বাংলা ভাষার আরেক জনপ্রিয় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালি পাঠকের সাহিত্যচর্চা বিষয়ে অনেকটা শ্লেষের সংঙ্গেই বলেছিলেন_পেটের সংস্থান না করে তোমরা কেউ সাহিত্য চর্চা করতে এসো না। হয়ত কথাটার অন্যভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকতে পারে তবে সবকথার সারকথা বা মোদ্দাকথা বলতে গেলে মানিকবাবু যা বোঝাতেন চেয়েছেন আমার কাছে তা অতটা জটিল-কঠিন কিছু মনে হয় নি! পেটের খিদে আর মনের রুচি’র মধ্যেকার যে আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান তাতে নেহাতই আত্নগত সুখের হিসেব করাটা পণ্ডশ্রম ই হবে। তাই আত্মার সুখ- সমৃদ্ধি, বৃদ্ধি-বিকাশের জন্য সম্ভব হলে ভরাপেট খেয়ে বা তা না জুটলে খানিকটা আধপেটা হয়ে বা তারও সংস্থান না হলে খালিপেটেই সাহিত্যের চর্চা এগিয়ে নেওয়াটা উচিত নয় কি! কত নব্যকবি কবিতা লেখার নেশায়, কবিপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশায় দিনান্তে অনাহার, অর্ধাহারে কাটিয়েছেন তার হিসাব বর্তমানের চোখ দিয়ে বিচার করলে ‘প্যানডরা বক্স’ এর মতোই মনে হবে। তারা কতক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, শতক কিছুদিন পর কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন আর সহস্রের পরিমাণ নির্ধারণ করাটা দুরুহের পাশাপাশি রীতিমত দস্তুর। সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা রইল অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সেইসব কবিদের জন্য।
আমার বেলায় উপর্যুক্ত ঘটনার সম্মীলন না হলেও তাতে কিছুটা খেদ থেকে গিয়েছে সন্দেহ নেই। কবি হতে চাইনি, ঔপন্যাসিক হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই তবে ধৈর্যশীল পাঠক হতে কখনো কার্পণ্য করিনি! তাই অনেকক্ষেত্রে পছন্দের লেখকের লেখাতে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মধ্যেকার গরমিল বা অপূর্ণতা থাকলে সেটা সহজে মেনে নিতে পারি না_আর এটাই আমাতে দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। তবে সবকিছুর যুক্তিতে প্রতিযুক্তি দাঁড় করিয়ে একটা হেস্তনেস্তে পৌঁছানোও অতটা কঠিন হয়নি। সাহিত্যে আর যাইহোক রকেট সাইন্স নয়। যন্ত্র থেকে ব্যক্তিই এখানে যেহেতু মুখ্য তাই ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বিরাজমান ঘটনার-দুর্ঘটনাই আসল গুরুত্ব পাবে। সেখানে অণু-পরমাণু’র চুলচেরা বিশ্লেষণ কখনোই কাম্য নয় বা যারা করেন তাদের বেলায় বলা যেতে পারে_আপনারা তারচেয়ে বরং পিউর সাইন্স নিয়ে গবেষণা করুন। সেখানে ঘটনার ঘনঘটা থাকবে না, সূত্রভেদে বৈচিত্র্য থাকবে না উল্টো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ঠাণ্ডা মাথায় অণুতে-পরমাণুতে কিংবা সম্ভব হলেও তাদেরও ক্ষুদ্র পরিসরে সত্য তথ্যের উদঘাটন করতে সমর্থ হবেন। অযথা কল্পনার জগতে এসে ষোলকলা পূর্ণতা পাওয়ার বৃথা আস্ফালন করার চেয়ে বাস্তবতায় ডুবে থাকাটাই বেটার। এটাতে প্রতিবাদী পাঠকগণের সান্ত্বনা হিসেবে যেটা না বললে আমি অপরাধী হিসেবে পরিগণিত হবো তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি_সাহিত্যে কল্পনা-বাস্তবতার মিশ্রণ-সংমিশ্রণ অবশ্যই আছে। আর আমার উপরোল্লিখিত মতের সাথে অনেকের অমত-দ্বিমত-ভিন্নমত থাকতেই পারে তাতে সাহিত্যের সার্বিক সারমর্মের কোনো পরিবর্তন হবে না। এটাতে সচেতন পাঠকগণের সুদৃষ্টি-স্বদৃষ্টি কামনা করছি।
শরৎচন্দ্রের ২০তম পঠিত উপন্যাস ‘বামুনের মেয়ে’ পড়তে বেশিক্ষণ লাগে নি। ৫৪ পৃষ্ঠার উপন্যাসের কলেবর বৃদ্ধি না হলেও, চরিত্রের অতিচিত্রায়ন না হলেও সারগত অর্থের বিচারে উপন্যাসটি সেকেলেই রয়ে গেছে বলা যায়। অন্যান্য উপন্যাস পড়াকালীন উৎসুক জিজ্ঞাস্য বারবার উদিত হলেও এটাতে কেন জানি তেমন আবেদন জন্মায়নি। সেটা খানিকটা লেখার ধাঁচে, খানিকটা শব্দগত ব্যবহারে, কিছুটা লেখকের দার্শনিকতায় ঘাটতি, আরটুকু চরিত্রগুলোর দুর্বলতায় আর সর্বশেষে একটা চটজলদি সমাপ্তিতে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের প্রাধান্যহীনতা আর অপ্রধান চরিত্রের গাম্ভীর্যপূর্ণ উপস্থিতি কিছুটা ধাক্কা দিয়েছে এদের মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ণয়ে। উপন্যাসের প্রারম্ভে এক নারীর সদর্প উপস্থিতি আর শেষে অন্যজন নারীর করুণ পরিস্থিতি_দুটি বিষয়কে সাধারণীকরণ করলে আপাতদৃষ্টে পার্থক্য তেমন কিছু পাওয়া যাবে না তবে সামাজিক বিচারে, সার্থকতার মাপকাঠিতে তুলনা-প্রতিতুলনা করলে একজনের জয় আরেকজনের পরাজয় যে হয়েছে এটা মানতেই হবে।
চিরাচরিত প্রথায় গা ভাসিয়ে উপমহাদেশীয় দুর্নামের কলঙ্ক খুব সহযে যাবে না_এটা ঔপন্যাসিক বলে না গেলেও সচেতন পাঠকের অচেতন হওয়ার আগ পর্যন্ত বারংবার মনোগত ধাক্কা/মানসপটে ভেসে উঠবে। জাতপাতের ফিরিস্তি তুলে বিশেষ একটি গোত্রের সবকিছুতে নেতৃস্থানীয় দাম্ভিকতা, তাদের বিধি-বিধানের প্রাবল্যতা আর বিপরীত পক্ষকে সেসব শাস্ত্রবচন আওড়িয়ে কুণ্ঠিত করে রাখা, সত্য-মিথ্যার মাপকাঠিতে নির্ঘাত অলীকের আশ্রয়ে হয়কে নয় রুপে প্রতিপন্ন করা, আর্থিক দাম্ভিকতায় ব্যক্তিবিশেষের মোড়লিপনা, সামাজিক অনাচার-অনাসৃষ্টি-অশ্রুত যেমন আছে তেমনিভাবে নারীর পশ্চাদপদতা, টাকার জোরে সামাজিক অবস্থান কিনে নেওয়া কুলীন ব্রাহ্মণের যৌন লালসার শিকার হয়ে তাদের দুর্যোগ-দুর্বিপাকে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে তীর্থভূমিতে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদী কতকটা গ্রহণযোগ্য আর কতকটা অগ্রহণযোগ্য ঘটনায়-দুর্ঘটনায় সমৃদ্ধ উল্লিখিত উপন্যাস।
উপন্যাসের প্রথমেই দেখা মেলে প্রগতিবিরুদ্ধবাদী নারী চরিত্র রাসমনিকে। সামাজিক অবস্থান থেকে তার যথার্থতা তেমনটি না হলেও নিজপক্ষ তথা নারীজাতির জাগরণ নিয়ে তার ঘোরতর আপত্তি! নারীর জন্য আবার কিসের বিদ্যা? নারীর অবস্থিতি থাকবে চার দেয়ালের চৌহদ্দিতে। এক্ষেত্রে যাযাবরের বিখ্যাত লাইনটি স্মরণ করা যেতে পারে_সংস্কারের মুক্তি সবসময় যুক্তি দিয়ে হয় না, বুদ্ধি দিয়ে হয় না যেমন ভূতের ভয় জয়। ঠিক এমনতাই দেখা যায় উপর্যুক্ত চরিত্রে। তবে ঔপন্যাসিকও এটা বুঝাতে চেয়েছেন সমাজে কিছু কিছু চরিত্রের উপস্থিতি থাকে যারা নেহাতই সবকিছু থেকে নিজেদের পৃথক ভাবতে, পৃথক রাখতে যারপরনাই যেমন পছন্দ করে তদ্রুপই তাদের এতকাল অবধি আঁকড়ে ধরা, ঘুণেধরা ব্যবস্থায় পরিবর্তনকারী ব্যক্তিত্বের কুৎসারটনা, বিভিন্ন অভিধায় অভিষিক্ত করে সমাজ থেকে একেবারে নির্বাসন দিয়ে দিতেও তাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা অব্যাহত থাকে। রাসমনি’র দোষের চেয়ে গুণ অবশ্যই বেশি নয় এবং পুরোটা উপন্যাস জুড়ে তার যে সদর্প উপস্থিতি বিশেষ করে গোলক চাটুজ্জের কুকর্মের সহায়তাকারী তাতে মনে হয় আগেকার সবকিছুকে ম্লান করে দিয়ে এটাই প্রধান রুপে প্রতীয়মান হয়। একজন নারী হয়ে কিভাবে অন্য নারীর সর্বনাশ করে তাকেই আবার চাটুজ্যে মহাশয়ের চক্রান্তে দোষী সাব্যস্ত করতে সাক্ষীস্বরুপ রাজি হয়_সেটা শুধু দোষনীয় নয় বরং অত্যধিক গর্হিত অপরাধ। যাইহোক, ঔপন্যাসিক খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রাসমনি চরিত্রটিকে। সেখানে দোষগুণ বিচার করাটা আমাদের জন্য হয়ত সহজ, তবে উপন্যাসের চিত্রায়নের জন্য এই চরিত্রটি সত্যিই দরকার ছিল।
সন্ধ্যা উপন্যাসের নায়িকা। তবে কার্যত অর্থে যে ধরণের উপস্থিতি তার থাকা দরকার ছিল সেটাতে অনেকাংশে ঘাটতি লক্ষ্যনীয়। বামুনের মেয়ে সন্ধ্যার সাথে পরিবারহীন আরেক ব্রাহ্মণছেলের ছোটবেলা থেকে গড়া উঠা পরিণয়-প্রীতিতে ইতি ঘটিয়েছে তথাকথিত শিক্ষাগ্রহণ_যাতে অরুণ নামের ছেলেটি পরবর্তীতে নানা দুর্বিপাকের মধ্যে দিয়ে যায়। তবে দুর্বিপাক-দুর্যোগটা আসলে অথৈব সমাজ ব্যবস্থাতে আগে থেকেই বিদ্যমান, সেখানে যত দোষ নন্দঘোষ হিসেবে অরুণের আধুনিক শিক্ষাকে দায়ী করাটা সমাজে বিরাজমান দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা-বিধাতাদের প্রতিহিংসাপরায়ণতা ছাড়া বেশি কিছু নয়। যাইহোক দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কের বিচ্ছেদের মূল কারণ হিসেবে তারাও কম অংশে দায়ী নয়, বিশেষকরে উপন্যাসের নায়িকা হিসেবে সন্ধ্যা-ই এক্ষেত্রে মুখ্য। নানা টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে গিয়ে শেষে যখন প্রকাশিত হয়ে গেল সন্ধ্যা আসলে কোনো ব্রাহ্মণ বা বামুনের মেয়েই নয় বরং নাপিতের মেয়ে তখন তার ঘোর অনেকটা কাটে এবং প্রায়শ্চিত্ত করতে বিয়ের আসর ছেড়ে অরুণের বাড়িতে গিয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য ধর্না দেয়। এটা তো শেষ তবে একটু গভীরভাবে দেখলে বিষয়টা বা এর অন্তর্গূঢ় অর্থটা অনেকটা এরকম_সন্ধ্যা অরুণকে কখনো ভুলে যায় নি। মায়ের অত্যধিক সংস্কারাচ্ছন্নতা সত্ত্বেও কেবল দেখাসাক্ষাৎ, পারস্পারিক যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদী হয়ে উঠেনি। তবে নিরবে-নিভৃতে কেবল ভালোবেসে যাওয়া, পরোক্ষভাবে অরুণের খোঁজখবর নেওয়া, অভিমান করে অরুণকে সন্ধ্যার বাড়িতে পা না মাড়াতে তাগাদা দেওয়া ইত্যাদী তার থেকে বারংবার যেমন উচ্চারিত হয়েছে তেমনিভাবে আকার ইঙ্গিতে প্রকাশিত, প্রতিফলিতও হয়েছে। আর শেষ পর্যায়ে অরুণের ব্রাহ্মণত্ব নিয়ে প্রশ্নারোপ, নিজ ব্রাহ্মণত্বের সাফাই গাওয়াতে পাঠকের মনে কিছুটা বিরক্তির জন্ম দিতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো কেবল অরুণকে এক প্রকার চেতিয়ে দিয়ে তথাকথিত সমাজকে উপেক্ষা করে সন্ধ্যাকে বিয়ে করে এখান থেকে চলে যাওয়া বা সবাইকে দেখিয়ে উক্ত সমাজেই বসবাস করার ইঙ্গিত প্রদান করলেও আমাদের নায়ক অরুণ হয় তা বোঝেননি নয়ত সেও সমাজের কাছে নিজ ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে, এখান থেকে একপ্রকার লুকিয়ে বিদায় নিতে তৎপর হয়েছেন। যাইহোক, শেষের কাহিনি টুকু অতটা আবেদনযোগ্য না হলেও পাঠক হিসেবে এর একটা মিষ্টতাপূর্ণ সমাধান হওয়ার আগ্রহে ছিলাম। কিন্তু ঔপন্যাসিক তা আর হতে দিলেন না। নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটানো হয়।
‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসের সার্থকতার বিচার করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের ঘটনার মিল পাওয়া যায়! যারা ‘গোরা’ পড়েছেন নিশ্চয়ই শেষের অংশের সাথে পরিচিত আছেন। যখন গোরা জানতে পারল_ সে না ভারতীয়, না গোঁড়া হিন্দু। বরং সে হল ইউরোপীয় বংশগত_যার পিতামাতা উভয়ই আইরিশ। এতকাল অবধি লালন করে আসা সংস্কারাচ্ছন্নতা, নিজে ভারতীয় হিসেবে দেশাত্নবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষন থেকে মুক্তির উপায় বর্ণনা করা সর্বপরী হিন্দু জাতীয়তাবাদকে মুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে প্রচার করে সবাইকে এক কাতারে আনার নিরন্তর প্রচেষ্টা সবই ব্যর্থতায় পর্যবশিত হল যখন গোরা তার পিতৃপুরুষের পরিচয় পেল। কিছুক্ষণ আগের যে গোঁড়া গোরা ছিল, অশ্রুতদের যে সবসময় এড়িয়ে চলত, নিজের যুক্তি-ধৈর্য-মেধাতে অন্যকে যে নিমিষেই নাস্তানাবুদ করতে একাট্টা ছিল অথচ আসল পরিচয় পাওয়ার পর সবকিছু কেমন মিলিয়ে গিয়ে সাধারণ একজন হিসেবে গোরা’র নতুন জন্ম হল। অসাধারণ থেকে নিতান্তই সাধারণের সাথে মিশে গিয়ে ভারতকে তার স্বগোত্র থেকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। তখন অশ্রুত লচপিয়ার হাতে জল খেয়ে তথাকথিত জাত যাওয়ার ভয়কে জয় করে একতাবদ্ধ হওয়ার উৎসাহ ব্যক্ত করল। এক্ষেত্রে সমালোচনাও অনেক থাকতে পারে! রবীন্দ্রনাথ কি এখানে চালাকির আশ্রয় নিয়েছেন, না কি তিনি উগ্রতা পছন্দ করেননি বলে উক্ত গোঁড়া চরিত্রকে নিজ উপন্যাস থেকেই নয় বরং নিজ দেশ থেকেই বের করে দিয়েছেন! এ ব্যাপারে সচেতন পাঠকগণের মতামত প্রত্যাশা করি।
‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসের বেলায় বেশ সাদৃশ্য দেখা যায় যদিও দুটি উপন্যাসের ঘটনার সম্মীলন, প্রেক্ষাপট, চরিত্রচিত্রণ এবং সর্বশেষ পরিণতি ভিন্ন কিন্তু সাদৃশ্য একটি জায়গায়-ই আছে আর তা হল পুর্বোক্ত ধারণা-বিশ্বাসের খণ্ডায়ন এবং নতুন করে উভয় চরিত্রের পুনঃজন্ম। ব্রাহ্মণ পরিবার তথা বংশের প্রতিপত্তির অধিকারী আমাদের নায়িকা সন্ধ্যা। এ নিয়ে তার মাথাব্যথার চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সন্ধ্যার মা অর্থাৎ জগদ্বাত্রীর মাথাব্যথাই অধিক প্রতিফলিত হয়েছে। সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে তার মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক সচেতনতা, বাছবিচার করে কথাবার্তা বলা, সবার থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার মেয়ে কিছুটা উল্টো পথে হেটেছে। সমাজের ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে যেয়ে, অশ্রুতদের আশ্রয় দিয়ে, সহজ-সরল ডাক্তার বাবার একনিষ্ঠ সমর্থনকারী হিসেবে, ব্রাহ্মণী রাসমনি’র যুক্তির প্রতিযুক্তিতে নিজ মতে অবিচল থাকা এবং অরুণের সাথে সবার অলক্ষ্য একপাক্ষিক পরিণয় চালিয়ে যাওয়া_সবকিছুতেই তার স্বতন্ত্র উপস্থিতি চরিত্রগত বিচারে এক্ষেত্রে কিছুটা সার্থকতাকে নির্দেশ করে। আর আর ক্ষেত্রে তেমনটা লক্ষ্য করা যায়নি। যেমন দলিত সম্প্রদায়কে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে মায়ের সাথে বচতায় পেড়ে না উঠতে পেরে একপ্রকার তাড়িয়ে দিয়ে অরুণের কাছে তাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে ধর্না দেওয়া, বাবাকে অন্যসবার হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার সময়ে নির্বাক-নিরুত্তর থাকা, গোলক চাটুজ্যের মতো চরিত্রহীন সৎবামুনের হাতে তাকে তার মা কর্তৃক সমপর্ণ করার সময় তার নিষ্ক্রিয়তা, বিয়ের আসর ছেড়ে বর চলে গেলে, অরুণকে গিয়ে নিজে অনুনয়-বিনয় করে তাকে বিয়ে করতে, অরুণ রাজি না হলে সেখান থেকে ত্বরিত পলায়ন এবং শেষে বাবার সাথে কাশি নিবাসে যাতায়াতের পূর্বে সমাজ, জাতপাত, ইত্যাদীকে পাশ কাটিয়ে লুকায়ন_তাকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়। তবে ঐ যে গোরা’র মতো সন্ধাতে পুনঃজন্ম এটাই মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। শরৎচন্দ্র সমাপ্তিটা একটু অন্যভাবে দিলে বোধহয় ভালো হত। নারীকে, তার পিতৃকুলের পদবীকে না টেনে সমাজের মধ্যেকার স্থবিরতায় একটি বিপ্লবাত্মক চরিত্রের জন্ম দেওয়াতে পারতেন। সেখানে সন্ধ্যা থাকত সবার অগ্রগণ্য আর তার দ্বারাই অথৈব সমাজে শতফুল ফুটতে পারত সন্দেহ নেই! কিন্তু শরৎবাবু তা করেননি। চিরাচরিত প্রথা হিসেবে নারীকেই অবদমিত করে, নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে, পরিবর্তনের ক্ষীণ আশাটুকুকে অকালবোধন স্বরুপ অঙ্কুরিত হওয়ার পূর্বেই সমূলে উপড়ে ফেললেন। ঔপন্যাসিকের একাধিক উপন্যাসের যেমন কতিপয় নারীচরিত্রের জয়জয়কার, তেমনিভাবে বাকিগুলোর করুণ কাহিনিও ততটাই বর্বরতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত! শেষে উপন্যাসের বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়ে বিদায় হচ্ছি_নারীদের সংসারধর্ম পালন করা ছাড়া, আর কোন কার্য পৃথিবীতে আছে কি না তা জানতে বিশ্বভ্রমণে বেরুচ্ছি।
বি.দ্র: পুরোটাই ব্যক্তিগত মন্তব্য-উপলব্ধি। তাই যথোপযুক্ত সমালোচনা/মতামত একান্ত কাম্য। আর দীর্ঘকাল পর লেখার দরুন ভুলভ্রান্তি’র প্রচুর সম্ভাবনা রয়েই গেছে। এসব ভুলের সমাধান ও মূল্যবান মতামত দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।