসময়ে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের জন্ম দিয়েই প্রসূতির মৃত্যু হল।
ছেলেটির নাম বাচটালো। কুড়ি বছর বয়স হতেই সে সোনালী ভবিষ্যতের আশায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। ঘুরতে ঘুরতে এক সমৃদ্ধ রাজ্যে হাজির হয়ে বাচটালো শুনলো, রাজ্যময় ঢেঁড়া পেটানো হয়েছে, যে পুরুষ রাজাকে এমন কিছু করে দেখাতে পারবে যা এর আগে কেউ কখনো করেনি, তার সাথেই একমাত্র রাজকন্যার বিবাহ দেওয়া হবে। বহু যুবক পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পরে বাচটালো রাজার কাছে গিয়ে একটা সুযোগ চাইতেই ক্রুদ্ধ রাজা তাকে অন্ধ কারায় নিক্ষেপ করেন। সেখানে বাচটালোর মৃত্যু যখন ঘনিয়ে আসছে এমন সময় মাতুয়ার আবির্ভাব হয়, হাতে তাঁর এক অদ্ভুত দর্শন বাক্স ও একটি ছড়। তিনি ওগুলি বাচটালোকে দিয়ে আদেশ করেন, সে যেন মাতুয়ার মাথার কয়েকটা চুল ছিঁড়ে বাক্সে লাগায় ও সেগুলি ছড় দিয়ে ঘর্ষণ করে। ছেলেটি তাই করলো, সৃষ্টি হলো ভায়োলিন। মাতুয়া স্বয়ং ভায়োলিন এ অবস্থান করে কখনো হাসেন কখনো কেঁদে ওঠেন ফলে ভায়োলিন এর ছড়ে যুগপৎ আনন্দ ও দুঃখের সুর ভেসে ওঠে।“
শত ঝড় ঝঞ্ঝাও রোমানিদের পথ চলার আনন্দকে ম্লান করতে পারেনি। তাই ‘চরৈবেতি’কে মূলমন্ত্র করে এগিয়ে চলা জাতি আজ বিশ্বময় এক অনন্য সংস্কৃতিক গোষ্ঠী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।
পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই—
তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই,
কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই
সন্ধান লব বুঝিয়া।।ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়,
তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।।
অবশেষে রোমানিদের সেই কাঙ্খিত পরমাত্মীয়ের খোঁজে পথচলা বুঝি সাঙ্গ হলো। 1979 সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্বীকৃতির পরে এই সেদিন, 2016 সালে International Roma Conference-এ ভারতের বিদেশ মন্ত্রক রোমানিদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও ভারত সন্তান বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেরিতে হলেও আজ বিশ্বনাগরিক রোমানিরা স্বীকৃত হয়েছে ভারত সংস্কৃতির বৈশ্বিক দূত রূপে।
তথ্যসূত্র:
Romani Routes by Carol Silverman
The Gypsy Menace by Michael Stewart
The Gypsies by Werner Cohn
Origin & divergence of the Roma by David Gresham