ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বড়লোক বাবুর রক্ষিতা হতে হয়েছিল তাকে। আর সেই রক্ষিতার পুরস্কার হিসেবেই পেয়েছিলেন তিন তিনটে বাড়ি। তিনটি বাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তা নিজের করে ধরে রাখার কোন ইচ্ছে ছিল না তার। বাড়ি তিনটির একটি তার রক্ষক বাবুর ছেলেকে এবং বাকি দুটো মৃত্যুর আগে কলকাতার বড়বাজার হাসপাতালকে উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
থিয়েটার! যাকে নাট্যমঞ্চ বলা হয়। ব্রিটিশ শাসন কালে ভারতবর্ষে এই থিয়েটার চর্চা আরো বিকশিত হয়। ১৯ শতকে ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য এই থিয়েটার শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সারা উপমহাদেশে বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠে এই থিয়েটার। উপমহাদেশে থিয়েটারের ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে রয়েছে কিছু নারীর জীবন। তাদের মধ্যে একজন নামকরা অভিনেত্রী হলেন এই তিনকড়ি ।
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর কলকাতায় তার জন্ম। মা ছিলেন একজন দেহ ব্যবসায়ী। লেখাপড়া তেমন একটা করেনি, বাল্যকাল থেকেই থিয়েটারের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। তিনকড়ি থিয়েটার করার সূযোগ পেয়ে আর হাতছাড়া করলেন না। টাকার অভাব, লাঞ্ছনা -বঞ্চনা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে অভিনয়কে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি।
গিরিশ চন্দ্র ঘোষ। বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগের স্রষ্টা। সর্বপ্রথম ১৮৭২ সালে গিরিশ চন্দ্র বাংলা পেশাদার নাট্য কোম্পানি ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। তারই ছাত্রী ছিলেন এই তিনকড়ি। গিরিশ ঘোষের ‘ বিল্ব মঙ্গল ‘ নাটকে নির্বাক সখীর অভিনয় দিয়েই তার নতুন জীবন শুরু হয়। তারপরে মীরাবাঈ নাটক থেকেই তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এমারেল্ড থিয়েটার ও সিটি থিয়েটারেও অভিনয় করতে শুরু করেন। শেক্সপিয়ারের ‘লেডি ম্যাকবেথ’-এ লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করে বিখ্যাত হন তিনি। দীর্ঘদিন বাংলার রঙ্গমঞ্চের সম্মানিত প্রধান অভিনেত্রী ছিলেন তিনকড়ি।
তিনকড়ি অভিনয়কে এতটাই ভালোবাসতেন যে, সেই সময় ২০০ টাকায় এক বাবুর রক্ষিতা হবার প্রস্তাব পেলে সে সজ্ঞানে তা প্রত্যাখান করেন। ঐ সময় অভিনয় করে মাত্র ২০ টাকা মাইনে পেতেন তিনি। এতো লোভনীয় সূযোগ পেয়েও হাতছাড়া করার জন্য তিনকড়ি তার মায়ের হাতে বাঁশের বেতের মারও খেয়েছেন এবং টানা তিন দিন জ্বরে ভুগেছিলেন।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। জীবনের শেষ ভাগে তাকে সেই রক্ষিতা হয়েই জীবন কাটাতে হয়েছিল। শোনা যায় রক্ষিতা হলেও বাবু সাহেব ও তার আত্মীয়স্বজনরা তাকে যথেষ্ট মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতেন।
দুঃখের বিষয় হল এই তিনকড়ির মত মানুষেরা যত ভালো কাজই করুক না কেন এগুলো মানুষ মনে রাখেনা। এদের জীবন হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব নাট্য দিবস ও বাংলা রঙ্গমঞ্চের দেড় শত বৎসর পূর্তি উপলক্ষে এক নাট্যোৎসবে দিল্লির বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন ঊনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় নটী তিনকড়ি দাসীর জীবনী অবলম্বনে লেখা- ‘তিনকড়ি দাসী দ্য লেডি ম্যাকবেথ’ মঞ্চস্থ করে। সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী, সুগায়িকা তিনকড়িকে প্রাণ ঢেলে তৈরি করে নেন গিরিশ ঘোষই। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ,তার শিক্ষক,তিনকড়িকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-
“বাংলা রঙ্গালয়ে তোমার যেমন কদর নেই, তেমনি তোমার দোসরও নেই। বাংলার মানুষ তোমাকে চিরটাকাল ‘লেডি ম্যাকবেথ’ হিসেবে চিহ্নিত করবেন।”
তবে, আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে আজকের আধুনিক যুগে এই নাটক, মুভি, থিয়েটার যে যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য এদের অবদান বিন্দু মাত্র কম নয়। এদের মত তিনকড়ির হাত ধরেই আজ আমরা বিনোদন জগতের নানা রকম সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারছি। তাদের পথ ধরেই একে একে সৃষ্টি হল পথের পাঁচালী থেকে শুরু করে হাওয়া নামক সিনেমার।
তথ্য ঋণ
সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৭৩,