প্রাচীনকাল থেকেই রং আমাদের ইতিহাসের অত্যন্ত বিশাল অংশ জুড়ে বিরাজমান। ফ্যাশন এবং ব্যক্তিত্বের ধারণাকে উদ্দীপিত করতে এই রঙের ব্যবহার যেমন শুরু হয়েছিলো, তেমনি কোনো বিশেষ পেশায় আভিজাত্য আরোপেও এর ব্যবহার হয়েছিলো ভিন্নভাবে, ঠিক যেমন সামরিক বাহিনীর পোশাকে ক্যামোফ্লাজের ব্যবহার। এ ছাড়াও সমাজের উঁচু ও নিচু শ্রেণীর বিভেদকে স্পষ্ট করতেও হতো রঙের ব্যবহার। আর সেই দিক থেকেই প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল, জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় রঙের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান ‘টাইরিয়ান পার্পল’ বা ‘টাইরিয়ান বেগুনী’ রঙের, হাজার বছর ধরে যার উৎপাদন প্রক্রিয়ার গোপনীয়তা সুরক্ষিত ছিলো।
কথিত আছে, ফিনিশীয় দেবতা মেলকার্ত, যাকে গ্রীক ও রোমানরা হারকিউলিস বলে মানে, তিনি এই রঙের উৎপত্তিস্থল টায়ার নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। এক দিন মেলকার্ত তার কুকুরকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে সময় কাটাতে গিয়েছিলেন। তার কুকুরটি সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে আসা একটি মিউরেক্স শামুক মুখে নিয়ে চিবাতে শুরু করলে এর মুখ বেগুনী রঞ্জকে মেখে যায়। প্রথমে মেলকার্ত তার কুকুরের মুখটিকে রক্তাক্ত ভাবলেও পরে বুঝতে পারলেন, এটি কোনো বিশেষ রঞ্জক। মেলকার্তের প্রেমিকার এই রংটি ভীষণ পছন্দ হলো। তিনি মেলকার্তের কাছে এই রঙের একটি পোশাক বানিয়ে দেবার আবদার করলেন। প্রচলিত মিথ অনুযায়ী, মিউরেক্স শামুক থেকে বিশেষ এই বেগুনী রং নিষ্কাশনের এটিই ছিলো শুরু।
অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক শামুক থেকেই এই বেগুনী রঞ্জক নিষ্কাশন করা যেতো। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো কয়েকটি বিশেষ শিকারী শামুকের প্রজাতি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, স্পাইনি ডাই-মিউরেক্স, ব্যান্ডেড ডাই-মিউরেক্স ও লাল মুখবিশিষ্ট পাথুরে খোলসযুক্ত শামুক। এদের থেকে উৎপাদিত বেগুনী রঞ্জক ছিলো সবচেয়ে উন্নত মানের ও আকর্ষণীয়। মূলত এসব শামুকের হাইড্রোব্রাঙ্কিয়াল গ্রন্থি হতে নিঃসৃত মিউকাস থেকেই তৈরী হতো এই বিশেষ টাইরিয়ান পার্পল।
শামুকের প্রতিটি প্রজাতির নিঃসৃত রঞ্জকের মধ্যেও কিন্তু আবার ভিন্নতা রয়েছে। সব শামুক একই ধরনের বেগুনী রং তৈরী করে না। ফিনিশীয় অঞ্চলগুলোতে ব্যান্ডেড ডাই-মিউরেক্স শামুকটি থেকে ‘তেখেলেত’ নামের একটি ‘ইন্ডিগো’ বা ‘নীল’ রং তৈরী করা হতো। এই বিশেষ নীল রংটি সাধারণত ইহুদীদের প্রার্থনার জন্য ব্যবহৃত শাল ‘তালিত’ এর প্রান্তে ‘জিতজিত’ নামের ফিতাসদৃশ অংশ রাঙানোতে ব্যবহৃত হতো। এখনও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এই ব্যান্ডেড ডাই-মিউরেক্স পাওয়া যায়।
টাইরিয়ান বেগুনী রঞ্জকের প্রস্তুত প্রণালীটিও ছিলো বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এই রং প্রস্তুতিতে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়াসহ জৈব রাসায়নিক, এনজাইমেটিক ও আলোক রাসায়নিক বিক্রিয়াসমূহও সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই এ কাজের জন্য অত্যন্ত দক্ষ ও জ্ঞানী কারিগরের প্রয়োজন ছিলো। তা ছাড়া সময়ও এখানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সাধারণত শামুককে পানি থেকে উত্তোলনের পর পরই এর রঞ্জক ক্ষয় হতে শুরু করে। এ কারণে রং প্রস্তুতির কারখানাগুলোকে সাধারণত শামুক চাষের স্থানের কাছাকাছিই রাখা হতো।
একটি নির্দিষ্ট সময় পর মিউরেক্স শামুক থেকে টাইরিয়ান বেগুনী রঞ্জক নিষ্কাশনের এই পদ্ধতির গোপনীয়তা রক্ষা করা আর সম্ভব হয় নি। তবে টাইরিয়ান বেগুনী আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে যে অভিনব পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণে রঞ্জক উৎপাদন সম্ভব হয়েছিলো, তা আর পরবর্তীতে ঘটানো যায় নি। বলা হয়ে থাকে, মিউরেক্স শামুকের দুর্গন্ধ পুরো টায়ার নগরীতে ছেয়ে থাকতো। কারণ শামুক উত্তোলনের পর সেগুলোকে পচনের জন্য অনেক ক্ষণ পর্যন্ত রেখে দেয়া হতো। এই দুর্গন্ধ এতোই প্রকট ছিলো যে, মিউরেক্স ডাইয়ার বা রং প্রস্তুতকারকদের হাত থেকে সারাক্ষণ পঁচা মাছের মতো গন্ধ আসতো। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে প্রচলিত ইহুদী ধর্মের প্রধান রীতি অনুযায়ী লিখিত গ্রন্থ ‘তালমুদ’-এ এমন কথারও উল্লেখ ছিলো যে, কোনো নারীর স্বামী মিউরেক্স ডাইয়ার হিসেবে কাজ করলে সেই নারী তাকে তালাক প্রদানের অধিকার রাখে।
টায়ার নগরীই এই বিশেষ বেগুনী রং উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত হলেও গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, টায়ারেরও কয়েক শতাব্দী আগে মিনোয়ান সভ্যতায় এই বেগুনী রং প্রস্তুত করা হতো। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ ইতালিতে আবিষ্কৃত মিউরেক্স শামুকের খোলসগুলোও এটিই প্রমাণ করে যে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ শতকে সেখানেও এই রঞ্জক তৈরী হতো। এ ছাড়াও ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত মেসোআমেরিকান এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে কোনো প্রকার যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে দুই অঞ্চলেই মিউরেক্স শামুক থেকে বেগুনী রং তৈরীর হুবহু একই ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। আসলে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে ফিনিশীয় কলোনিগুলোতে টাইরিয়ান পার্পল ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমেই প্রথম বার এটি বহিঃর্বিশ্বের নজর কেড়েছিলো। এ কারণেই মিউরেক্স শামুক থেকে বেগুনী রং প্রস্তুতির জন্য টায়ারের খ্যাতিই প্রধান হয়ে উঠেছিলো।
প্রকট দুর্গন্ধের মধ্যে প্রস্তুত হলেও টাইরিয়ান বেগুনী যে কোনো অঞ্চলের জন্যই ছিলো আভিজাত্যের প্রতীক এবং সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু। শুধুমাত্র সমাজের উচ্চপদস্থ ও ধনী ব্যক্তিবর্গই এই রঙের পোশাক পরিধানের অধিকার রাখতো। রোমানদের ক্ষেত্রে, সিনেটরদের ‘টোগা’ নামের পোশাকে বেগুনী রঙের স্ট্রাইপ ব্যবহারের অনুমতি ছিলো। জানা যায়, ৪০ সালের দিকে সম্রাট ক্যালিগুলা মৌরিতানিয়ার রাজা টলেমীকে বেগুনী পোশাক পরিধানের অপরাধে হত্যা করেছিলেন, কেননা এর উপর শুধু সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদেরই অধিকার ছিলো।
টাইরিয়ান বেগুনী নিছকই একটি রঞ্জক ছিলো না, ছিলো রঙের ধারণা প্রবর্তনের এক উল্লেখযোগ্য প্রতীক। সে সময় কন্সট্যান্টিনোপোলের প্রাসাদে বাইজেন্টাইন সম্রাজ্ঞীদের প্রসবের সময় তাদেরকে ‘পার্পল চেম্বার’-এ নিয়ে যাওয়া হতো, যেনো প্রকৃত সম্রাটদের ক্ষেত্রে ‘বেগুনী থেকে জন্ম’ –এই ধারণাটির সার্থকতা আজীবন বহাল থাকে। টাইরিয়ান পার্পল ছিলো পার্পল চেম্বারে জন্মগ্রহণ করা সম্রাটদের গর্ব।
১৪৫৩ সালে কন্সট্যান্টিনোপোলকে তুরস্ক দখল করে নিলে মিউরেক্স শামুক থেকে বেগুনী রঞ্জক উৎপাদনের গোপন পদ্ধতি প্রকাশ্যে চলে আসে। ১৮৫৬ সালে রসায়নের ছাত্র উইলিয়াম হেনরি পার্কিন মাত্র ১৮ বছর বয়সে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্য ‘কুইনাইন’ তৈরীর চেষ্টা করেছিলেন। সে সময় তিনি আরেকটি জিনিস আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, যেটি টাইরিয়ান বেগুনীরই অনুরূপ একটি কৃত্রিম বেগুনী রং। এর নাম দেয়া হয় ‘মাওভেইন’ বা ‘মাওভ’। এই আবিষ্কারের পর থেকে বেগুনী রংটি ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ১৯৫৮ সালে টাইরিয়ান পার্পল উৎপাদনের জটিল প্রক্রিয়াটি আবারো আবিষ্কৃত হয়েছিলো। বর্তমানেও মেক্সিকোর ওয়াক্সাকার মতো খুব অল্প সংখ্যক অঞ্চলে এই শিল্পটি প্রচলিত আছে এবং এখন জীবকে হত্যা না করে শুধুমাত্র তার মিউকাস ব্যবহার করেই এই রঞ্জক তৈরী করা সম্ভব। তবে প্রাচীন সময়ের মতো আজও এর মূল্য অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। মাত্র এক গ্রাম টাইরিয়ান পার্পলের মূল্য প্রায় হাজার ডলারের সমান এবং সামান্য বেগুনী রং তৈরীর জন্য হাজার হাজার মিউরেক্স শামুকের মিউকাস প্রয়োজন। এ ছাড়াও কাপড় তৈরীর আগেই এর সুতাগুলোকে টাইরিয়ান বেগুনীতে রঞ্জিত করতে হয় বলে এই বেগুনী কাপড়ের দামও অনেক বেশি।
হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত বেগুনী রং আজ আর দুর্লভ কিছু নয়। তবে টাইরিয়ান পার্পল হিসেবে এই রঙের ব্যবহারের কারণে চিরকালই এই বেগুনী রঙে আভিজাত্য প্রস্ফুটিত হবে।
রেফারেন্স: