বাংলাদেশ বিমানে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপদে অবতরন করে হোটেলের বাসে রওয়ানা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। পরদিন সকালে আমরা বের হলাম দর্শনীয় জায়গাগুলি দেখার জন্য। আসলে কাঠমান্ডু উপত্যকা তিনটি শহরের সমষ্টি – কাঠমান্ডু, পাতন ও ভক্তপুর। কাঠমান্ডু নেপালের অর্থনীতির কেন্দ্র এবং সাতটি পবিত্র-মন্দিরের সমন্বয়ে গড়া। এই সাতটি পবিত্র-মন্দিরকেই ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান-হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উপত্যকাটিতে রয়েছে অনেক স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য ।
এর মধ্যে কাঠমান্ডু দরবার চত্বর, আকাশ ভৈরব, আশানের কথা বিশেষভাবে বলা যায়।
পাটন —-
এটি ললিতপুর নামেও পরিচিত। কাঠমান্ডু থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে, সুন্দর সূক্ষ কারিগরদের আবাসস্থল, যাঁরা এখনও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে প্রাচীন কৌশল অবলম্বন করেন। মহাবৌদ্ধ হল পাটনের একটি বৌদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, যেটি দেখতে অসাধারণ সুন্দর। এখানে ভগবান বুদ্ধের হাজার হাজার ছবি খোদাই করা আছে। পাটন এমন একটি জায়গা, যেখানে একসাথে হিন্দু ও বৌদ্ধদের দেখা যায়। দুই ধর্মের মিলনে গড়া এমন নিদর্শন পৃথিবীর আর কোথাও নাই। ভক্ত বা উপাসকদের শহর ভক্তপুরও কাঠমান্ডু উপত্যকার একটি অংশ।
কাঠমুন্ডুর দরবার স্কয়ার হল —-
কাঠমান্ডু দরবার চত্বর হল নেপালের একটি খুবই বিখ্যাত একটি জায়গা।এই অঞ্চলের শাসনকারী শাহ এবং মল্ল রাজাদের প্রাসাদগুলি রয়েছে। এটি ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত নেপালের রাজাদের রাজকীয় বাসভবন ছিল। গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলি এখানে অনুষ্ঠিত হত এবং সেই ঐতিহ্য এখনও চলে আসছে। এই জায়গাটি কাঠের কাজের জন্য বিখ্যাত। মুগ্ধ হয়ে সেই কাঠের কারুকাজগুলি দেখলাম।
প্রাসাদটি মহেন্দ্র মিউজিয়াম ও রাজা ত্রিভুবন মেমোরিয়াল মিউজিয়াম-এর সমন্বয়ে গড়া।
লুম্বিনি—-
গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান বলে এই জায়গিটিকে পবিত্র হিসাবে মানা হয়। গৌতম বুদ্ধের মা মায়াদেবীর নামানুসারে এখানে ‘মায়া দেবী মন্দির’ নামে একটি মন্দির আছে।
পশুপতিনাথ মন্দির—
এটি একটি বিখ্যাত পবিত্র হিন্দু মন্দির যেটি বাগমতী নদীর তীরে অবস্থিত। এই মন্দিরে হিন্দুদের দেবতা পশুপতিনাথের পূজা করা হয়। এই মন্দির কমপ্লেক্সটি ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
মূল মন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশ নিষেধ। তিনদিন ধরে ঘুরে ঘুরে সব দর্শনীয় জায়গাগুলি দেখা হল। এখানকার মানুষগুলি খুব বন্ধু ভাবাপন্ন। জানলাম এখানে হিন্দু এবং বৌদ্ধরা মিলেমিশেই তাদের ধর্মকর্ম করে। এরপর আমরা ঠিক করলাম পোখারা যাবো, পোখারাকে বলা হয় নেপালের রানী।এটা দেখা না হলে নেপাল আসাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কাঠমান্ডু থেকে পোখারা দুইভাবে যাওয়া যায়। একটা হচ্ছে বাই এয়ার, আরেকটা বাই রোড। আমরা বাই রোড বেছে নিয়েছিলাম। ভাগ্যিস নিয়েছিলাম, না হলে পাহাড়ের এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি অজানাই থেকে যেত!
যখন গাড়িতে করে পোখারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে কাটা রাস্তা দিয়ে উপরে উঠছে আর প্রকৃতির চোখজুড়ানো শোভাগুলি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মেঘগুলি কখনো গাড়ির সামনে চলে আসছে তো কখনো আশেপাশে উড়ে বেডাচ্ছে….আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন স্বপ্নের রাজ্যে ঢুকে পড়েছি।
রাস্তার একপাশে পাহাড়, আর একপাশে গভীর খাদ, দেখলে গা শিউরে উঠে। গাড়ি চালাতে যদি এতটুকু ভুল চুক হয় তাহলে সোজা গাড়িসহ সেই অতল খাদে পড়তে হবে। দূর্ঘটনা যে ঘটেনা তা নয়, মাঝে মাঝে এইসব রাস্তায় কিছু দূর্ঘটনাও ঘটে। পোখারা যাবার রাস্তায় গাড়ী যখন শহর ছাড়িয়ে উপরের দিকে উঠছে দুই পাশের বাড়িঘর গুলি হুহু করে নীচে চলে যাচ্ছে! গাড়ি যত উপরে উঠছে, নীচের জিনিষগুলি এত ছোট হয়ে যাচ্ছে, যেন পটে আঁকা!
রাস্তার পাশের গভীর খাদগুলি দেখে মাথা ঘুরে যায়। এরা পাহাড় কেটে এমনভাবে রাস্তা বানিয়েছে যে দুর থেকে বোঝাই যায়না। যেতে যেতে দেখলাম রাস্তার অনেক নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। শুনেছি বর্ষাকালে এসব নদী খুব ভয়ংকর হয়। এই হাল্কা বৃষ্টিতেই দুরের জিনিষগুলি কুয়াশার মতো ঝাপসা ঝাপসা লাগছিল। বেশ উপরে ওঠার পরে দেখা গেল বিরাট বিরাট সব দেবদারু আর ইউক্যালিপটাস গাছ। বাতাসের ঝাপটায় গাছগুলি একটা আরেকটার গায়ে হেলে পড়ছে।
এখানে খন্ড খন্ড মেঘগুলি মনের আনন্দে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঝিরিঝির বৃষ্টি আর বাতাসের সাথে গাছেদের দোল খাওয়া,আর মেঘেদের আনাগোনা.. যেন একসাথে কোন উৎসবে মেতেছে! মাঝখানে একবার রাস্তার ধারের খাবার হোটেলের সামনে গাড়ি থামাল । আমরা ওয়াশরুমে গিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে এসে দোতলায় গিয়ে দেখলাম চারপাশ খোলা,পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে ড্রাইভারসহ দুপুরের খাবারটা খেয়ে আবার আমরা রওয়ানা দিলাম।যখন পোখারার রিসোর্টে পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়ে গেছে। ড্রাইভার বললো এখানে সে আমাদের ডিউটি করবেনা, কারন এতটা পথ পাড়ি দেয়ার জন্য তার গাড়ি সার্ভিসিং করতে হবে আর আমরা যে চারদিন থাকবো সেই কদিন সে অন্য কাজ করবে।
আমাদের ডিউটি করবে অন্য আরেকজন ড্রাইভার, ট্যুরিষ্ট স্পটগুলো সেই আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে। যদি প্রয়োজন হয় তাই সে তার ফোন নাম্বার আমাদেরকে দিয়ে চলে গেলো। পরের দিন সকাল থেকে শুরু হলো আমাদের ‘সাইটসিয়িং’।
ফেওয়া লেক—
এটি নেপালের একটি বৃহত্তম লেক, চারিদিকে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য। লেকের মাঝখানে রয়েছে ‘বারাহি হিন্দু মন্দির’। এছাড়াও দেখলাম ‘ডেভিস ফল’ মহেন্দ্র গুহা’, ‘শরনকোট’ ‘ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেইন মিউজিয়াম’ ‘গুরখা মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’ তিব্বতিয়ান ‘বুদ্ধিজম মনেষ্ট্রী’। ফাঁকে ফাঁকে কিছু কেনাকাটাও করলাম, এখানকার পশমিনা শালগুলি ভারি সুন্দর। শুনেছি খাঁটি পশমিনা আংটির ভিতর দিয়ে পার করা যায়। আংটি খুলে পরীক্ষা করে দেখলাম, সত্যি অভিভূত হলাম!
পোখারা ছাড়ার আগের দিন গেলাম পাহাড়ের উপরে যে শান্তি স্তুপা রয়েছে সেটি দেখতে। সেখানে উঠতে গিয়ে আমাদের দম শেষ! সিঁড়ি আর শেষ হয়না, মাঝে মাঝে একটু বসে পানি খাই আর দম নিতে থাকি। অবশেষে যখন উপরে উঠলাম তখন কষ্টের কথা ভুলে গেলাম। কি সুন্দর ভিউ, পুরা পোখারা এখান থেকে দেখা যায়।
একদিন গেলাম ফেওয়া লেকেও যাওয়া হলো নৌকা ভ্রমনে, নৌকায় চড়ার আগে লাইফ জ্যাকেট পরতেই হবে। এখানেও অপূর্ব সুন্দর সব প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমাহার ড্রাইভার আমাদের রিসোর্টে ফিরিয়ে আনার পথে বলল, রাত তিনটায় সে আমাদের নিতে আসবে সূর্যোদয় দেখার জন্য। এমনিতে সারাদিন ঘুরাঘুরি করে আমাদের পায়ে ব্যাথা হয়ে গিয়েছে, তারমধ্যে আবার মাঝরাতে উঠতে হবে শুনে আমার বর বলল, না, না আমরা মাঝরাতে উঠতে পারবোনা, সূর্যোদয় দেখার দরকার নাই।
সে আমাদের কথা শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। আমাদের রিসোর্টে নামানোর পর আবার বলল, রাত তিনটায় সে আমাদেরকে নিতে আসবে, আচ্ছা নাছোড়বান্দা ! এবার আমিই বললাম আচ্ছা ঠিক আছে, ঐ সময় আমরা রেডি থাকবো, আপনি চলে আসবেন। আমরা রাত দুইটায় উঠে রেডি হয়ে নিলাম, কাঁটায় কাঁটায় রাত তিনটায় সে এসে হাজির। বের হবার সময় দেখলাম রিসোর্টের প্রায় সব অতিথিই রওয়ানা হচ্ছে সূর্যোদয় দেখার জন্য। ফেব্রুয়ারি মাস, পাহাড়ি এলাকা, বেশ ঠান্ডা। ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য ভালমতো গরম কাপড় পরে রওয়ানা হলাম। জায়গামতো গিয়ে দেখলাম লোকে লোকারন্য।
কিছু মানুষ তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছে, বিক্রিও হচ্ছে! ফ্লাস্কে চা নিয়ে স্থানীয় মহিলারা চা বিক্রি করছে। গাড়ি থেকে নেমে উঁচু একটা পাহাড়ের মতো জায়গায় উঠে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি কখন সূর্যোদয় হবে তার জন্য। দু’একজন বলল, তারা নাকি আগের দিন এসে সূর্যোদয় দেখতে পায়নি মেঘের জন্য । দেখি আজ দেখা যায় নাকি! খোলা জায়গা , শনশনে বাতাস, অন্ধকার কাটেনি, চারপাশ ঝাপসা ভাবে দেখা যাচ্ছে। লোকজন ক্যামেরা বের করে খচাখচ তারই ছবি তুলেছ, সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা ক্যামেরা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম তাই মোবাইলেই কিছু ছবি তুললাম।
অবশেষে সূর্যের প্রথম ছটা পড়লো শ্বেত- শুভ্র বরফের ‘ফিসটেল’ ( এটি মাছের লেজের মতো দেখতে তাই তার নাম ফিসটেল) পাহাড়টার গায়ে। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাই দেখতে লাগলাম, ছবি তোলার কথা মনেও আসেনি। কেমন দেখলাম সেই উপমাটা আমি আমার মত করেই দিচ্ছি—আগুনের শিখা ছাড়া কয়লার গনগনে লাল আঁচের মতো তার আভা, সে এক অপূ্র্ব দৃশ্য, না দেখলে ভাষায় বর্ননা করা যায়না।আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়ছে বরফের পাহাড়ের গায়ে। তখনই মনে হলো ছবি তোলার কথা, তা তুললাম কয়েকটা ছবি। কিন্তু এখনও দুঃখ লাগে কেন প্রথমেই ছবিগুলি তুললামনা!
আসলে কিছু সৌন্দর্য এমন আছে যা মানুষকে বিহ্বল করে দেয়, তাকে প্রানভরে দেখার জন্য সে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তারই দিকে আকৃষ্ট করে রাখে। ফেরার পথে সেই ড্রাইভারকে অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলাম, সে নাছোড়বান্দার মতো আমাদের নিয়ে না গেলে আমরা এই অপার্থিব সৌন্দর্য দেখা থেকে বন্চিত হতাম। আমরা ফিরে আসার প্রায় দেড়মাস পরে নেপালে ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প দেশটিতে আঘাত হানে।এর ফলে সব স্থাপনা গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হতাহতের ব্যাপারে সরকারী ভাবে বলা হয় সেই ভূমিকম্পে ৭,৭৪৯ জন মৃত, আর ১৭,২০০ জন আহত হয়।