১৭৬৩ সালের জুন মাসের কথা। বাংলা থেকে রওয়ানা হয়ে এ বন্দর সে বন্দর পার হয়ে “দ্যা ফক্স” নামের জাহাজ পৌঁছেছে বিলাতে। ইউরোপের বিভিন্ন বাজারে বিক্রির জন্য জাহাজটি নিয়ে এসেছে নানান পণ্য যার মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে হরেক রকম বস্ত্র। আর এই হরেক রকম বস্ত্রের সিংহভাগ জুড়ে আছে মলমল নামের একপ্রকার বস্ত্র। তেরো হাজার তিনশত বায়ান্ন খণ্ড মলমলের এই চালানটি এসেছে বাংলার শিল্পনগরী ঢাকা থেকে। ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ মসলিন কারিগরদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এই মলমল। মলমলের পাশাপাশি এই চালানে আছে শবনম ও সারবান্দ নামক আরো দুই ধরনের মসলিন। এটা ছিল কেবল একটি জাহাজে বহন করা মসলিনের পরিমান। পুরো ১৮ শতক জুড়েই এরকম শত সহস্র জাহাজ বাংলা থেকে নিয়ে গেছে সে সময়ের হিসাবে লক্ষ লক্ষ টাকার মসলিন।
মসলিনের স্বর্ণযুগ ছিল মুঘল আমল। মুঘল পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময় ঢাকা ও তার আশেপাশে গড়ে উঠেছিল তাঁতী আর তুলা চাষীদের আবাস। দিল্লীর সম্রাটের ফরমান অনুযায়ী এসময়ে তৈরি হয়েছে মলবুস খাস থেকে শুরু করে সরকার-ই-আলা, আব-ই-রওয়া, নয়নসুখ, বদনখাস, সরবুটি, ইত্যাদি নানা নামের মসলিন। এখানে উল্লেখ্য যে মসলিনের সুতা কাটা থেকে শুরু করে কাপড় বোনা পর্যন্ত প্রতি ধাপেই অধিকাংশ কর্মী ছিলেন ঢাকার নারীরা, বিশেষত তরুণী নারী।। ১৭১৫-১৬ সালের দিকে সুবা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ সরে গেলেও শিল্পনগরী হিসেবে ঢাকা তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। ঢাকায় তখন শুরু হয় নায়েবে নাজিমের শাসন। এসময়ে ঢাকার অধিকাংশ অধিবাসী থাকতেন বুড়িগঙ্গার ধারে। তবে উত্তরে বিচ্ছিন্ন ভাবে টঙ্গি পর্যন্ত জনবসতি ছিল। আর মসলিন ব্যবসার লাভের কারণে ইউরোপীয় বণিকেরা তাদের ফ্যাক্টরি বা কুঠি বসিয়েছিলেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। এসময় ইংরেজ কুঠি ছিল তেজগাঁও এলাকায়।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার দুর্ভাগ্যজনক পরাজয় ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ এই মসলিন শিল্পকে চরমভাবে প্রভাবিত করে। এই প্রভাবের শুরুটা ছিল পরোক্ষ এবং খানিকটা ধীরে। তবে বিলাতের শিল্পবিপ্লব ও ইংরেজ কুটকৌশলে.১৮ শতকের শেষভাগে গিয়ে মসলিন দ্রুত তার বাজার হারাতে থাকে। সিরাজের পরাজয়ের পর ইংরেজরা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এরফলে ঢাকার নায়েবে নাজিম জেসারত খান সহ বহু মুঘল অমাত্য ইংরেজদের বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। আর্থিক ক্ষমতার পাশাপাশি নায়েবে নাজিমের প্রশাসনিক ক্ষমতাও লোপ পায়। ইংরেজ ল্যাফটেনান্ট সুইনটন জেসারত খানের সাথে একসাথে বসে ঢাকার শাসন কাজ চালাতে লাগলেন। বাংলা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যে রাজস্বের সবচেয়ে বড় উৎস। এটা হাতাছাড়া হওয়ায় মুঘল সম্রাট, তার সভাসদ ও পরিবারবর্গের ক্রয়ক্ষমতাও বহুলাংশে কমে গেল। প্রধান ক্রেতার এ হেন দশায় মসলিন হারাল তার অভ্যন্তরীণ বাজার। অভ্যন্তরীণ বাজারের সংকোচনে কর্মহীন হল বহু মসলিন তাঁতী আর এর ফুটি তুলার চাষীরা। এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার কর্মচারীদের অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ উন্মুক্ত করে দিল। তারা মেতে উঠলো কালোবাজারি, মজুদদারিতে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হল আকাশ ছোঁয়া। একদিকে কর্মহীন জীবন, অন্যদিকে উচ্চ দ্রব্যমূল্য- ফলাফল ৭৬ এর মন্বন্তর, এ দুর্ভিক্ষে শুধু বাংলাতেই অনাহারে প্রাণ যায় ৩০ লক্ষ নরনারীর।
১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মসলিনের বিক্রি মুঘল সাম্রাজ্যে প্রায় শূণ্যের কোঠায় এসে ঠেকলেও ইউরোপের বাজারে তখনো টিকে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল, ১৭৮০ তে বিলাতের শিল্প বিপ্লব মসলিন তাঁতীদের ঐ শেষ আশ্রয়টাও ধ্বংস করে দেয়। প্রাথমিক ভাবে যন্ত্রে তৈরি ম্যানচেস্টারের ওসব মোটা কাপড়ের কোনো ক্রেতা ইংরেজরা বিশ্ববাজারে পাচ্ছিল না। ঢাকায় তৈরি হাতে বোনা মসলিনের অনবদ্যতায় মুগ্ধ ক্রেতারা কেউই সেইসব মোটা বিলাতি কাপড় কিনতে রাজি ছিল না। এক্ষেত্রে ইংরেজরা যথারীতি কুটকৌশলের আশ্রয় নিল। বিলাতে ঢাকা থেকে আমদানিকৃত মসলিনের উপর তারা শতকরা ৭০-৮০ভাগ কর বসাল। অপরদিকে নিজেদের যন্ত্রে বোনা মোটা কাপড়ের উপর থেকে সবরকম কর কমিয়ে ইউরোপের বাজার এমনকি ভারতের বাজারেও ঢুকবার চেষ্টা চলতে থাকল। পত্রপত্রিকায় চললো মসলিন নিয়ে নানান অপপ্রচার, মসলিনকে হেয় করে ছাপাতে লাগল নানা রকম ক্যারিকেচার। শুধু তাই নয়, কথিত আছে, দেশীয় তাঁতীরা যাতে মসলিন বোনার কৌশল পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে না পারে সেজন্য তাদের হাতের আঙুলও কেটে ফেলেছিল স্থানীয় ইংরেজ বণিকরা। এর প্রভাব মসলিন রপ্তানি হ্রাস পেল ব্যাপক ভাবে। ১৭৫৩ সালে পলাশীর যুদ্ধের আগে যেখানে বছরে শুধু মসলিনই রপ্তানি হয়েছিল তখনকার হিসেবে ২৮লক্ষ টাকার বেশি, ১৮০০ সালে সব ধরনের মিলিয়ে রপ্তানি হয় ১৮লক্ষ টাকার বস্ত্র যার মধ্যেে মসলিন ছিল একটি ক্ষুদ্র অংশ। এরপর বছরে গড়ে ৬লক্ষ টাকার বস্ত্র বাংলা থেকে রপ্তানি হত বিলাতে।
এভাবে ইংরেজ কুটকৌশল আর অত্যাচারের শিকার হয়ে ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয়ে যায় ঢাকার মসলিনশিল্প।