দরিয়া-ই-নূর (শাব্দিক অর্থ আলোর নদী বা আলোর সাগর) ছিল নবাবদের রত্নরাজির মধ্যে সবচেয়ে উল্ল্যেখযোগ্য ও মূল্যবান অলংকার। দরিয়া-ই-নূর বাজুবন্ধরূপে ব্যবহার করা হতো। দরিয়া-ই-নূর প্রথমে দীর্ঘদিন মারাঠা রাজাদের অধিকারে ছিল। এরপর তা হায়দরাবাদের নবাব সিরাজ উল মুলকের পূর্বপুরুষদের হাতে আসে এক লাখ ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে।
এরপর দিল্লি মোগল সম্রাট খুব সম্ভবত হায়দরাবাদ থেকে এই হীরকখন্ডটি হস্তগত করেন।
১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যের বাদশাহ নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করে ময়ূর সিংহাসন, কোহিনূরসহ মূল্যবাদ ধনরত্ন লুট করে পারস্যে নিয়ে যান। বলা হয়, সে সময়ে কোহিনূর ও অন্যান্য রত্নরাজির সঙ্গে দরিয়া-ই-নূর চলে যায় পারস্যে।
পারস্যের নাদির শাহের পর পর্যায়ক্রমে তা আহমদ শাহ দূরবানি লাভ করেন। আহমদ শাহ দুররানির মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মাহমুদ শাহ জোর করে ক্ষমতা দখল করলে জ্যেষ্ঠপুত্র শাহ সুজা কোহিনূরসহ মূল্যবান ধনরত্ন নিয়ে কাশ্মিরে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন। সেই সময় রণজিত সিংহ শাহ সুজার কাছ থেকে দরিয়া-ই-নূর হীরাটি লাভ করেন।
রণজিত সিংহের মৃত্যুর পর দরিয়া-ই-নূর শেষ পর্যন্ত নাবালক রাজা দীলিপ সিংহের অধিকারে আসে। নাবালক রাজা দীলিপ সিং ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে হেরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।ব্রিটিশরা দীলিপকে কোহিনূর, দরিয়া-ই-নূরসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ তাদের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য করে।
১৮৫০ সালে লর্ড ডালহৌসি কোহিনূর, দরিয়া-ই-নূরসহ কিছু মূল্যবান অলংকার লন্ডনে হাইড পার্কের বিখ্যাত মহামেলায় প্রদর্শনের জন্য প্রেরণ করেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে মাহরা দীলিপ সিংহের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী শিখ রাজার সম্পদের ওপর ব্রিটিশদের অবৈধ হস্তক্ষেপ নিয়ে ১৮৫১ সালে প্রশ্ন তোলা হয়। এরপরই কোহিনূর ও কিছু মূক্তার মালা রানির জন্য রেখে দরিয়া-ই-নূরসহ অন্যান্য অলংকার ভারতে পাঠিয়ৈ দেওয়া হয় ১৮৫২ সালে।
এরপর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে কলকাতায় হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি সেগুলো ১৮৫২ সালের নভেম্বরমাসে নিলামে বিক্রি করে দেয়। ওই সময় খাজা আলিমুল্লাহ ৭৫ হাজার টাকায় দরিয়া-ই-নূর কিনে নেন। ভারতে এটি হ্যামিল্টন কোম্পানির হেফাজতে রাখা হয়েছিল। ভারত ভাগের পর তা ঢাকায় এনে ইম্পোরিয়াল ব্যাংক ইন্ডিয়ার ঢাকার শাখায় রাখা হয় । ১৯৬৬ সাল থেকে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (পরে সোনালী ব্যাংক) –এর সদরঘাট লকারে রাখা হয় দরিয়া-ই-নূর।
এখানে উল্লেখ করা দরকার দরিয়া-ই-নূর নামেই পারস্যের সম্রাটেরও একটি হীরা ছিল। সেটি এখন তেহরানে সেন্টাল ব্যাংক অব ইরানে রক্ষিত আছে। এটি আকারে ঢাকার নবাবের দরিয়া-ই-নূরের চেয়ে বড় এবং হালকা গোলাপি রঙের।
দুটোই ‘টেবল ডায়মন্ড’ হলেও এদের মধ্যে কোনোরকম মিল নেই। ব্রিটিশ জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি জানিয়েছে, প্রাকৃতিক ও বিশুদ্ধ হীরকখন্ডটি টেবিল আকৃতির, সমতল পৃষ্ঠ এবং মূল পাথরটি বর্ণহীন। মূল হীরাটির চারিদিক ছোট ছোট আরও ১০টি ডিম্বাকৃতির হীরকখন্ডকে সোনার ফ্রেমের সাহায্যে মূল হীরার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।