গণহত্যা বা জাতিনিধনের কথা আসলেই প্রথমে যে বিষয়টি আমাদের চোখের সামনে চলে আসে সেটি হল জার্মানির হিটলার ও তার ইহুদী নিধনের কুখ্যাত হলোকাস্ট গণহত্যার কলঙ্কজনক অধ্যায়ের কথা। যেখানে হত্যা করা হয়েছিল ৬০ লক্ষ ইহুদিকে। তবে জার্মানির আরও একটি কালো ইতিহাস রয়েছে যেটি করা হয়েছিল হিটলারেরও আগে। এডলফ হিটলার ক্ষমতায় আসার পূর্বেই জার্মানি একটি বড় গণহত্যা চালায় আফ্রিকার দেশ নামিবিয়ায়। ঐ গণহত্যার ইতিহাস আজ অনেকেই ভুলতে বসেছে। আফ্রিকার দেশ নামিবিয়ার দুইটি আদিবাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জার্মানি এই গণহত্যা পরিচালনা করে যাতে ঐ আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রায় ৮০% লোকের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। বিস্মৃতপ্রায় এই গণহত্যার ইতিহাস আজকের নৈবেদ্য।
গণহত্যার সময় শৃঙ্খলিত হেরো এবং নামা বন্দীদের একটি ছবি, Photo Credit: wikimedia
১৮৮৮ সালে জার্মানি আফ্রিকাতে তাদের উপনিবেশ স্থাপনের কাজ শুরু করে। এর অংশ হিসেবে তারা নামিবিয়াকে বেছে নেয়। প্রথমে তারা ধর্মকে ব্যবহার করে সেখানে প্রবেশ করে। জার্মান পাদ্রীরা সেখানে প্রথমে ধর্মের কথা বলে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে। তারপর তারা এই অবস্থান কে কাজে লাগিয়ে নামিবিয়ার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। এর অংশ হিসেবে প্রথমে জার্মানি নিজ বণিকদের সাথে নামিবিয়ার তৎকালীন শাসকদের একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করিয়ে নেয়। ফলে দ্বিতীয় ধাপের অংশ হিসেবে নামিবিয়াতে জার্মান বণিকরা প্রবেশ করে। প্রথমে তারা শুধু বাণিজ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করলেও ক্রমে তারা নামিবিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। তারা নামমাত্র মূল্যে নামিবিয়ার স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জমি কিনে নিতে থাকে এবং সেখানে জার্মানদের নিয়ে এসে বসতি গড়ে তোলে।এভাবে ক্রমে নামিবিয়ায় জার্মানি নিজেদের ভিত মজবুত করতে থাকে।
১৮৯৪ সালে থিওডর লিউটওয়েইনকে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার গভর্নর করে পাঠান জার্মান সম্রাট। এতে নামিবিয়ায় জার্মানদের নতুন যাত্রা শুরু হয়। তারা প্রায় সরাসরি নামিবিয়ায় শাসন কায়েম করে নেয়। একই সাথে স্থানীয় জনসাধারণের উপর চলতে থাকে অমানবিক অত্যাচার ও তাদের কৃষি ও গৃহপালিত পশু নিয়ে যাওয়াসহ শিশু/নারীদের উপর নির্যাতন।
সেখানে সেসব আদিবাসী বসবাস করত তাদের মধ্যে “নামা ও হেরেরো ” আদিবাসী প্রধান ছিল। প্রথমে নামাদের উপর অত্যাচার শুরু হলেও পরবর্তীতে হেরেরোরাই তাদের অত্যাচারের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। হেরেরো আদিবাসীরা তাদের পার্শ্ববর্তী খোয়েসেন গোত্রের লোকেদের দ্বারা অত্যাচারের স্বীকার হলে তারা বাধ্য হয়ে জার্মানদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তাদের গভর্নরের সাথে একটি সামরিক চুক্তি করে। এই সুযোগে জার্মানরা তাদের ভিতরে ঢুকে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে তারা হেরেরো আদিবাসীদের রক্ষা করার বদলে তাদের উপর অত্যাচার চালানো শুরু করে দেয়। তাদের নারীদের ধর্ষণ করে, কৃষি পণ্য লুট করে ও গৃহপালিত পশু নিয়ে যায়। আর এসবের বিরুদ্ধে হেরেরো পুরুষরা প্রতিবাদ করলে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে তাদেরকে হত্যা করতেও পিছপা হয়না উপনিবেশ জার্মান শক্তি। হেরেরোরা জার্মান সৈন্যদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গভর্নরের কাছে বার বার অভিযোগ দিয়েও যখন কোন ফল পাচ্ছিল না, তখন তারা জার্মানদের সাথে বিদ্যমান চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৮৮৮ সালে হেরেরোরা জার্মানির সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং তাদের থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্তি পাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়। প্রথমে তারা জার্মানদের সাথে সামরিক চুক্তি বাতিল করলেও ২ বছর পর আবার এই চুক্তি কার্যকর করার জন্য হেরেরোদের বাধ্য করা হয়। ফলে তারা চূড়ান্তভাবে জার্মানদের অধীনে চলে যায়।
জার্মানরা এই চুক্তির পর থেকে হেরেরোদের কে চড়া সুদে ঋণ দেয়া শুরু করে। একই সাথে কৌশলে হেরেরোদের জমিও দখল করতে থাকে। তারা কখনো নামমাত্র মূল্যে এই জমি ক্রয় করত আবার কখনো ঋণের টাকা না দিতে পেরে হেরেরোরা জার্মানদের জমি দিয়ে ঋণ হতে মুক্তি পেতো। আবার কখনো পেশী শক্তির বলে জার্মানরা জমি দখল করে নিতো। ১৯০৩ সালের মধ্যে জার্মানরা হেরেরোদের প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার জমি দখল করে নেয়। স্থানীয়দের নানা প্রকার ঋণেরর জালে ফেলে তাদের উপর অত্যাচার চালানো শুরু করে অর্থাৎ উপনিবেশ কায়েমের ষোলকলা পূর্ণ হয়। ১৯০৩ সালে জার্মানরা নামিবিয়ায় শাসনকে সহজ করার জন্য রেলপথ নির্মাণ ও সম্পূর্ণ নামিবিয়াকে দুইভাগ করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একই সাথে স্থানীয়দের উৎখাত করার জন্যও ছোট ছোট নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এসব নীলনকশা যখন নামিবিয়ার সাধারণ লোকের কাছে ফাঁস হয়ে যায় তখন তারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং জার্মানদের সমূলে নামিবিয়া হতে উৎখাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৯০৪ সালের ১২ জানুয়ারিতে হেরেরো গোত্রপতি স্যামুয়েল তার গোত্রের সাধারণ জনগণদের নিয়ে জার্মানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ঐদিনই জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে ১২৬ হেরেরো আদিবাসী প্রাণ দেন। এ খবর জার্মানিতে পৌঁছার পর সম্রাট কাইজার মেজর লিওতেইনকে সামরিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল লোথার ভন ত্রোথাকে। দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকায় আসার সময় ভন ত্রোথা সঙ্গে নিয়ে আসেন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ১৪ হাজার যোদ্ধা আর হেরেরোদের সমূলে উৎখাতের পরিকল্পনা।
১১ জুন ত্রোথার সেনারা ওয়াটারবার্গে ৩ থেকে ৫ হাজার হেরেরো যোদ্ধাকে ঘিরে ফেলে। আধুনিক অস্ত্রের মুখে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনি হেরেরোরা। পলাতকদের মরুভূমির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । পলায়নরত হেরেরোদেরকে যেখানে পাওয়া গেছে সেখানেই গুলি করে বা বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।এমনকি তাদের এই অত্যাচার থেকে বাদ পড়েনি নারী /শিশুরাও। একইসাথে অসংখ্য হেরেরো কে বন্দিও করা হয়। এরপর শুরু হয় সাধারণ /নিরীহ হেরেরোদের উপর অত্যাচার। তাদেরকেও ধাওয়া দিয়ে মরুভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর হাতের কাছে যাদের পাওয়া যায় তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে উপনিবেশ জার্মান শক্তি।
এদিকে যাদেরকে ওমাহেকে মরুভূমির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জার্মান সৈন্যরা তাদেরকে আর মরু এলাকা থেকে ফিরতে দেয়নি। দিনের পর দিন খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে শুরু করে হেরেরোরা। অভিযোগ রয়েছে, মরু এলাকায় যে কয়টি কূপ ছিল জার্মান সেনারা কৌশলে সেগুলোতে বিষ প্রয়োগ করে। বলা হয়ে থাকে যে শুধু ওমাহেকে মরুভূমিতেই পানিশূন্যতায় মারা গেছে ৫০ হাজারের অধিক হেরেরো। বেঁচে যাওয়া মাত্র এক হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হেরেরো নেতা স্যামুয়েল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ অধিভুক্ত এলাকা বেচুনাল্যান্ডে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
এদিকে পেছনে পড়ে থাকা এবং বন্দি মিলিয়ে মোট ১৫ হাজারের মত হেরেরো নামিবিয়ায় বাকি থাকে। জার্মান সেনাপতি তাদেরকেও রেহাই দেয়নি। নারীদের কে সমানে হত্যা করা শুরু হয়। গণহারে নারীদের হত্যা করার পিছনে প্রধান কারন ছিল – বিভিন্ন সময়ে জার্মান সৈন্যরা যে নারীদের ধর্ষন করেছে এর ফলে অনেক নারীই গর্ভবতী হয়ে গিয়েছিল। জার্মানরা চাইতনা যে হেরেরোদের সাথে তাদের রক্ত মিশ্রিত হোক এবং তাদের রক্ত বর্বর আফ্রিকানদের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হোক। অপরদিকে বন্দি থাকা পুরুষদের হত্যা করার জন্য যাতে গুলি ব্যবহার না করতে হয় সে জন্য তারা ফাঁসি দিয়ে হেরেরোদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তাছাড়াও নির্যাতন শিবিরে বন্দি হেরেরোদেরকে গবেষণাগারের গিনিপিগের মতো ব্যবহার করেছেন জার্মান জিন বিজ্ঞানী ইউজেন ফিশার। তিনি দেখতে চেষ্টা করেন, সেনাদের ধর্ষণে হেরেরো নারীদের গর্ভে জন্ম নেয়া শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে জার্মান পিতার মতো উৎকৃষ্ট হয় না। সুস্থ সবল বন্দিদের দেহে আর্সেনিক ও আফিমের নির্যাসসহ বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করতেন বোফিঙ্গার নামে এক চিকিৎসক। পরে তিনি অপারেশন করে তার ওষুধের প্রতিক্রিয়া দেখতেন। আরেক জার্মান প্রাণিবিজ্ঞানী লিওপার্ড সুলৎজ জানিয়েছেন, পরীক্ষা চালানোয় মৃত বন্দিদের দেহের বিভিন্ন অংশ স্তূপ হয়ে থাকতো। একে তিনি স্বাগতই জানাতেন। হেরেরোরা জাতিগতভাবে নিকৃষ্ট- এটা প্রমাণের জন্য নিহতদের তিনশ খুলি পাঠানো হয় বার্লিনে বিজ্ঞানীদের কাছে।
এদিকে ১৯০৫ সালে নামা উপজাতিরাও জার্মান উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে । নামাদের আত্মসমর্পণ করতে কঠোর ভাষায় চিঠি লেখেন ত্রোথা। তিনি এতে হেরেরোদের উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসেন এবং আত্মসমর্পণ না করলে সমূলে নামাদের বিনাশের হুমকি দেন। ১৯০৭ সালে নামারা আত্মসমর্পণ করে। এরপরও তাদের ওপর নেমে আসে জার্মানদের অমানবিক নির্যাতন। বন্দিদের শার্ক আইল্যান্ডের বন্দি শিবিরে পাঠানো হয়। নির্যাতন আর মৃত্যু এখানে এতোই বেশি ছিল যে, পরবর্তী সময়ে এর নাম হয়ে যায় ডেড আইল্যান্ড। অনাহার, নির্যাতন, আর রোগে শোকে এক মাসে এখানে মারা যায় ২৫২ জন বন্দি। তাছাড়াও ১৯০৫- ০৭ সালের মধ্যে বহু সংখ্যক নামাকেও জার্মানির সৈন্যদের হাতে প্রাণ দিতে হয়।
জার্মানদের এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর পূর্বে হেরেরো ও নামা মিলিয়ে নামিবিয়ার মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১লক্ষাধিক যা কয়েক বছরের মধ্যে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৮-২০ হাজারের মধ্যে। অর্থাৎ এই সময়টিতে নামিবিয়ার প্রায় ৮০ হাজার জনগণকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করা হয়।
গণহত্যার জন্য জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে নামিবিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছে এবং ১১০ কোটি ইউরো ক্ষতিপূরণও দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে নামিবিয়ার আদিবাসী নেতারা মনে করেন যে বর্বরতা চালিয়েছে জার্মানি সে তুলনায় এই ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও উপনিবেশিক আমলে চলা এই গণহত্যার দায় স্বীকার ও ক্ষমা চাওয়া ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ। ইউরোপীয় কলোনিয়াল গোষ্ঠীর নগ্ন ইতিহাস উন্মোচনের এক জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে থাকবে নামিবিয়ার এই ভুলে যাওয়া গণহত্যা।