খ্রিস্টপূর্ব ১২৫৮ সালের একটি বিশেষ দিন। বহু বছর ধরে চলমান এক শত্রুতার অবসান ঘটতে যাচ্ছে আজ, যে শত্রুতা চরম সীমায় পৌঁছেছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৫ সালে সংঘটিত কাদেশের যুদ্ধে। মিশর ও হিট্টাইট সাম্রাজ্যের মধ্যকার বিবাদের চূড়ান্ত শেষ হতে যাচ্ছে আজ। আজই স্বাক্ষরিত হবে ইতিহাসের প্রথম শান্তিচুক্তি, যার পেছনে মূল অনুঘটক একটি বিয়ে, মিশরের ফারাও এর সাথে হিট্টাইট রাজকুমারীর বিয়ে।
এই বিয়ে কোনো সাধারণ বিয়ে ছিলো না। এতে জড়িত ছিলো রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থ এবং দুই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ। নানাবিধ নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সংঘটিত এই বিয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্যিক নির্ভরশীলতাকে সুদৃঢ় করেছিলো। তবে তা হিট্টাইট রাজকুমারীর ব্যক্তিজীবনে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছিলো, সে সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনা কখনও হয় নি।
কাদেশের যুদ্ধে হিট্টাইটদেরকে পরাজিত করার পূর্ণ দাবি করেছিলেন মিশরের রাজা দ্বিতীয় রামেসিস। কিন্তু হিট্টাইটরা কোনোদিনই এই পরাজয় স্বীকার করেন নি। তারা প্রতিনিয়তই কাদেশের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে গিয়েছেন। অবশেষে এই যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবেই একটি শান্তিচুক্তি গঠনের প্রস্তাব করেন হিট্টাইট রাজা তৃতীয় হাতুসিলি, যা ‘কাদেশের শান্তিচুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে হিট্টাইট রাজা তৃতীয় হাতুসিলির সঙ্গে তার স্ত্রী রাণী পুদুহেপার স্বাক্ষরও ব্যবহৃত হয়েছিলো, যা ছিলো ইতিহাসের প্রথম নারী স্বাক্ষরের দৃষ্টান্ত। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে হিট্টাইটদের পতনের আগ পর্যন্ত এই চুক্তি বহাল ছিলো।
কাদেশের চুক্তিতে বেশ কয়েকটি শর্ত ছিলো। তবে উল্লেখযোগ্য শর্তগুলো হলো- মিশরীয় ও হিট্টাইটদের মধ্যকার বাণিজ্যিক স্বাধীনতা এবং এক রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া তাদের সীমানার অভ্যন্তরে অপর রাষ্ট্রের নিজেদের ঘাঁটি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা। আগেই বলা হয়েছে, কাদেশের শান্তিচুক্তি সংঘটিত হয়েছিলোই একটি বিয়েকে কেন্দ্র করে। বিয়ের প্রস্তাব হিট্টাইট রাজার কাছ থেকেই এসেছিলো। নিজের মেয়েকে মিশরের রাজার সাথে বিয়ে দিয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে তিনি মজবুত করতে চেয়েছিলেন। তবে রামেসিসের দূতরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে, তিনি হাতুসিলির অন্য কোনো মেয়েকে নয়, শুধুমাত্র বড় মেয়েকেই বিয়ে করতে চান।
১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা হিট্টাইট রাজধানী হাত্তশার সংরক্ষণশালা থেকে বেশ কিছু মাটির ট্যাবলেট উদ্ধার করেছিলেন, যেখানে এই বিয়ে নিয়ে দুই রাজ্যের মধ্যকার দাবী-দাওয়া ও যুক্তি-তর্কের এক বিশাল বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। ভেজা কাদামাটির এই ট্যাবলেটগুলোতে কীলক আকৃতির কোনো সূঁচালো যন্ত্র দিয়ে কিউনিফর্ম লিপিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো এসব ঘটনা। এই বিয়ের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও যুক্তি-তর্কে হিট্টাইটদের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন রাজকুমারীর মা হিট্টাইট রাণী পুদুহেপা।
ট্যাবলেটগুলো থেকে এ-ও জানা যায়, ফারাও রামেসিস নিজের মর্যাদা নিয়ে ভীষণ গর্বিত ছিলেন, তাই তিনি তার দূতদের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে মিশরে পাঠাতে হিট্টাইট রাজাকে বাধ্য করেছিলেন। এ ছাড়াও হিট্টাইট রাজকুমারীর সাথে যৌতুক হিসেবে প্রেরিত সামগ্রীর পরিমাণ নিয়ে রামেসিসের দূতরা তার পক্ষ থেকে অসন্তোষ জানিয়েছিলেন। এতে বিচক্ষণ রাণী পুদুহেপা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তিনি ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। পুদুহেপা বলেন, “আমার ভাইয়ের সম্পদ কি এতোই কম যে, তিনি আমার সম্পদের ওপর নির্ভর করে ধনী হতে চাচ্ছেন? এটি কি ফারাও এর মাহাত্ম্য ও মর্যাদার লঙ্ঘন নয়?” পুদুহেপা আরও বলেন, “আমার মেয়ের বিয়ের যৌতুকটি ব্যবিলনের রাজার সম্পদের চেয়েও আকর্ষণীয় হবে”। পুদুহেপা বিয়ের যৌতুক হিসেবে নিজের মেয়ের সঙ্গে ক্রীতদাস, সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জ, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি সামগ্রী পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন ফারাওকে।
হিট্টাইট পক্ষের প্রধান দাবি ছিলো যে, রাজকন্যাকে ফারাও এর প্রধান স্ত্রীর মর্যাদা দিতে হবে। অর্থাৎ হিট্টাইট রাজকুমারীকে অন্যান্য নিকটবর্তী প্রাচ্যের রাজকন্যাদের মতো নিছক কোনো গৌণ পত্নী বানিয়ে রাখা যাবে না, যারা ফারাও এর হারেমে যোগ দিয়েছিলেন। ফারাও রামেসিস কিন্তু শুধু এই একটি দাবীই মেনে নিয়েছিলেন, অন্য কোনো কিছুতেই ছাড় দিতে তিনি রাজি ছিলেন না।
মিশরীয় ফারাওরা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিদেশী রাজকন্যাদের সাথে বিয়েতে আবদ্ধ হচ্ছিলেন। দ্বিতীয় রামেসিসের নিজেরই পাঁচটি অ-মিশরীয় স্ত্রী ছিলেন। তবে মিশরীয় নারীদেরকে কখনোই বিদেশে বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয় নি। আসলে চিঠিপত্র বিনিময়ে ফারাও এর আচরণ অত্যন্ত বিনম্র মনে হলেও তারা সব সময় ক্ষমতার উঁচু আসনে অধিষ্ঠানের মর্যাদা নিয়ে গৌরব প্রকাশে ইচ্ছুক ছিলেন।
দ্বিতীয় রামেসিস মিশরের সিংহাসনে প্রায় ৬৫ বছরেরও বেশি সময় রাজত্ব করেছিলেন। খুব কম শাসকই এতো দীর্ঘ সময় রাজত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই তিনি ‘রামেসিস দ্য গ্রেট’ উপাধিও লাভ করেছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব ১২৪৯ সালে তার রাজ্যাভিষেকের ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি রাজকীয় জয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করা হয়। মিশরীয়রা এই অনুষ্ঠানকে ডাকতেন ‘হেব সেড’ নামে। ত্রিশতম জয়ন্তীর এই উৎসব পালনের জন্য রামেসিস বেছে নিয়েছিলেন মিশরের নতুন রাজধানী ‘পাই-রামেসিস’কে।
খ্রিস্টপূর্ব ১২৪৬ সালে হিট্টাইট রাজকুমারী হাত্তশা ত্যাগ করেন এবং পাই-রামেসিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার সঙ্গে কিছু দূর পর্যন্ত সহযাত্রী হিসেবে গিয়েছিলেন তার মা রাণী পুদুহেপা। রামেসিসের কাছে একটি চিঠিতে হাতুসিলি লিখেছিলেন, “নববধূ যাত্রার জন্য প্রস্তুত, ফারাও এর দূতেরা সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী সীমান্তে তার সাথে দেখা করতে যেতে পারে। তারা আমার মেয়ের মাথায় সূক্ষ্ম তেল দিয়ে অভিষেক করুক এবং তাকে মিশরের মহান রাজা, আমার ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে যাক!” এটি নববধূকে সম্মানিত করবার জন্য নিকট প্রাচ্যের একটি প্রচলিত নিয়ম।
রাজকন্যার আগমনের খবরে রামেসিস আনন্দিত হয়েছিলেন। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “সূর্য দেবতা, ঝড়ের দেবতা এবং মিশরীয় ও হিট্টাইটদের দেবতাদের আদেশে দুটি মহান সাম্রাজ্য চিরকালের জন্য একত্রিত হতে যাচ্ছে”।
যাত্রাপথে রাজকন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্যই রাণী পুদুহেপা তার সঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু হিট্টাইট রাজা হাতুসিলি মেয়ের সঙ্গে যান নি। কেননা মিশরে তার উপস্থিতি উচ্চতর ক্ষমতাবান ফারাও এর সামনে নত হবারই শামিল। তাই তিনি নিজের অনুপস্থিতিতেই মেয়েকে বিয়ে দিতে মনস্থির করেছিলেন।
সুচতুর রামেসিস কিন্তু বিয়ের নথিভুক্ত করার সময় এই অনুপস্থিতিকে উপেক্ষা করেছিলেন। আবু সিম্বেলে রামেসিসের মন্দিরের বিয়ের স্টেলায় হিট্টাইট রাজাকেও তার মেয়ের পাশে দেখানো হয়েছে এবং এ-ও বলা হয়েছে যে, হিট্টাইট রাজা ও রাজকন্যা উভয়েই ফারাও এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
বিয়ের স্টেলায় আরও লেখা ছিলো, হিট্টাইট রাজকুমারীর মিশরে পৌঁছানোর জন্য পাহাড়-পর্বতের কঠিন পথটিকে বেছে নেয়া হয়েছিলো। আর তাই সফরটি শেষ করতে তাদের প্রায় তিন থেকে ছয় মাস সময় লেগেছিলো। রাজকুমারীর আগমনোৎসবটি পাই-রামেসিসেই পালিত হয়েছিলো।
অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ১২৪৫ সালে সম্পন্ন হয় মিশর ও হিট্টাইট সাম্রাজ্যের সন্ধির স্বার্থে সংঘটিত রাজকীয় বিয়েটি। বিয়ের পর হিট্টাইট রাজকুমারী মিশরীয় নাম ‘মাথর্নফেরিউরি’ গ্রহণ করেন। ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত হন। তার আসল নাম কি ছিলো, তা আর জানা যায় নি। শর্ত অনুযায়ী মাথর্নফেরিউরিকে রামেসিসের প্রধান স্ত্রীর সম্মান দেয়া হয়। কিন্তু একটি শিলালিপি থেকে প্রমাণ মিলেছে যে, এক পর্যায়ে মাথর্নফেরিউরি এল ফাইয়ুমের দক্ষিণে গুরোব হারেমে বসবাস শুরু করেছিলেন, যার অর্থ হতে পারে, তিনি প্রধান স্ত্রী হিসাবে তার মর্যাদা হারিয়েছিলেন।
মাথর্নফেরিউরি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে তার কিছু দিন পরই তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর সন্ধি রক্ষার্থে আরও একজন হিট্টাইট রাজকন্যাকে পাঠানো হয়েছিলো মিশরের নববধূ হিসেবে।
নানাবিধ নাটকীয়তায় সম্পন্ন এই রাজকীয় বিয়ে, রাণী পুদুহেপা কিংবা রাজা হাতুসিলির বক্তব্য, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে অসংখ্য আলোচনা হলেও জানা যায় নি মাথর্নফেরিউরির কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। তার সুখ-দুঃখ, আশা-অভিলাষা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজনই কেউ মনে করেন নি। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, হিট্টাইট সমাজে নারী হিসেবে তিনি যে মর্যাদা পেয়েছিলেন, তা তিনি মিশরের রাণী হিসেবে কখনোই পান নি। দ্বিতীয় রামেসিস তার কোনো স্ত্রীকেই কখনো হিট্টাইটদের মতো সম্মান দেন নি। মাথর্নফেরিউরির ক্ষেত্রেও রামেসিসের মূল মনোযোগ ছিলো নববধূর সাথে আসা যৌতুক নিয়ে। তা ছাড়া ফারাও এর স্ত্রীর এতো কম বয়সে মৃত্যুর ঘটনাটিও অনেক প্রশ্নেরই জন্ম দিতে পারতো। আমি মনে করি, এসব অবহেলিত মিশরীয় রাণীদের ব্যক্তিজীবন নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিৎ, যা আমাদেরকে তাদের অবস্থান ও চিন্তাধারা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিবে।
রেফারেন্স: