(প্রথম পর্ব)

বাংলায় মুসলমানদের আগমন কবে সে বিষয়ে কথা বলতে গেলে একটু পেছন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন। প্রাচীন বাংলার সঙ্গে বহির্বিশ্বে যােগাযােগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌযান। এসময় যােগাযােগের ক্ষেত্রে প্রধানত দু’টি উদ্দেশ্য কাজ করতো। যথা : বাণিজ্য এবং ধর্মপ্রচার। সেই সময়কার নানাবিধ সুফতানীযোগ্য পণ্যের মধ্যে ঢাকাই মসলিন ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। ইতিহাস গ্রন্থ পাঠে একথা জানতে পারা যায় যে, প্রাচীন অ্যাসিরীয় এবং ব্যাবিলনে ঢাকাই মসলিন সুনাম অর্জন করেছিলাে। কথাটি বার্ডউড প্রমুখ স্বনামধন্য পণ্ডিতদের পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। উইলফোর্ড মন্তব্য করেন যে, একটি ব্যাবিলনীয় বস্ত্র ফিরিস্তিতে ঢাকাই মসলিনের নাম উল্লেখ রয়েছে।

১৭৮৩ সালে মেরি এন্টোইনেতে তাঁর বিখ্যাত মসলিন পোশাক পরিহিতা অবস্থায় চিত্রকর্ম

এছাড়া প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় আমাদের মসলিন বিশেষ অবদান রেখেছে বলেও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬২ সালে মিসরের অষ্টাদশ রাজবংশের সমাপ্তিকালে বেশিরভাগ মমি মসলিনে মোড়ানাে হতাে। (ভারত বর্ষের ইতিহাস, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পূ. ১৫২)। এক সময় সমৃদ্ধ রােম নগরীর মহিলারা তাদের বিলাদ্রব্যের মধ্যে মসলিনকে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসাবে বিবেচনা করতেন বলে ড. উরে  “Cotton Manufacture of Great Bretain”  উল্লেখ করেছেন। প্লীনি (খ্রি. ২৩ বা ২৪-৭৯) তার রচনায় বাংলার মসলিনের কথা উল্লেখ করেছেন।জে এফ রয়েল তার “History of Cotton” গ্রন্থের মধ্য দিয়ে আমাদের জানান যে, প্রাচীন গ্রীকদের নিকট মসলিন অপরিচিত ছিল না। গ্রীক যুবকগণ যে মসলিন ব্যবহার করতেন তার ঐতিহাসিক প্রমাণও রয়েছে। খ্রি. পূ. ৩য় শতকের দিকে মেগাস্থিনিসের বর্ণনার মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশের লােকদের মসলিন ব্যবহার প্রসঙ্গে জানা যায়। গ্রীক দার্শনিক এরিয়ান (১ম অথবা ২য় খ্রি.) এক ধরনের রঙ্গিন মসলিনের কথা বলেছেন, যেগুলাে আরব ও পূর্ব আফ্রিকার সকল উপকূলস্থ বন্দরসমূহে রফতানী হতাে। (বার্ডউড Industrial art of India. পৃ. ২৪৩)।

ফ্রান্সিস রেনাল্ডি অঙ্কিত বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘লেডি ইন মসলিন’ এর একটি ছবি, ঢাকা, ১৭৮৯।

খ্রিষ্টীয় ৬৩ সালে রচিত পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থ মসলিনের কথা বলা হয়েছে। এ সকল বিচিত্র তথ্য পাঠে জানা যায় যে, তখন সারা পৃথিবীতে ঢাকার তাঁত শিল্প প্রাধান্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল । খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পর্যটক সােলায়মান, ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে মার্কোপলো, পঞ্চদশ শতাব্দীতে মাহিয়েনের বর্ণনার মধ্য দিয়ে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সেই সুদূর প্রাচীনকাল হতে বাংলার সঙ্গে গ্রীক, রােমান, মিসরীয়, আরবীয় কিংবা আফ্রিকার বণিকদলের অবাধ যােগাযােগ ছিল। কোন কোন ইতিহাসবিদ এমনটিও বলেন যে, হযরত মােহাম্মদ (সা.)-এর সময়কালে আরবের ঐতিহ্যবাহী ও ওকাখ মেলায় ঢাকার মসলিন বক্রি হতাে।

( (দ্বিতীয় পর্ব)

অষ্টম শতক কিংবা তারও আগে বর্তমান নরসিংদী অঞ্চল হতে পথে প্রচুর তামারুন (তামারুন আরবী শব্দ, যার অর্থ তেঁতুল) বহির্বিশ্বের নানা দেশে রফতানী হতো। বলা প্রয়ােজন, এই তামারুল হতেই তেঁতুলের ইংরেজী প্রতিশব্দ টামারিন্ড’ এসেছে। আজকের ভৈরব নদীর নামটিও আরবী বাহার-ই-আব (নদী বন্দর)-এর বিকৃত উচ্চারণ মাত্র। মুসলমান প্রাচীনকালে আরব বণিক প্রসঙ্গে পরে আসছি। উপরের সংক্ষিপ্ত এই আলােচনায় এটুকু স্পষ্ট যে, এই অঞ্চলে আরবীয় বণিক শ্রেণীর যাতায়াত কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হযরত মােহাম্মদ (সা.)-এর জন্মকাল ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের বহু পূর্ব হতেই নৌপথে আরবসহ সকল উন্নত বিশ্বের দেশগুলাের অবাধ যাতায়াত ছিল। ইতিহাস পুস্তকে দেখলাম, সেই সুদূর বরফ যুগেও নাকি আজকের শ্রীলংকার সংগে বহির্বিশ্বের একটা যােগসূত্র ছিল। যেখানে বরফ যুগেও যােগাযােগের কথা উচ্চারিত হচ্ছে সেখানে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের ইতিহাস ধরা হচ্ছে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয় কিংবা একই সময়কালে আলী মেচদের বাংলায় আগমনের মধ্য দিয়ে। ঠিক এই পর্যায়ে সম্মানিত পাঠকগণ একটু ভাবুন। গ্রীক, রােমান, আরব, মিসরীয় সকলেই সেই প্রাচীনকাল হতে বাংলার সংগে তাদের যােগসূত্র অব্যাহতভাবে বজায় রাখলেন। কেবল মুসলমানরাই সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মত সমুদ্রের অতল গহনে হারিয়ে গেলেন। অথচ কলম্বাসরা মুসলমানদের দিক-নির্দেশনা নিয়ে আমেরিকা পৌছলেন, মুসলমানদের সাহায্য নিয়েই ভাস্কো-দা গামা ভারতের কালিকট বন্দরে পৌছলেন । তাদের বাংলায় পৌঁছার জন্য ১২০৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল! আমাদের ঐতিহাসিক (?)গণ এভাবেই ইতিহাগ্রন্থ এবং পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন এবং করছেন। তারা নিশ্চিত যে, ওইসব আরবীয়দের মধ্যে কোন মুসলমানই ছিলেন না। যারা এসেছেন তারা কেবলই আরবীয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? এখন আমরা সেটাই দেখতে চেষ্টা করবো। এলফিন স্টোন নামক একজন ঐতিহাসিক বলছেন, ইউসুফ (আ.) এর সময়কাল হতেই আরব বিশ্বের সঙ্গে এই বাংলার বাণিজ্যিক যােগাযােগ ছিল। ফলে প্রাচীনকাল হতেই দক্ষিণ ভারতের মালাবর, কালিকট, চেরর, বাংলার চট্টগ্রাম ও আরাকান উপকূলে বহু আরব উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল ইসলামপূর্ব কয়েক শতক আগে থেকেই। জেমস টেইলর বলছেন, হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের পূর্ব হতেই দক্ষিণ আরবের সাবা’ কওমের লােকগুলো উপমহাদেশীয় পূর্ব-উত্তর এলাকায় তাদের বসতি স্থাপন করেছিল।

(তৃতীয় পর্ব)

হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম পূর্ব হতেই দক্ষিণ আরবের সাবা’ কওমের লােকগুলো। উপমহাদেশীয় পূর্ব-উত্তর এলাকায় তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। এই ‘সাবাদের উড়’ বা নগর থেকে সাবাউর এবং পরবর্তীতে সাবাউর-এর বিবর্তিত উচ্চারণ ‘সাভার বন্দর। তেমনিভাবে আরবীয়দের দেওয়া চট্টগ্রামের নাম শাত-ইল-গঙ্গা বা গঙ্গার মােহনা । কার্পাসখ্যাত কাপাসিয়ার টোক বন্দরকে আরবীয়রা বলতেন তওক। প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবরণীতে এমনিভাবে সালাহাত এবং কামরুত নাম দু’টির উল্লেখ আছে ।’সিলােহাত সিলেটের আরবীয়দের দেওয়া নাম। আর কামরুত হচ্ছে কামরূপ। ঐতিহাসিক সুনীতিকুমার মুখােপাধ্যায় বলেন, যে সকল নামের সাথে কম’ বা কুম রয়েছে সেগুলো আর্যভাষা হতে উৎপন্ন নয়। প্রাচীন আরবীয়গণ যখন আজকের উত্তরবঙ্গে তাদের বিশালাকৃতির জাহাজগুলাে নােঙর করাতেন তখন তারা উত্তরবঙ্গের লাল মৃত্তিকা দেখে আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে দশদিক কাপিয়ে উচ্চারণ করতেন বারবি হিন্দ’। বার অর্থ মাটি। ফলে তখন থেকে উত্তরবঙ্গ বরিন্দ বা বরিন্দ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। ঐতিহাসিক মিনহায উদ্দিন সিরাজও এই বক্তব্যে সমর্থন প্রদান করেছেন। মক্কার কুরাইশ বণিকগণ ঈসায়ী পাঁচ শতকের শেষভাগে (অর্থাৎ রসূল (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের অনেক পূর্ব হতেই) সক্রিয়ভাবে বহির্বিশ্বে বাণিজ্যিক যােগাযােগ স্থাপন করেন। তাদের মাধ্যমে আরব এবং ভারতীয়দের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এরা বছরে অন্তত দু’বার মালাবর এবং চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বন্দরে তাদের জাহাজ নােঙর করতেন। ড. আবদুল করীম তার চট্টগ্রামে ইসলাম গ্রন্থে বলেন, ‘আরব বণিকরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্য গঠন না করলেও আরবদের যােগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে তাদের প্রভাব এখনও পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে না সূচক শব্দ ব্যবহারও আরবী ভাষার প্রভাবের ফল। অনেক চট্টগ্রামী পরিবার আরব বংশােদ্ভূত বলে দাবী করে। চট্টগ্রামে একাধিক কদম রসুলের অস্তিত্ব দেখা যার। চট্টগ্রামী লােকের মুখাবয়ব আরবদের অনুরূপ বলেও অনেকে মনে করেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা যেমন : আল করন, সলুক বহর (মুলুক উল বহর), বাকলিয়া ইত্যাদি এখনও আরবী নাম বহন করে। (চট্টগ্রামে ইসলাম, ড. আবদুল করীম পৃ. ১৭)

(চতুর্থ পর্ব )

কেবল আরব নয়। মূলত ইসলামপূর্ব যুগ হতেই ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পারস্যের মধ্যে যােগাযােগ ছিল। এই যােগাযােগ কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়। বরং ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই যােগাযােগ ছিল। পারস্য সম্রাট আনুশিরওয়ানের যুগে (মৃত্যু ৫৭৯ খ্রিঃ) কালিলা এবং ‘দিমনা এবং আরও কয়েকটি ভারতীয় বই ফার্সী ভাষায় অনূদিত হয়। ভারতীয় বই-পুস্তকের ফার্সী অনুবাদ হতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, উভয়ের মধ্যে (ভারত ও পারস্য) সাহিত্যের আদান প্রদান হতাে। এমনকি তৎকালীন ভারতের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল বর্তমান আরাকানের হিন্দু রাজা এবং পারস্য সম্রাটের মধ্যে উপহার ও পত্র বিনিময়ের কথা ঐতিহাসিক মাসুদী উল্লেখ করেছেন। (বিস্তারিত দেখুন দৈনিক নিউ নেশন, ১৪-৩- ২০০৭)। ঐতিহাসিক খালেদ আহমদ নিযামী বিভিন্ন প্রামাণ্য তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে আমাদের জানিয়ে দেন যে, এইরপ যােগাযােগের প্রেক্ষিতেই রাসূল (সা.) ভারতীয় এলাকা হতে সুগন্ধী দ্রব্য উপহার হিসাবে পেয়েছেন। একজন ভারতীয় রাজা রাসূল (সা.)কে আচার পাঠিয়ে ছিলেন। এমনকি রাসূল (সা.)-এর পত্নী হযরত আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়লে আরবে বসবাসরত একজন ভারতীয় চিকিৎসকের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়। হযরত ইমাম হােসাইন (রা.)-এর পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদীন একজন ভারতীয় মায়ের সন্তান ছিলেন। শায়খ জয়নুল আবেদীন তার ‘তােহফাতুল মােজাহেদীন’ গ্রন্থে লিখেছেন, আরব দেশের একদল লােক জাহাজে করে ভারতে আসার পর মালাবরের অন্তর্গত চেরুমল পেরুমলের রাজা রাসূল (সা.)-এর সময়ে ইসলাম কবুল করেন। রাজা পরে মক্কা শরীফ গিয়ে রাসূল (সাঃ) সাথে সাক্ষাত করেন। (মাওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ, মােসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪৯)। এ সময় রাসূল (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের কথা জানতে পেরে সন্দ্বীপবাসীগণ তাঁর (রাসূল সা.)-এর নিকট দূত প্রেরণ করেন। সন্দ্বীপের রাজাও এ সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই তথ্যগুলােকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার কোন জো নেই।

(পঞ্চম পর্ব)

এই প্রসঙ্গে আরও জ্ঞাতব্য যে, সম্প্রতি আরব নিউজে প্রকাশিত সংবাদ অবলম্বনে ভারতীয় কলম যুগ পত্রিকা ৯-৭-২০০৫ তারিখে একটি ফিচার প্রকাশ করে। ফিচারের শিরােনাম ‘ভারতে রাসূল (সাঃ) এর বংশধরের কবর আবিষ্কার।’ সুতরাং তথ্যের সত্যতা সাম্প্রতিক সময়ে বাস্তবেও ফলতে শুরু করেছে, যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এখানেই শেষ নয়, তামিল ভাষার প্রাচীন পুঁথিপত্রে রাজা পেরুমলের ইসলাম গ্রহণ ও মক্কা গমন সম্পর্কে অনেক কাহিনী রয়েছে। রাসূল (সা.)-এর সময়কাল হতে পরবর্তী প্রায় দেড় শতাব্দীকাল পর্যন্ত ইসলাম প্রচার বিষয়ক হাদিসের ইতিহাস রিজাল শাস্ত্র এবং সে সময়কার অপরাপর বিপুল তথ্যভাণ্ডার হতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু তথ্য উদঘাটিত হতে শুরু করেছে। এ সকল তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, রাসূল (সা.) প্রাচ্যজগতে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানাের জন্য তার মামা, মা আমেনার চাচাত ভাই এবং কাদেসিয়া যুদ্ধের বিজয়ী সেনাপতি সাদ বিন আৰু ওয়াক্কাসের পিতা সাহাবা হযরত আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াইব (রা.)কে এই অঞ্চলে প্রেরণ করেন। নবুওতের সপ্তম বছরে (৬১৭ খ্রি.) হযরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) সম্রাট নাজ্জাসীর দেওয়া সমুদ্রগামী জাহাজ নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলেন। তার সাথে ছিলেন হযরত কায়েস ইবনে হুযায়ফা (রা.), হযরত ওরওয়াহ ইবনে আছাচা (রা.), হযরত আবু কায়েস ইবনুল হারেস (রা.) (মুহিউদ্দিন খান, বাংলাদেশ ইসলাম প্রচার, কয়েকটি তথ্যসূত্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা ২৭ বর্ষ, ৪৯ সংখ্যা, পূ. ৩৪৫-৫১)। এছাড়াও উক্ত জাহাজে ছিলেন কয়েকজন হাবসী মুসলমান। হিজরী ৩য় শতাব্দীর বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম আবদান মারওয়াজীর বর্ণনা অনুযায়ী এবং চীন হতে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুযায়ী খ্রি. ৬২৬ সনের কাছাকাছি সময়কালে দলনেতা রাসূল (সা.)-এর মাতুল হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসসহ চীন উপকূলে তারা তাদের জাহাজ অবতরণ করেন। দলনেতা ক্যাপ্টেন বন্দরে অবস্থান গ্রহণ করেন। তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টা মসজিদটি আজ উন্নততর সাজে সজ্জিত হয়ে সমুদ্রতীরে সুউচ্চ মিনারসহ দাঁড়িয়ে রয়েছে। মসজিদের অদূরেই তার কবরটি চৌদ্দশ বছর ধরে আজও কালের সাক্ষী হয়ে বিরাজমান রয়েছে। চীনাদের কাছে এই দুটো স্মৃতিময় স্থান যথাক্রমে পূর্ব পুরুষের মসজিদ এবং পূর্ব পুরুষের মাজার হিসাবে চিহ্নিত। অন্য দু’জন সাহাবী উপকূলীয় ফু কীন প্রদেশের চুয়ান চু বন্দরের নিকটবর্তী লিং নামক পাহাড়ের ওপর সমাহিত রয়েছেন। চতুর্থ জন দেশের অভ্যন্তরভাগে চলে গিয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে। (পূর্বোক্ত)।

(ষষ্ঠ পর্ব)

এভাবে হযরত আবু ওয়াক্কাস (রা.)সহ তৎকালীন আরব বণিকগণ আরব উপদ্বীপ হতে যাত্রা করে উপকূল ধরে কোরীয় উপদ্বীপ পর্যন্ত পৌছতেন এবং পথে সকল গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে যাত্রা বিরতি করতেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ছিল অন্যতম। কোন কোন সূত্রের বর্ণনা মতে, আরব বণিকগণ সােনারগা পর্যন্ত আসতেন। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের পর্যটক মা হুয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম হতে সােনারগাঁ পর্যন্ত বাণিজ্য রুট ছিল এবং এই রুট বাংলার রাজধানী গৌড়ের সাথে সংযুক্ত ছিল। আর গোঁড়ে বহু আরব, ইরানী ও অন্যান্য লােক ব্যবসা করত এবং গৌড়ে তৈরী মজবুত জাহাজযােগে বিদেশ সফর করত। (ভারত বিচিত্রা, মে ১৯৮১, পৃষ্ঠা ৩৪)। ফলে এই রুটে আরবদের বাণিজ্য যে সুপ্রাচীন কাল হতে চলে আসছে তা ধরে নেয়া যায়।
আল্লামা সৈয়দ সুলায়মান নদভী তার আরবাআ জাহাজরানী বা আরবের নৌবহর নামক পুস্তকে উল্লেখ করেছেন যে, আরবের নাবিকগণ মালাবর উপকূল হয়ে চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেন। আজকের চট্টগ্রাম এবং সিলেটে তাদের বাণিজ্য জাহাজগুলাে বিরতিকালীন অবস্থান করতাে। কারণ পালতােলা এইসব জাহাজের পক্ষে বিরতিহীনভাবে ক্রমান্বয়িক অগ্রযাত্রা সম্ভব ছিল না। ফলে তারা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থানে জাহাজ নােঙর করিয়ে প্রয়ােজনীয় রসদ সংগ্রহ করতেন। চীনা পরিব্রাজক মা হুয়ান তার বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন যে, বর্তমান চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের মধ্যবর্তী একটি বন্দর নগরীতে উন্নতমানের সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরী হতাে। দূরবর্তী, জাহাজসমূহ এস্থানে যাত্রা বিরতির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মেরামত সেরে পুনরায় যাত্রা শুরু করতো। এভাবে দেখা যায় যে, রাসূল (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পূর্বেই হযরত আবি ওয়াক্কাস (রা.) চীন অভিমুখে যাত্রা করেন। আর এজন্য তাকে অবশ্যই সামান্দার বা শাতিলগাও বন্দবের কোন একটিতে যাত্রা বিরতি করতে হয়েছে। ইসলাম প্রচারই ছিল তাদের লক্ষ্য। ফলে দেখা যায় যে, এই ৪/৫ মাসের পথে তারা ৯ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় সামান্দায় বা শাতিলগ্যাওনে (বর্তমান চট্টগ্রাম) তারা ১ মাসও অবস্থান করেননি এমনটি ভাবা অযৌক্তিক। আর তা করে থাকলে ৯ মাসে কি তারা ৯ জন বাংলাদেশীকেও ইসলাম ধর্মে দীক্ষা প্রদান করেন নাই। হযরত ওমরের শাসনকালে যারা ইসলাম প্রচারের জনা বাংলাদেশে আসেন তন্মধ্যে নেতা ছিলেন হযরত মাসুম এবং হযরত মুহাইমিন। ১২ হতে ২৪ হিজরীর মধ্যে এদের আগমন ঘটে।
 
(সপ্তম পর্ব)
হযরত আবু তালিবের নেতৃত্বে আরেকটি ইসলাম প্রচারকের দল বাংলাদেশে আসেন। সাময়িককালে আরও ৫ দল ইসলাম প্রচারক বাংলাদেশে আসেন বলে জানা যায়। ডক্টর হাসান জামান জানান, এই সকল ইসলাম প্রচারকদের সাথে কোন অন্ত্র বা বই- কিতাব থাকতাে না। এরা প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের মুখের ভাষা শিখে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করতেন। আরব পর্যটক ও ভূগােলবিদ আবু আবদিল্লাহ দামেশকী লিখেছেন যে, চম্পাতে (বর্তমান ভিয়েতনাম ও কম্বােডিয়া) হযরত ওসমান (রাঃ) এর আমলে (খেলাফতকালে) মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। (ভারত বিচিত্রা, মে ১৯৮১ পৃ, ৩৪)। যেহেতু আরব হাতে ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া গমনের তৎকালীন সামুদ্রিক ব্রুটসমূহের প্রধান রুট চট্টগ্রাম অতিক্রম করে গিয়েছিল সেহেতু অন্তত একই সময়ে এই বাংলা তাদের পদম্পর্শে ধন্য হয়ে থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়। কোন কোন সূত্রের তথ্যানুযায়ী আরব বণিকগণ চট্টগ্রাম হয়ে নদী পথে নদীপথে সােনারগাঁ পর্যন্ত আসতেন। এরা ছিলেন মূলত ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়িক কাজকর্মের পাশাপাশি যতটা সম্ভব দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন করতেন। এ কারণে তখন ইসলাম প্রচার ছিল সীমিত এবং কয়েকটি জায়গায় (চট্টগ্রাম, সােনারগাঁ ও আরাকান) সীমাবদ্ধ। কিন্তু সারা বাংলায় ব্যাপকভিত্তিক ইসলাম প্রচার কেবল সুফী সাধকদের আগমনের পর খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর পরই ঘটেছে।
সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মীয় সংঘাত বিদ্যমান ছিল । দ্রাবিড়রা ছিল সেমেটিক । কাজেই সেখানে তাওহিদভিত্তিক সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল । ওপরে বর্ণিত উপাসনালয়গুলাে মসজিদসদৃশ । হরপ্পায় (পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মন্টেগুমারি জেলায় অবস্থিত) আবিষ্কৃত সৌধগুলাে থেকে হুইলার (প্রত্নতত্ত্ববিদ) অনুমান করেছেন, সুমের ও আক্কাদের মতাে সিন্ধু সাম্রাজ্যও সম্ভবত কোনাে রকম পুরােহিত রাজের শাসনে ছিল বা এ শাসনব্যবস্থার প্রধানতম অঙ্গ ছিল ধর্ম (দেবী প্রাসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন) । সম্ভবত হুইলারের এই অনুমান মিথ্যা নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে দেশে দেশে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন ।
ভূতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় আজকের পণ্ডিত সমাজ এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, খ্রিস্ট জন্মের বেশ আগে সুমের (সম্ভবত বর্তমান মিসর) দেশে এক প্লাবন সংঘটিত হয়। কুরআন মজিদ একে হজরত নূহ (আ:)-এর মহাপ্লাবন নামে অভিহিত করেছে। ঐতিহাসিকরা এই তত্ত্ব স্বীকার করে একে কুরআন ও বাইবেলে বর্ণিত মহাপ্লাবন বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রাচীন মৃৎচাকতিতে এই মহাপ্লাবনের কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান শতকের তৃতীয় দশকে মেসােপটেমিয়ায় আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে দেখা যায়, এই মহাপ্লাবন ৮ ফুট পুরু পলিমাটির স্তর তৈরি করে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা মতে, এই মহাপ্লাবনের দরুন পলিস্তরের নিচে এবং ওপরের স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে একটি পূর্ণচ্ছেদ লক্ষ করা যায়। ফলে এ কথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, প্রাক-প্লাবনকালের সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে এবং সেখানে প্লাবনােত্তর কালের একটি নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে।
 
(অষ্টম পর্ব)
ফলে এ কথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, প্রাক-প্লাবনকালের সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস ইয়েছে এবং সেখানে প্লাবনােত্তর কালের একটি নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে। ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত মতে, এ সংস্কৃতি হজরত নূহ (আ:)-এর গড়া সংস্কৃতি। প্লাবন সম্পন্ন হওয়ার পর তারাই পত্তন করলেন আজকের মানব সম্প্রদায়ের। নূহ (আ:)-এর এক পুত্রের নাম ছিল সাম। মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম সেমেটিক সভ্যতা তার নামানুসারেই গড়ে উঠেছিল । সামের পৌত্র আবিরের পিতার নাম আরফাকশাজ। আবিরের পুত্র যাকতিনের সন্তান আবু ফির। এই আবু ফির সভ্যতা নির্মাণে প্রথমে সিন্ধু এবং পরবর্তীকালে গঙ্গার তীরে আগমন করেন। যে সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ওপর বহিরাগত আর্য সভ্যতা তাদের ভিত্তি গড়ে তুলেছে ইতিহাসে সেই সভ্যতা দ্রাবিড় সভ্যতা’ নামে পরিচিত। দ্রাবিড় সভ্যতার গােড়াপত্তনকারী আবু ফির হযরত নূহ (আ:)-এর সপ্তম স্তরের পুরুষ। আরবি ভাষায় যাকে বলা হয় দ্বার আবু ফির ও তার বংশধরদের আবাসস্থল কালক্রমে দ্বার আবু ফির বা দ্রাবিড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এই দ্রাবিড়রাই ভারতীয় উপমহাদেশের আদি বাসিন্দা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে । দ্রাবিড়রাই হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাের সাংস্কৃতিক সভ্যতার নির্মাতা।দ্রাবিড়রা পশ্চিম এশিয়া থেকে বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়ে এ উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তারা ভারতের বৃহত্তর নদী অববাহিকা এবং সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের বসতি গড়ে তােলে। তাদের একটি দল গঙ্গা মােহনায় স্থানীয় বসতি স্থাপন করে উন্নত সভ্যতা গড়ে তােলে । (আবদুল মান্নান তালিব, বাংলাদেশে ইসলাম পৃ: ২৭)। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে বাংলায় এই দ্রাবিড়দের শৌর্য, বীর্য ও পরাক্রমের কাছে স্বয়ং আলেকজান্ডার নতিস্বীকার করেছেন। গ্রিক ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, এদের চার হাজার সুসজ্জিত রণহস্তী এবং অসংখ্য রণতরী ছিল । তাদের রণহস্তীর বিবরণ শুনে আলেকজান্ডার এই জাতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাশা ত্যাগ করেন। মেগান্থিনিস থেকে শুরু করে প্লিনি, পুতার্ক টলেমিসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক তাদের বিবরণে সেই সময়কার বাংলার অধিবাসীদের গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এ সময় বাংলার রাজা মগধাদী জয় করে ভারতের পূর্ব সীমান্ত থেকে পাঞ্জাবের বিপাশা নদীর তীর পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তােলেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এদের সম্পর্কে কতিপয় বিদেশী লেখকের গ্রন্থ ব্যতীত আমাদের এ দেশীয় পুস্তকাদিতে এ বিষয়ে খুব বেশি বিবরণ দেখা যায় না।
 
(নবম পর্ব)
এ দেশের আর্য ধর্মশাস্ত্রের পুস্তকাদিতে বাংলার এই রাজবংশকে ভদ্র নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর্যদের প্রধান ধর্মশাস্ত্র ঋকবেদে এদেরকে দস্য বা দাস হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে। (আবদুল মান্নাব তালিব, বাংলাদেশে ইসলাম, পৃ: ২৭-২৮)। দ্রাবিড়ীয় এবং আর্য সভ্যতার এই সংঘাত কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয় এবং সংস্কৃতিগত। আর্যরা ছিল নানা বস্তুর পূজা-অর্চনায় নিমজ্জিত একটি জাতি। যাগ-যজ্ঞ ও বলিদান ছিল তাদের পূজার অঙ্গ। অন্যদিকে আর্যদের আগমনের আগে দ্রাবিড়দের ধর্ম কী ছিল সে তথ্য জানা না গেলেও আর্যরা যে দ্রাবিড়দের ধর্মের ঘাের বিরােধী ছিল তা বেদ প্রভৃতি আর্য ধর্ম গ্রন্থাদি পাঠে জানা যায়। মহেঞ্জোদারাে ও হরপ্পায় যেসব ক্ষুদ্রাকৃতির মৃত্তিকা নির্মিত খেলনা, সিল পাওয়া গেছে সেগুলাে থেকে কেউ কেউ দেব-দেবী এবং মূর্তির কল্পনা করেছেন। এই বাড়িগুলাের মধ্যে পূজানুষ্ঠানের মতাে কিছু নিদর্শন কল্পনা করা হয়েছে। অথচ এ ধরনের কোনাে কোনাে বাড়ির ধ্বংসাবশেষকে হয়তাে উপাসনালয় বলে সন্দেহ করা যায়, কিন্তু এগুলাের মধ্যে কোনাে বিগ্রহ বেদি বা শিরকীয় ধর্মানুষ্ঠানমূলক কোনাে নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়নি। (দেবী প্রাসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পূ: ৬৯)। আমরা যেটা বলতে চাইছি তা হলাে, সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মীয় সংঘাত বিদ্যমান ছিল । দ্রাবিড়রা ছিল সেমেটিক। কাজেই সেখানে তাওহিদভিত্তিক সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। ওপরে বর্ণিত উপাসনালয়গুলাে মসজিদসদৃশ। হরপ্পায় (পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মন্টেগুমারি জেলায় অবস্থিত) আবিষ্কৃত সৌধগুলাে থেকে হুইলার (প্রত্নতত্ত্ববিদ) অনুমান করেছেন, সুমের ও আক্কাদের মতাে সিন্ধু সাম্রাজ্যও সম্ভবত কোনাে রকম পুরােহিত রাজের শাসনে ছিল বা এ শাসনব্যবস্থার প্রধানতম অঙ্গ ছিল ধর্ম । (দেবী প্রাসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন)।
 
(দশম পর্ব)
সেখানে পরবর্তীকালে শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটলেও শাসনব্যবস্থায় তখনাে তাওহিদের প্রভাব ছিল। ফলে এ সময় অনিবার্যভাবেই বহিরাগত পৌত্তলিকদের সঙ্গে অর্থাৎ আর্যদের সঙ্গে দ্রাবিড়দের সংঘর্ষ ও বিরােধ বাধে । দ্রাবিড়রা কৃষি কাজ করে জীবিকানির্বাহ করত। গাে পালন ও অশ্ব চালনা বিদ্যা তাদের আয়ত্তাধীন ছিল তারা উপাসনালয় এবং গৃহনির্মাণ করতে জানত। মিসর, ব্যবিলন, অ্যাসিরিয়া ও ক্রিটের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় উপকূল দিয়ে তারা ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলাের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং সভ্যতার আদান-প্রদান সম্পর্কিত সম্পর্ক কায়েম করেছিল। সব মিলিয়ে তারা ছিল আর্যদের চেয়ে উন্নত সভ্যতার অধিকারী একটি জাতি। অর্থাৎ সেমেটিকরা ছিল তাওহিদবাদী ধর্মের অনুসারীদের উত্তরসূরি। (আবদুল মান্নান তালিব, বাংলাদেশে ইসলাম, ইফাবা, ঢাকা, দ্বিতীয় সং, ২০০২, পৃ: ৩০)। সর্বোপরি আরাে একটি মজার তথ্য উল্লেখ না করলেই নয় ।প্রাচীন মেসােপটেমিয়ার অন্তর্গত সুমেরীয় শহর উর-এ (হযরত ইব্রাহিম (আ:)-এর শহর) আবিষ্কৃত দ্রব্যাদির সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার আমলের অলঙ্কার ও কাদামাটির পাত্রসমূহের মধ্যে খুবই সাদৃশ্য রয়েছে। এসব নানা কারণে মনে করা হয়, দ্রাবিড়রা মেসােপটেমিয়া থেকে সিন্ধু সভ্যতার উপাদান সংগ্রহ করেছিল ।