গভীর সমুদ্রের তলদেশে নেমে গেলো ডুবুরীরা। অনেক কিছুই মিললো তাদের হাতে। ছোট্ট একটি বাক্সও মিলেছিলো। সিন্দুকের মতো দেখতে ছোট্ট একটি বাক্স। বাক্সটির কাঁচগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়াতে ভেতরে বহুমূল্যবান স্বর্ণালংকার এবং অনেক অনেক স্বর্ণমুদ্রা দৃশ্যমান হয়ে উঠলো ডুবুরীদের সামনে। তারা অবাক বিস্ময়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো এবং পরক্ষণেই সমুদ্রের উপরে উঠে আসলো তারা। বাক্সটি টেনে আনার সময় ডুবুরীদের সাথে ঘটলো আরও একটি অদ্ভুত ঘটনা। হঠাৎ করেই যেনো মাথার ভেতর কতগুলো আকুতিময় কন্ঠ সমস্বরে গুঞ্জন করে উঠলো, “তোমরা নিও না ওগুলো! ওগুলো তো আমাদের পূর্বপুরুষের সম্পদ। আমাদের তো সবকিছুই লুটপাট হয়ে গেছে। এই গুটিকয়েক সম্পদ নাহয় ওখানেই থাকতে দাও! অন্তত এগুলোর পাহারায় থেকে হলেও আমাদের অতৃপ্ত আত্মারা শান্তিতে অনন্তকালের পথ পাড়ি দিতে পারবে। দয়া করে নিও না তোমরা আমাদের শেষ সম্বলগুলো!” শুধুই হয়তো অনুভূতিমাত্র। এমন কিছু আসলেই ঘটেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ডুবুরীদের এই অনুভূতি তো একেবারেই নিরর্থক হতে পারে না। তবে তাদের মাথায় ঘুরপাক খাওয়া সেসব কন্ঠস্বর কাদের ছিলো? কেনোই বা তারা বারণ করছিলো বাক্সটি নিয়ে যেতে?
কৌতুহলী ডুবুরীদের একজন বাক্সটি খুলে হাতে তুলে নিলো একটি বাজুবন্ধ। চমৎকার দেখতে সেই বাজুবন্ধটি। ফিরোজা রঙের বহুমূল্যবান পাথরের কারুকাজ করা অনন্য সেই বাজুবন্ধটির অন্য দিকে খোদিত আছে একটি নাম, সাথে আছে স্বর্ণকারের নামও। পরবর্তীতে জানা গিয়েছিলো যে, অদ্ভুত ও অনন্য সেই বাজুবন্ধটি আসলে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধরদের কোনো একজনের শরীর থেকে খুলে নেয়া হয়েছিলো। আর শেষ পরিণতি হিসেবে তার জায়গা হয়েছে অতল সমুদ্রে। এই বাজুবন্ধের ইতিহাস এক নির্মমতার ইতিহাস, এক হতভাগ্য সম্রাটের করুণ পরিণতির গল্প, এক চরম অপমান ও অসম্মানের নিদর্শনের অবতারণা। এই ইতিহাস জানতে হলে আমাদেরকে চলে যেতে হবে ১৮৫৭ সালে। কি হয়েছিলো সে সময়? কি হয়েছিলো ‘খুনি দরজা’-র সামনে?
ভারতের দিল্লীর ‘খুনি দরজা’, বিভিন্ন কারণে এই ‘খুনি দরজা’ অত্যন্ত বিখ্যাত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মর্মস্পর্শী ঘটনার সাথে এই ‘খুনি দরজা’ সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সময়টি ১৮৫৮ সাল। জাহাজভর্তি করে মুঘল সাম্রাজ্যের লালকেল্লার ভেতর থেকে এবং সাম্রাজ্যের অন্যান্য সম্ভ্রান্ত বাড়িঘর থেকে দিনে-রাতে ক্রমাগত লুটপাট করা সম্পদগুলো ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমনই এক লুট হয়ে যাওয়া সম্পদের সামান্য একটি অংশের দেখা মিললো আজ এতো বছর পর।
আমাদের গল্পের হতভাগ্য নায়কের প্রসঙ্গে এবার আসা যাক। অতি সাধারণ একজন ব্যক্তি ছিলেন তিনি, একদম সুফী-সাধক ধরনের সাদামাটা মানুষ। কবিতার ছলে নিজেকে বর্ণনা করতে ভালোবাসতেন। নিছকই মুঘল বংশধর বলেই ‘সম্রাট’ খেতাব ধারণ করে সিংহাসনে বসতে হয়েছিলো তাকে। বলছি, মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের কথা। হ্যাঁ, তিনিই তো ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রিয়পাত্র ও মধ্যমণি। কিন্তু সাদামাটা এ মানুষটিকে নিয়তি একটি সাদামাটা শান্তিপূর্ণ জীবন দিতে পারে নি। উল্টো তাকে সামলাতে হয়েছে বর্ণনাতীত ও সীমাহীন কষ্টের ঝড়, বরণ করে নিতে হয়েছে নিজের ও নিজের পরিবারের করুণ পরিণতি।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ইংরেজরা অপ্রতিহত গতিতে ভারতবর্ষে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। কেউ তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। সমরাস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ও কূটকৌশলের জোরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাত্র ১০০ বছরেই বহুদূর এগিয়ে যায়।
সময়টা ১৮৫৭ সাল। ভারতবর্ষের জনগণ তখন অসহায়, ভারতবাসীর এমন দুর্দিনে কতিপয় সিপাহী ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ সময় বিদ্রোহীদের ভয়ে ভীত ৫২ জন ব্রিটিশ অফিসার প্রাসাদের চার দেয়ালের মাঝে আশ্রয় নিলে সম্রাটের নিষেধ সত্ত্বেও বিদ্রোহী সিপাহীরা তাদের হত্যা করে। এ যুদ্ধে মুঘল রাজপুত্ররাও অংশগ্রহণ করে। সম্রাটের নেতৃত্বে এ হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে –এই বিশ্বাস থেকেই পরবর্তীতে বাহাদুর শাহ জাফরের বিচারকাজ শুরু হয়।
হিন্দু-মুসলমান সকলের প্রিয় বাহাদুর শাহকে তখন ভারতবর্ষের সম্রাট হিসেবে লালকেল্লায় আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায় বিদ্রোহীরা। কিন্তু হায়! তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। ব্রিটিশরা নিষ্ঠুরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। ভারতবাসীর প্রতি ইংরেজদের সামাজিক অবজ্ঞা থেকে বিদ্রোহীদের অন্তরে উদীয়মান অগ্নিস্ফুলিঙ্গের তীব্রতা যতোই হোক না কেনো, ইংরেজ বাহিনীর সাথে পেরে ওঠার দক্ষতা তাদের তখনো তৈরী হয় নি। হতভাগ্য সম্রাট ঠিকই উপল্বদ্ধি করলেন যে, তিনি তার রাষ্ট্র ও তার সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন মহান স্বাধীনতার যুদ্ধকে সফল ও কার্যকর করতে। চোখের সামনেই দেখতে পেলেন, পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে বিগত ১০০ বছরের মধ্যে ইংরেজরা যে নৈপুণ্য ও সামরিক দক্ষতা অর্জন করেছে তার সাথে সম্রাটের সৈন্যদের পেরে ওঠা অসম্ভব। একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর সামনে একটি অসংগঠিত সেনাবাহিনী কোন অর্থবহ ফল বয়ে আনতে পারে না। পাশাপাশি ব্যক্তি স্বার্থের নিষ্পেষণ তো ছিলোই। এদিকে এই মহাবিদ্রোহে সাহায্য করে নি শিখ জনগোষ্ঠী এবং অংশগ্রহণ করে নি নিজাম ও তার রাজপুতেরা। ঐক্য ও সুসংঘবদ্ধতা ছাড়া কেউ কখনো সফল হতে পারে নি। সুতরাং স্বাধীনতার ইচ্ছা থাকলেও স্বাধীনতার সূর্য দেখা সম্ভব হবে না বাহাদুর শাহের পক্ষে। তাই আত্বসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
বিদ্রোহী সৈন্যদের নেতা বখত খান বার বার সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে অনুরোধ করেন যেনো তিনি পালিয়ে যান তার সাথে। কারণ তখনও ভারতবাসী সম্রাটকেই তাদের নেতা হিসেবে দেখতে চায়। সম্রাটই ছিলেন তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। বখত খানের অগাধ বিশ্বাস ছিলো, সম্রাট যদি থাকেন তবে তাদের এই সংগ্রাম সফল হবেই। সম্রাটের নেতৃত্ববলে দেশ জেগে উঠবেই। কিন্তু হায়! সম্রাট ও বখত খানের মধ্যকার এই কথোপকথন শুনে ফেলে কাছেই ওত পেতে থাকা দু’জন দালাল। তারা সম্রাটেরই আত্বীয় ছিলো। শেষ পর্যন্ত কোনোভাবেই তারা সম্রাটকে পালিয়ে যেতে দেয় নি, কারণ ইংরেজ সৈন্য হাডসনকে কথা দিয়েছিলো তারা।
দ্বিধাগ্রস্ত সম্রাট ১৭ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের পর কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ লালকেল্লা থেকে বের হয়ে সুফী-সাধক নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মাজারে প্রবেশ করেন। সাথে ছিলো শুধু কয়েকজন খোজা প্রহরী ও পালকির বেহারা, আর হাতে ছিলো একটি ছোট বাক্স। সেই বাক্সটিতে ছিলো পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কিছু সম্পদ, যার মধ্যে সবচাইতে মূল্যবান বস্তু ছিলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র চুল। এই নির্দশন ছিল বাদশাহর একান্ত শ্রদ্ধার সম্পদ। এটি এখন তিনি কোথায় রাখবেন? নিজেরই তো নিরাপত্তা নেই। তাই বাক্সটি তিনি নিজামুদ্দিনের তোষাখানায় নিরাপদে রাখতে দিলেন। রানা সাফাবিদের লেখা থেকে জানা যায় যে, ক্লান্ত-অবসন্ন বাদশাহ সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলেন যে, তিন বেলা তিনি কিছুই খান নি, তিনি খুবই ক্ষুধার্ত, তাই তাকে কিছু খেতে দেয়া হোক, কিছু খেয়ে তিনি চলে যাবেন হুমায়ূনের সমাধিতে। রাজ্যের এমন হুলস্থুল অবস্থায় মাজারেও কিছু রান্না করা হয় নি। অবশেষে অল্প কিছু আচার ও রুটি জোগাড় করা হলো সম্রাটের জন্য, তা-ই গোগ্রাসে খেলেন শেষ মুঘল বাদশাহ। সম্রাটের এমন অবস্থা দেখে চোখে পানি আটকে রাখতে পারলেন না খাজা হাসান। আবেগে আপ্লুত হয়ে মাজারেই তাদের সাথে বাদশাহকে অবস্থান করার জন্য অনুরোধ করলেন তিনি এবং তার সন্তানেরা প্রাণ দিয়ে বাদশাহকে রক্ষা করবেন বলে কথা দিলেন। গলা ধরে এলো বাদশাহর। দ্বিধাহীন কন্ঠে তিনি জানালেন, তিনি তার নিজ স্বার্থে তার গুরুর পরিবারকে কিছুতেই বিপদে ফেলতে পারবেন না। খাবার খেয়ে বিদায় নিলেন তিনি কন্টকময় এক জীবনের মুখোমুখি হবার জন্য।
এদিকে পূর্বপুরুষ হুমায়ূনের সমাধিতে অপেক্ষা করছে তার পরিবার। স্ত্রীর সাথে সম্রাট প্রবেশ করলেন সেখানে, শুরু হলো প্রতীক্ষা আর প্রার্থনা। হাডসন কঠোর নির্দেশে খবর পাঠান, বিনা শর্তে আত্বসমর্পণ করতে হবে তাকে, আর এর বিনিময়ে তথাকথিত সভ্য ইংরেজরা তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে। বাদশাহর প্রতি কোন অসম্মান বা অমর্যাদা প্রর্দশন করা হবে না, এমন কথাও তারা দিলেন। ধীরে ধীরে বাদশাহ বের হয়ে আসলেন। তার কাছে রাখা দুটি তলোয়ার হস্তান্তর করলেন ইংরেজদের কাছে। পালকিতে উঠলেন তিনি। তাকে নিয়ে আসা হলো লালকেল্লার দূর্গে। হ্যাঁ, বাদশাহ এবার লালকেল্লায় তার পূর্বপুরুষের প্রাসাদেই প্রবেশ করলেন বটে, কিন্তু সম্রাট হিসেবে নয়, একজন বন্দী হিসেবে। তারই প্রাসাদের ধ্বংসস্তুপের মধ্য দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি ঘরে। বহু ইংরেজ সৈন্য অবাক হলো এই ভেবে যে, এ তো পুরোদস্তুর নিরীহ বাদশাহ! তার মধ্যে তো কোনো নিষ্ঠুরতার কিংবা দাম্ভিকতার ছাপ দেখা গেলো না! জিনাত মহলের ঘরে অবস্থানকালে নোংরা কাপড় পরিহিত এই ব্যক্তিকে দেখে কোনোভাবেই মনে হচ্ছিলো না যে তিনি একজন সম্রাট। বেশ তৃপ্তির হাসি হাসলো ইংরেজরা। স্বাধীনতাকামীদের প্রেরণার মূল উৎস বাহাদুর শাহ জাফরের চেহারা সেদিন ঢেকে গিয়েছিল জীর্ণতা-শীর্ণতা ও বার্ধক্যের বলিরেখায়।
যে রাতে বাহাদুর শাহ তার সাম্রাজ্য হারালেন, লালকেল্লায় যেনো এক দুর্যোগ নেমে এলো। মনে হচ্ছিলো যেনো কেল্লার প্রতিটি দেয়াল কাঁদছে। জাভেদ হোসেন এর লেখা ‘বাহাদুর শাহ জাফরের মেয়ের স্মৃতিকথা’ থেকে জানা যায় আরো অনেক কিছু। মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে লালকেল্লা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি! চারদিকে বন্ধু বলতে যারা ছিলো তারা সবাই-ই হয় নিহত, আর নাহয় আত্মগোপনে। নিরুপায় বাদশাহ তাই গেলেন তার পরাক্রান্ত পূর্বপুরুষের আশ্রয়ে, অর্থাৎ বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধিতে। এই লালকেল্লা ছেড়ে বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের বের হয়ে যাওয়া ছিলো ভারতবর্ষে মুঘলকালের অবসান। এর পরদিনই তিনি ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কাগজে-কলমে সমাপ্তি ঘটলো মুঘল শাসনের। ব্রিটিশরা এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াকে অমর করে রাখার জন্য প্রচুর চিত্র অঙ্কন করেছিলো। কি অতিরঞ্জন! এ যেনো প্রোপাগান্ডা করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা! এসব ঘটনা আজও রক্ত গরম করে ফেলার মতো অনুভূতির যোগান দিতে সক্ষম।
ইংরেজরা কিন্তু বসে ছিলো না। টানা তিন দিন ধরে প্রাসাদে লুটতরাজ চালায় তারা। নারীদের ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন, খুব কম নারীরাই ব্রিটিশ হায়েনাদের কবল থেকে নিজেদের সম্মান রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলো সে সময়। মুঘলদের এতো বছরের সযত্নে সঞ্চিত সম্পদগুলো অচিরেই চালান হয়ে গিয়েছিলো ব্রিটিশ দস্যুদের হাতের মুঠোয়। বর্তমান সময়ে সেসবের মধ্যকার অনেক জিনিস বিভিন্ন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ও রাণীর সংরক্ষণ হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। এরই একটি ক্ষুদ্র অংশ আজ এতো বছর পর পাওয়া গেল সমুদ্রের তলদেশে। এ তো ছিলো সম্রাটের করুণ পরিণতির গল্পের একাংশমাত্র। নৃশংসতার শেষ কিন্তু তখনও হয় নি। সম্রাটের আপনজনদের সাথে ঘটেছিলো নৃশংসতার সর্বোচ্চ!
হাডসন সম্রাটের আত্বসমর্পণের পরের দিন হুমায়ূনের সমাধিতে মির্জা মুঘল, মির্জা খিজির ও মির্জা আবু বকরকে গ্রেফতার করার জন্য আবার অভিযান চালান। এদের ওপর ছিলো ব্রিটিশদের ভীষণ রাগ, কারণ এই স্বাধীনতার যুদ্ধে তারা ছিলেন মুঘল বাহিনীর নেতৃত্বে। হুমায়ূনের সৌধে পৌঁছে খবর পাঠানো হলো যুবরাজদের নিঃশর্ত আত্বসমর্পণের জন্য, অন্যথায় অনিবার্য পরিণতি মোকাবেলা করতে হবে তাদেরকে। বাইরে থেকে বিপ্লবীরা শাহাজাদাদের আত্বসমর্পণ না করে যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য উৎসাহিত করছিলো, কিন্তু তার জন্য বেশ দেরী হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে শাহজাদারা বুঝতে পারলেন যে এখন কিংবা পরে কোনো এক সময় আত্বসমর্পণ তাদেরকে করতেই হবে, তাই আর বিলম্ব নয়। মনে আশা ছিলো, বাদশাহর মতো তাদেরকেও হয়তো ব্রিটিশরা প্রাণে মারবে না। তাদেরকে সমাধি থেকে বের করে আগে থেকেই প্রস্তুত এক গরুর গাড়িতে ওঠানো হলো, তিন মাইল অগ্রসর হয়ে দিল্লীতে প্রবেশের পূর্বে গরুর গাড়ি থেকে নামতে নির্দেশ দেয়া হলো তাদের। গায়ের কাপড়ও খুলে ফেলার আদেশ দেয়া হলো। বিস্ময়ে মূক হয়ে গিয়েছিলো সবাই। বাদশাহর সন্তানদের সাথে এ কেমন আচরণ! ছিনিয়ে নেয়া হলো তাদের রত্নখচিত তলোয়ারগুলোও। একটুও সময়ক্ষেপণ না করে সাথে থাকা সৈন্যদের কাছ থেকে কারবাইন সংগ্রহ করে একটি কোবাল্ট রিলিভার দিয়ে এক ঝটকায় গুলি করে হত্যা করলেন উইলিয়াম হাডসন তিন শাহজাদাকে, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের দুই ছেলে মির্জা মুঘল ও মির্জা খিজির সুলতান এবং নাতি মির্জা আবু বকরকে। ঠিকভাবে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো তিন রাজপুত্রের বুক। তাদের নিথর দেহ লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লাল রক্তে রঞ্জিত হলো তাদের নিজ ভূমি। বাদশাই সীলমোহর দেয়া আংটি, ফিরোজা রঙের পাথরের নকশা করা বাজুবন্ধ সবার সামনে খুলে নেয়া হলো তাদের মৃতদেহ থেকে এবং হস্তান্তর করা হলো হাডসনকে। এমন মর্মান্তিক পরিণতির কতোটা হকদার ছিলো এই অল্পবয়সী রাজসন্তানেরা?! তবু এতেও ক্ষান্ত হন নি মেজর হাডসন। ভারতবাসীকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া তো এখনও শেষ হয় নি। হাডসনের উদ্দেশ্য ছিলো ভারতবাসীর সামনে এমন এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেনো আর কোনো দিন ব্রিটিশ শক্তির সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর দুঃসাহস আর কেউ করতে না পারে। হলোও তা-ই। নিরীহ শাহজাদাদের মৃতদেহ নগ্ন অবস্থায় কোতোয়ালিতে ফেলে রাখা হলো টানা তিন দিন। এরপর ঝুলিয়ে দেয়া হলো দিল্লীর প্রবেশমুখের দরজায়। আর সেই থেকে ঐ দরজার নাম হয়ে গেলো ‘খুনি দরজা’। তারপরে এক অখ্যাত গোরস্থানে কবর দেয়া হয় তাদের। দিল্লির ‘খুনি দরজা’, সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মির্জা মুঘল, খিজির সুলতান ও আবু বকর। যখন শাহজাদাদের মৃতদেহ পড়ে ছিলো কোতোয়ালিতে, তখন দলে দলে হৃদপিন্ডের উপর দুটো ছিদ্রসমেত দেহগুলোকে দেখতে এসেছিলো ইংরেজ সৈন্যরা। খুব কাছ থেকে গুলি করার কারণে শরীর থেকে মাংস বের হয়ে গিয়েছিলো, বীভৎস দেখাচ্ছিলো মৃতদেহগুলোকে। কিন্তু ইংরেজদের চোখে ছিলো তৃপ্তি, তারা বলছিলো যে দুষ্কৃতিকারীদের পতন হয়েছে! কিন্তু সত্যিকারের দুষ্কৃতিকারী আসলে কারা? সে প্রশ্ন তো রয়েই যায়।
ঠান্ডা মাথায় সংঘটিত এমন মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও হাডসন ঘৃণিত হওয়ার পরিবর্তে হলো প্রশংসিত ও পুরস্কৃত। মিলিটারী শক্তির অপব্যবহারের এমন ঘৃণ্যতম অপরাধ সংঘটিত হলেও না হয়েছিলো কোনো বিচার, আর না হয়েছিলো আইনী অনুসন্ধান। বাহাদুর শাহর পরিবারের কাউকেই কিন্তু ছাড় দেয়া হয় নি। নির্মম শাস্তি থেকে বাঁচতে কাউকে বাধ্য হয়ে আত্মগোপন করতে হয়েছিলো, কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিলো, আর কাউকে আমৃত্যু কাটাতে হয়েছিলো বন্দী দশা। যুবরাজদের অনেককেই বিদ্রোহের অভিযোগে কচুকাটা করা হয়েছিলো।
আর বাহাদুর শাহ জাফর… তার পরিণতির কথা আলাদা করে আর কি-ই বা বলার আছে! দুই সন্তান ও নাতির ভয়াবহ পরিণতির কাহিনী সদ্য শুনে মূকপ্রায় বৃদ্ধ সম্রাটকে যে পরিমাণ দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা কেবলই বর্ণনাতীত।
ন্যায়বিচার তো ছিলো শুধুই কল্পনামাত্র। উল্টো ব্রিটিশ সৈন্যদের হত্যার অভিযোগে দীর্ঘদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তাকে এবং অবশেষে অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে নির্বাসিত হতে হয়েছিলো রেঙ্গুনে। দুর্ভাগা শেষ মুঘল সম্রাটকে এই বৃদ্ধ বয়সে নিজ ভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো এবং বিদেশের মাটিতেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিলো তাকে। তবে দুর্ভাগ্য তার পিছু ধাওয়া করা তখনও ছাড়ে নি। মারা যাওয়ার পর কবরের দুই গজ মাটিও ভাগ্যে জুটে নি তার। তার কবর যেনো বিদ্রোহীরা কেউ কোনো দিন খুঁজে না পায়, সে জন্য প্রহরীদের ডেরায় গর্ত খুঁড়ে কবর দেয়া হয়েছিলো তাকে।
১৮৫৮ সালে যখন মেজর উইলিয়াম হাডসন বেগম কুঠির দায়িত্বে ছিলেন, তখন চারদিকে শুধু বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর নির্বাসিত জীবনে তার প্রজারা তার মসনদ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কোলকাতায় স্বাধীনতার যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সে সময় স্বাধীনতাকামীদের আক্রমণে ১১ মার্চ হাডসন মৃত্যুবরণ করেন এবং ১২ মার্চ লখনৌতে তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে তার মুখে উচ্চারিত হয়েছিলো, “আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি”।
১৮৫৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ইংরেজ বাহিনী দিল্লী দখল করে সম্রাটকে সপরিবারে বন্দি করে এবং তার দুই পুত্র ও এক পৌত্রকে বিনা বিচারে হত্যা করে। ১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে বৃদ্ধ সম্রাটকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয় এবং সেখানেই ১৮৬২ সালে তার মৃত্যু হয়। ইংরেজরা এই অভূতপূর্ব বিদ্রোহকে নৃশংস, বর্বর ও নির্দয়ভাবে দমন করে। দেশীয় সৈন্যদের কোনো একক নেতৃত্ব না থাকা, ব্রিটিশ বাহিনীর দক্ষ ও চৌকসভাবে যুদ্ধ পরিচালনা, স্থানীয় জমিদারদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষ অবলম্বন, শিখ ও নেপালি সৈন্যদের সমর্থন দান প্রভৃতিকে মূলত এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
নিয়তির কি অদ্ভূত খেলা! মাত্র ২০০ বছর আগেও ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করবার অনুমতির জন্য এই ব্রিটিশরাই মুঘলদের কাছে দয়া ভিক্ষা চাইতো। আর ২০০ বছর পর সেই ব্রিটিশদের হাতেই দমে যেতে হয় উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ মুঘল সাম্রাজ্যকে। ঐশ্বর্যশালী মুঘল সাম্রাজ্যকে হারিয়ে যেতে হলো চিরতরে এবং আমাদের উপমহাদেশেরই পুরাকীর্তিগুলো আজ লুন্ঠনকারীদের সম্পদ হিসেবে তাদেরই জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে, যা প্রমাণ করছে, আমাদের উপমহাদেশের গৌরবগুলো অবহেলার যোগ্য কোনো বস্তু নয়।