জেরুসালেম এমন একটি প্রাচুর্য্যহীন নগরী যা’কে বহিঃশক্তি আক্রমণ করেছে বার বার। লৌহ যুগের সময় জেরুসালেমকে নিয়ে মুখোমুখি কয়েকবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে পারস্য এবং রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে। মধ্যযুগে লড়াই হয়েছে উসমানীয় (অটোম্যান)দের সঙ্গে বাইজেন্টাইনদের। আধুনিক যুগেও দেখা যাচ্ছে জেরুজালেমকে নিয়ে বিবাদমানরা দু’টো প্রধান ভাগে বিভক্ত, যা’র শেষ এখনো কারো জানা নেই। জেরুসালেম বেশীর ভাগ সময় বিবাদের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় দু’টো পরাশক্তির মধ্যে। যদিও বদল হচ্ছে পরাশক্তি, কিন্তু বিবাদমানদের সংখ্যা সব সময়ই থেকে যাচ্ছে দু’টোতে।
মজার ব্যাপার হলো, জেরুসালেমে আদি থেকেই ছিল বেশ কয়েকটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস- যেমন, মুসলমান, ইহুদি এবং খিষ্টানরা ফিলিস্তিনি (Palestinian) নামেই বিশ্বে বেশী পরিচিত; কিন্তু কখনো হয়নি তাদের মধ্যে সম্প্রদায়িক-দাঙ্গা। বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত নগরটিতে দেখা যায়নি কোন বড় রকমের অন্তঃ-কলহ বা গৃহযুদ্ধ। শহরটিতে খ্রিষ্টান, ইহুদি এবং মুসলমানের সহ-অবস্থান ছিল এ’র জন্মলগ্ন থেকেই।
ব্রোঞ্জ যুগে আনুমানিক ১৫০০-১৪০০ খ্রিষ্টপূর্বে জেরুসালেম সর্বপ্রথম মিশরীয় সাম্রাজ্যের রাজা প্রথম আহমস (Ahmose I) এবং পরবর্তীতে প্রথম থুতমোসের (Thutmose I) অধীনে অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। এখান থেকেই সূচনা হয় শহরটির স্বত্ব পরিবর্তনের ইতিহাস। তারপর, লৌহ যুগে ১০১০ খ্রিষ্টপূর্বে রাজা ডেভিড (দাউদ আঃ) জেরুসালেম পুনর্দখল দখল করে শহরটিকে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী করেন। দাউদ (আঃ)এর মৃত্যুর পর, তাঁর ছেলে সলোমন (সুলাইমান রাঃ) শহরটিকে তাঁর শাসনাধীনে রাখেন বেশ কয়েক বছর। তারপর অনেকবারই হাত বদল হয়েছে জেরুসালেমের মালিকানা।
দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারও জয় করেন জেরুসালেম, যদিও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। আসলে ঐ বিজয়টি ছিল আলেকজান্ডারের পারস্যের তৃতীয় দরিয়াস সাম্রাজ্যের ম্যাসেডোনিয়ান জয়ের পার্শ্বক্রিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী বর্তমানের লেবাননের টায়ার শহর অবরোধের (Seige of Tyre) পর মিশরে যাবার পথে জেরুসালেমকে বিনা বাধায় জয় করেছিল। পরবর্তীতে কয়েক শত বছর ধরে বিভিন্ন গোষ্ঠী- যেমন রোমান, পার্শিয়ান, আরব, ফাতিমিড সাম্রাজ্য, সেলজুক, তুর্কি, ক্রুসেডার, মিশরীয়, মামলুক, উসমানীয়রা এবং ব্রিটিশ এ শহরটিকে দখল করে নিয়ন্ত্রণ করেছে নিজেদের মতো করে, কিন্তু চিরস্থায়ী হয়নি তাদের সে শাসন। বারংবার হাত বদল হয়েছে জেরুসালেম শাসনের অধিকার।
সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলমানদের জেরুসালেম বিজয়ের আগ পর্যন্ত শহরটি ছিল রোমানদের অধীনে। রোমানরা তখন জোর করে ইহুদীদের বের করে দিয়েছিলো জেরুসালেম থেকে। ৬৩৬-৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে Battle of Yarmouk-এ খলিফা উমরের কাছে রোমানদের পরাজয় হলে, জেরুসালেম চলে যায় মুসলমানদের শাসনাধীনে।
মুসলমানদের বিজয়ের পর শহরটির খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতা বিশপ সফ্রোনী (Bishop Safroni) উমরের (রাঃ) কাছে অনুরোধ করেন, খলিফা যেন নিজে জেরুসালেম এসে নগরীর চাবিটি সংগ্রহ করেন। কারণ বাইবেলে বলা আছে, একজন দরিদ্র কিন্তু ন্যায়পরায়ণ শাসক জেরুসালেমের খ্রিষ্টান-ইহুদি-মুসলমান -সবার রক্ষক এবং মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হবেন। এমন বার্তা পেয়ে খলিফা উমর অতি সাধারণ পোশাকে মদিনা থেকে তাঁর এক খাদেমকে নিয়ে উটে চড়ে রওনা হলেন জেরুসালেমের আল আক্বসার অভিমুখে। সুদীর্ঘ ১২০০ কিঃ মিঃ পথ পাড়ি দেবার সময় তিঁনি এবং তাঁর খাদেম বদলাবদলি করে উটে চড়ে জেরুসালেম পৌঁছান। কিছু পথ তিঁনি উটের পিঠে এবং খাদেম হেঁটে; আবার খাদেম যখন উটে, খলিফা তখন হেঁটে জেরুসালেম পৌঁছান। তাঁদের পোশাক দেখে বোঝার উপায় ছিলো না, কে খলিফা আর কে খাদেম। তাঁদের উট যখন জেরুসালেমে প্রবেশ করলো, তখন উটের উপর সওয়ার হবার পালা ছিল খাদেমের। কিন্তু খাদেম খলিফাকেই উটের উপর থাকতে অনুরোধ করে। কিন্তু খলিফা আদেশ করেন, পালা অনুযায়ী খাদেমকেই ঐ সময় উটের পিঠে থাকতে হবে। উমর যখন উটের লাগাম ধরে হেঁটে আল আক্বসায় ঢুকলেন, সবাই প্রথমে ধারণা করলো, উঠের উপরে থাকা খাদেমই খলিফা। তাদের ভুল ভাঙলো সহসাই। সবাই দেখলো সাধারণ এক খলিফা এবং তাঁর ন্যায়পরায়ণতা।
শহরে প্রবেশের পর খলিফা বের হলেন জেরুসালেম শহর দেখতে। রোমানরা পবিত্র আল-আক্বসা চত্বরকে ব্যবহার করতো শহরের বর্জ-আবর্জনা ফেলার স্থান হিসেবে। তিঁনি স্থানীয় ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের নিয়ে পরিষ্কার করলেন এলাকাটি। খলিফার সেপলকার গির্জা (Church of the Holy Sepulchre) পরিদর্শনকালে নামাজের সময় হলে গির্জার বিশপ তাঁকে ঐ গির্জাতেই নামাজ পড়ার জন্য বলেন। কিন্তু খলিফা গির্জার বাইরেই নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে পরবর্তীতে মুসলমানরা তাঁর গির্জায় নামাজ পড়াকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ঐ গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর না করতে পারে। খলিফা একটি আদেশনামাও লিখে তা’ খ্রিষ্টানদের হাতে হস্তান্তর করেন, যা’তে মুসলমানদের ঐ বিশেষ গির্জায় প্রার্থনা করতে নিষেধ করা হয়। সেই যে খলিফার কাছে গির্জার চাবি হস্তান্তর করা হলো ৬৩৭ সালে, আজ অবদি সেপলকার গির্জাটির চাবি মুসলমানদের কাছেই রয়ে গেছে।
জেরুজালেম মুসলমানদের অধীনে আসার পর, প্রায় পাঁচ শো বছর পর খলিফা উমরের সরাসরি তত্বাবধানে ইহুদিরা পুনরায় জেরুসালেমে বসবাস করার সুযোগ পায়। তিঁনি শহরের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তী প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর জেরুসালেম ছিল শান্ত, কিন্তু তা’ হলো না চিরস্থায়ী।
একাদশ শতাব্দীতে জেরুসালেমের উত্তর-পশ্চিমে ক্ষনে ক্ষনে চমকাতে লাগলো সংঘাতের বিজলী। সংঘটিত হচ্ছে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররা। প্রস্তুতি নিচ্ছে ধর্মের নামে এক লড়াইয়ের (Holy War)। শহরটি আবারো রক্তাক্ত হয় একাদশ শতাব্দীর একদম শেষ দিকে- ১০৯৯ সালে। ক্রুসেডাররা আক্রমণ করে জেরুসালেম। ক্রুসেডারদের সিংহভাগই ছিল ফ্রান্সের অধিবাসী। এই বহিরাগতরা শহরটিতে চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ১০৯৯ সালের জুলাই মাসে প্রথম ক্রুসেডের সময় জেরুসালেমের বেশিরভাগ মুসলমান এবং ইহুদিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এ হত্যাযজ্ঞে খ্রিস্টানরাও রক্ষা পাইনি, কারণ জেরুসালেমের সব সম্প্রদায়ের মানুষ (ফিলিস্তিনি) দেখতে এবং পোশাকে ছিল প্রায় একই রকম। ক্রুসেডাররা প্রথমে খ্রিষ্টানদেরও চিনতে ব্যর্থ হয়। এ নির্মমতা চলে দশ দিন। উদ্দেশ্য, জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তানি মুসলমান, প্রাচ্যের খ্রিষ্টান (Eastern Christians) এবং ইহুদিদের সম্পূর্ণভাবে উৎখ্যাত করা।
এ মর্মে গেস্টা ফ্রানকোরামের (Gesta Francorum) প্রত্যক্ষদর্শী এক লেখক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে গেছেন যে, আল-আকসার আশেপাশের এলাকা ইহুদি এবং মুসলমানদের রক্তে ক্রুসেডারদের পায়ের গোঁড়ালি পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিলো। বলা হয়ে থাকে, নিহতদের মাথার খুলি দেয়ালের ইটের মতো একটির উপর অন্যটি সারি বেঁধে রাখলে, দেয়ালটির দৈর্ঘ্য হতো জেরুসালেমের প্রাচীরের চেয়েও দীর্ঘ। যারা বেঁচে ছিল, সে সব মুসলমান, প্রাচ্যের খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের জোর করে বের করে দেয়া হয় শহর থেকে। ধ্বংস করা হয় মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো, আল-আক্বসা মসজিদকে রূপান্তরিত করা হয় পশুর আস্তাবলে। জেরুসালেমের উপর নেমে আসে বহিঃশক্তির নির্মমতা। এ নৃশংসতা চললো দ্বাদশ শতাব্দীর নব্বই দশক পর্যন্ত। প্রথম ক্রুসেড আপাতঃ দৃষ্টিতে সফল মনে হলেও, এটি ছিল জেরুসালেমকে ঘিরে সুদীর্ঘ এক সংগ্রামের নাটকীয় সূচনা মাত্র। এ লগ্ন থেকে শুরু হলো মুসলিম পুনরুজ্জীবনের উপাখ্যান। আগামী দু’শো বছর লুন্ঠিত নগরীকে ফিরে পাবার এক নিরন্তর সংগ্রামের ভিত্তি রচিত হলো ক্রুসেডারদের নৃশংসতার মধ্যে দিয়ে।
চলবে…
তথ্যসূত্র:
* Gil, Moshe (1997). A History of Palestine, 634-1099. Cambridge University Press
* Asali, K. (1990). Jerusalem in History. Interlink Books.
* Al Jazeera documentary: “Shock: The First Crusade and the Conquest of Jerusalem,” The Crusades: An Arab Perspective, December 7, 2016.