বেগুনী রঙের জাতি-খ্যাত ফিনিশীয় জাতির কথা মনে আছে কি? হ্যাঁ, সেই ফিনিশীয় জাতি, যাদের আচরণের মধুরতা ও সমুদ্র-বাণিজ্যের সফলতা ছিলো জগদ্বিখ্যাত। মিষ্টিভাষী এই বেগুনী ফিনিশীয়রা প্রতি ত্রিশ মাইলের ভেতরে গড়ে তুলেছিলেন এক একটি শক্তিশালী কলোনি এবং প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিখ্যাত কিছু সমুদ্রবন্দর। এমনই একটি অন্যতম প্রধান সমুদ্রবন্দর ছিলো তাইর বা টায়ার। বর্তমান লেবাননে অবস্থিত বাণিজ্যসম্রাটদের এই বিখ্যাত বাণিজ্য-হাব টায়ার। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বাণিজ্যে রাজত্ব করে গেছে সিডন শহরের এই কলোনিটি।
বাইজেন্টাইন যুগ পর্যন্ত টায়ার ছিলো ফিনিশীয় বাণিজ্যের আলোকবর্তিকা। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ সালে টায়ার নগরী প্রতিষ্ঠা হলেও আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকদের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, হাজার হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে সভ্যতার অস্তিত্ব ছিলো। যদিও টায়ারকে সিডনের একটি কলোনিই মনে করা হয় এবং সিডন শহরটি আরও আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তবুও প্রাধান্য বিস্তারকারী মূল ফিনিশীয় নগরী কোনটি হবে –এই নিয়ে এক অদ্ভূত প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিলো সিডন ও টায়ারের মাঝে।
ফিনিশীয়রা কি করে পরিণত হলো ‘বেগুনী’ জাতিতে, জানেন কি? এর কারণ হলো ভূমধ্যসাগর থেকে উত্তোলিত মিউরেক্স শামুক এবং তা থেকে তৈরীকৃত উজ্জ্বল বেগুনী রঞ্জক। বিশেষভাবে তৈরী এই বেগুনী রঙের সৌন্দর্যে মুখর হয়েছিলো সমগ্র বিশ্ব। ফিনিশীয় বাণিজ্যের সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন উপকরণ ছিলো এই বেগুনী রং। উচ্চমূল্যের কারণে প্রাচীন বিশ্বের ধনী অভিজাতদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলো রঙটি। আর প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে দামী এই বেগুনী রঙের ওপর একচেটিয়া অধিকার ছিলো টায়ারের।
মিউরেক্স শামুক থেকে সবচেয়ে উন্নত মানের বেগুনী রং তৈরী টায়ারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো। টায়ার এই রঞ্জক প্রস্তুতিতে বিশেষজ্ঞ শহরে পরিণত হয়েছিলো এবং রঙটির মূল প্রস্তুত-প্রণালীর গোপনীয়তা সব সময় সুরক্ষিত রাখা হতো। এ কারণে এই রঙকে ‘টাইরিয়ান বেগুনী’-ও বলা হয়ে থাকে।
মিশরের নিয়ন্ত্রণাধীন সময়ে টায়ারকে অবরোধ করেছিলো মিশরীয়দের প্রতিদ্বন্দ্বী হিট্টাইট জাতি। কাদেশে সংঘটিত যুদ্ধে মিশরীয়দের কাছে পরাজিত হয় হিট্টাইটরা এবং এরই মাধ্যমে মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো মিশরীয় ও হিট্টাইটদের মাঝে।
খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১১৫০ সালের মধ্যে শেষ ব্রোঞ্জ যুগের পতনের সাথে সাথে মিশরীয় শক্তিরও অধঃপতন ঘটেছিলো। এ সময় টায়ার মিশরীয় আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। সমগ্র ভূমধ্যসাগর জুড়ে টায়ার লেভান্টের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো। সে সময় সকল ফিনিশীয় বা ক্যানানাইট জনগণকে ‘টায়ারবাসী’ এবং ভূমধ্যসাগরকে ‘টাইরিয়ান সাগর’ বলে অভিহিত করা ছিলো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বিজয় লাভের মাধ্যমে নয়, টায়ার রাজত্ব করেছিলো বাণিজ্যের মাধ্যমে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে টায়ার উন্নত করেছিলো নিজেদের জাহাজ পরিচালনার দক্ষতা এবং টাইরিয়ান বাণিজ্যকে ছড়িয়ে দিয়েছিলো ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে। ভূমধ্যসাগর জুড়ে সদ্য গড়ে ওঠা স্বাধীন অঞ্চলগুলোতে নিজেদের বাণিজ্যিক বন্দরও স্থাপন করেছিলো টাইরিয়ানরা।
সামুদ্রিক বাণিজ্যের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিলো টায়ারের। আর এই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বহিঃর্বিশ্বের কিছু বিখ্যাত পণ্যের সাথে বিনিময়ের সুযোগ করে দিয়েছিলো টায়ারবাসীকে। সাইপ্রাস থেকে আসা কপার এবং লেবানন থেকে আসা সিডার গাছের কাঠ ছিলো এর মাঝে অন্যতম। লেবাননের এই বিশেষ সিডার কাঠ দিয়েই টায়ারের প্রতিবেশী ও বন্ধু-রাজ্য ইসরায়েলে রাজা সোলায়মানের মন্দির বা ফার্স্ট টেম্পল তৈরী করা হয়েছিলো বলে জানা যায়। টায়ারের বাণিজ্যে সে সময় লিনেন কাপড়ও খুবই চাহিদাসম্পন্ন একটি পণ্যে পরিণত হয়েছিলো, কারণ টাইরিয়ান বেগুনী রঙে রাঙানোর জন্য এই কাপড়টি খুবই উপযোগী ছিলো। তাই লিনেনও হয়ে উঠেছিলো টাইরিয়ান বাণিজ্যের এক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য।
বাইবেলে উল্লিখিত সম্পদশালী স্থান ওফির থেকে টায়ারে সোনা, মূল্যবান পাথর ও অ্যালমাগ গাছ আমদানি হতো। ওফিরের সাথে ইসরায়েলের বাণিজ্যিক যোগাযোগ টায়ারের মাধ্যমেই হয়েছিলো। এই পর্যায়ে দ্বীপ-শহর টায়ার আধুনিকতম সভ্যতা প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকতে এবং লম্বা দালানকোঠা নির্মাণ করতে শুরু করে। খুব তাড়াতাড়ি সুদক্ষ রাজমিস্ত্রী, ধাতু-শ্রমিক ও নাবিকের জন্য টায়ার খ্যাতি অর্জন করেছিলো।
খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে টায়ার ও অন্যান্য ফিনিশীয় এলাকা শক্তিশালী নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে প্রথম দিকে টায়ারের স্বাধীনতায় পুরোপুরি হস্তক্ষেপ করা হয় নি। টায়ার আগের মতোই স্বাধীনভাবে নিজেদের বাণিজ্য-কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে কিছুকাল পরই। পরবর্তী নব্য-অ্যাসিরীয় সম্রাটরা টায়ারের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছিলো। টায়ারবাসী তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সফল হতে পারে নি। ফলস্বরূপ, সাইপ্রাসের সাথে টায়ারের বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু উচ্চ চাহিদার কারণে টায়ার তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য রঞ্জক শিল্পের বাণিজ্য ধরে রাখতে পেরেছিলো।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ থেকে ৬০৫ সাল পর্যন্ত মাত্র সাত বছরের জন্য টায়ার স্বাধীন হয়েছিলো। কিন্তু এর পরপরই নব্য-ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্যের সাথে মিশরের যুদ্ধ বেঁধে যায়। উপায়ান্তর না দেখে টায়ার মিশরের সাথে চুক্তি স্থাপন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে নব্য-ব্যবিলনীয় সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার টায়ার অবরোধ করে বসেন। তেরো বছরের অবরোধকালীন সময়ে টায়ার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শত্রুপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ থেকে ৩৩২ সাল পর্যন্ত আকেমেনিড সাম্রাজ্যের অধীনে টায়ার পারস্যের একটি অংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজাণ্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনীর কাছে পার্সিয়ানরা পরাজিত হলে টায়ার আলেকজান্ডারের বাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষের মুখে পড়েছিলো। ঐ বছরই আলেকজান্ডার টায়ার অবরোধ করেন। টায়ারবাসী প্রত্যক্ষ করেছিলো গ্রীকদের নির্মম নিষ্ঠূরতা। আলেকজান্ডার টায়ারের পুরনো শহরটি ধ্বংস করেন এবং ধ্বংসস্তূপ ব্যবহার করে দ্বীপের সাথে সংযোগকারী একটি পথ তৈরী করেন। এভাবেই আজ অবধি টায়ার একটি পেনিনসুলা বা উপদ্বীপ হয়েই রয়ে যায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ সালে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তার সেনাপতিদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। টায়ার এ সময় ক্রমাগত ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রণের অধীন হতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় টায়ার মিশরের টলেমীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় দীর্ঘ ৭০ বছরের জন্য। তারপর খ্রিস্টপূর্ব ১৯৮ সালে আলেকজান্ডারের সাম্রজ্যের একজন উত্তরসূরি সেনাপতি সেলিউকাস পশ্চিমের দিকে আক্রমণ করেন এবং টায়ার দখল করেন। তবে টায়ারের ওপর সেলিউসিড সাম্রাজ্যের দখল খুবই দুর্বল ছিলো। তাই টায়ার প্রায় স্বাধীন শহর হিসেবেই বাণিজ্য করতে থাকে। এ সময় তারা নিজস্ব মুদ্রাও তৈরী করেছিলো এবং সিল্ক রোডের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেদের বাণিজ্যকে আবারো সম্প্রসারিত করেছিলো।
সিল্ক রোডের বাণিজ্যের মাধ্যমে ক্রমশ ধনী হয়ে ওঠা টায়ার সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে যায় খ্রিস্টপূর্ব ১২৬ সালে সেলিউসিড সাম্রাজ্যের পতনের পর। আরও এক বার টাইরিয়ান বাণিজ্য লেভান্টে আধিপত্য বিস্তার করে এবং টায়ারের মুদ্রা আশেপাশের সব অঞ্চলের আদর্শ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সালে টায়ার রোমান শাসনাধীনে চলে যায়। তবে রোমের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করার সুযোগ পায় টায়ার। মিউরেক্স শামুক থেকে পাওয়া রঞ্জক ও লিনেন কাপড়ের সমৃদ্ধ বাণিজ্য তো আগে থেকেই ছিলো। সেই সাথে টায়ারে যুক্ত হয়েছিলো আরেকটি পণ্যের রমরমা ব্যবসা। সেটি হলো, রোমানদের তৈরী একটি মাছের সস ‘গ্যারাম’। এই গ্যারাম সসের এতো চাহিদা ছিলো যে, অন্য পণ্যে মুনাফা না হলেও চলতো।
শুধু বাণিজ্যের দিক থেকেই নয়, রোমান নিয়ন্ত্রণে টায়ার সব ক্ষেত্রেই সমৃদ্ধি লাভ করেছিলো। টায়ার একটি রোমান কলোনির মর্যাদা লাভ করেছিলো এবং রোমান নাগরিকদের সমান অধিকারসহ রোমান নাগরিকত্ব লাভ করেছিলো। জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতিতে টায়ার খ্যাতি অর্জন করেছিলো। ম্যাক্সিমাস এবং প্রোফাইরিদের মতো খ্যাতনামা টাইরিয়ান দার্শনিক এই সময়েই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
রোমান পরিচয়ের টায়ারবাসী দুর্দিন যে একেবারেই দেখে নি, তা নয়। হঠাৎ করেই খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাবের ফলে আস্তে আস্তে টায়ারে ধর্মীয় কোন্দল শুরু হয়। খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাস স্থাপনকারী সংখ্যালঘু টাইরিয়ান জনগণকে নির্মম নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিলো তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে। অবশেষে ৩১৩ সালে রোম যখন আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান জাতিতে পরিণত হয়, তখন এই সংঘাতের অবসান ঘটে। ৩১৫ সালে ইতিহাসের প্রাচীনতম চার্চ ‘ক্যাথেড্রাল অফ পলিনাস’ তৈরী করা হয় টায়ারে। ১৯৯০ সালে একটি ইসরায়েলি বোমা হামলায় চার্চটি ধ্বংস হয়ে যায়।
৩৯৫ সালে টায়ার বাইজেন্টাইন সাম্রজ্যের একটি অংশে পরিণত হয়। আর এ সময় টায়ারের বাণিজ্যে নতুন একটি পণ্য যুক্ত হয় –চীনাদের গোপনীয় ফর্মুলায় তৈরী সিল্ক বা রেশম। সিল্কের প্রস্তুত প্রণালী ভীষণ সাবধানতার সাথে চুরি করে নিজেদের তত্ত্বাবধানে সিল্কের উৎপাদন শুরু করে বাইজেন্টাইনরা। সিল্ক বাণিজ্যের সংযুক্তি টায়ারের জন্য ছিলো ভীষণ লাভজনক। তবে ঘন ঘন ভূমিকম্প, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি কারণে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এক সময় দুর্বল হতে শুরু করে এবং টায়ার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ৬৪০ সালে মুসলিম বিজয়ের পর থেকে।
সম্পূর্ণ মধ্যযুগ জুড়ে মানব সভ্যতার ভিত তৈরী করেছে টায়ার। টায়ার থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। টায়ার সব সময় ব্যবসা করেছে, মূল্যবান পণ্য উৎপাদন করেছে এবং সামুদ্রিক সংস্কৃতিকে দৃঢ়তা প্রদান করেছে। এরই ফলস্বরূপ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাম্রাজ্য টায়ারের সাথে সাথে বিকশিত হয়েছে। সেসব মহান সাম্রাজ্য ও শাসকগণ সময়ের সাথে অদৃশ্য হয়ে ইতিহাসের পাতায় জমে গেছেন, কিন্তু টায়ার একটি শিল্প ও বাণিজ্যের শহর হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে ভিন্ন রূপে।
রেফারেন্সঃ