আফতাবী’ তাঁর রচিত ‘তারিফ-ই-হুসেইনশাহী’তে সুলতান প্রথম হুসেইন ও তাঁর বেগম খানজাদা হুমায়ুনের প্রশংসা ও বিজয়নগর রাজ্যের পরাজয়ের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করলেও সুলতানের মৃত্যুর কারণ বিষয়ে নীরবই থেকেছেন।আফতাবী, সুলতান এবং বেগম খানজাদা হুমায়ূনের শাসন ক্ষমতা ও কূটনৈতিক কর্তৃত্বের বিবরণও ঐ পুঁথিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।তাঁর মতে, তৎকালীন ভারত ও মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম সমাজে বেগম খানজাদা হুমায়ুনের মতো বুদ্ধিমান ও চৌখস মহিলার আর কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ ছিল না। ১৫৬৫-৬৯ সালের মধ্যে তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথিটি রচিত হয়েছিল এবং পুঁথির চিত্র ঐ সময়েই আঁকা হয়।

পারস্যের চিত্রে মহিলাদের কাব্যিক রোমান্টিক কাহিনীর নায়িকা হিসেবেই আঁকা হয়ে থাকে। কখনোই জীবন থেকে নির্বাচিত আসল চরিত্রের মহিলারা তাঁদের অনুচিত্রে স্থান পায়-নি। তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথির চিত্র পারসিক শৈলীতে আঁকা হলেও সম্ভবত ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে ব্যতিক্রমী।পুঁথির বারোটি চিত্রের(যদিও পুঁথির প্রথম পৃষ্ঠায় চোদ্দটি ছবির কথা উল্লেখ করা হয়েছে) মধ্যে বেগম খানজাদা’র ছটি প্রতিকৃতি চিত্র যোগ করা হয়েছিল এবং ছবিগুলো পুঁথির বাঁধাই অংশের সঙ্গে সমান্তরাল ও লেখাঙ্কনের সমকোণ করে আঁকা হয়েছিল।ঐ পুঁথিচিত্রে পাঁচটি পৃষ্ঠায় নিজামশাহ দরবারের ছবি যোগ করা হলেও একটি চিত্রে প্রাচীন ‘দোহদা’ আখ্যানকে আঁকা হয়েছিল।

চিত্র বিশেষজ্ঞ হারমান গোয়েটসের মতে বর্তমানে বিকানীর প্রাসাদের সংগ্রহশালায় রাখা বারোটি রাগিনীমালার ছবিও আহমদনগরেই আঁকা হয়েছিল। যদিও অন্য চিত্র গবেষকদের মতে বিকানীর প্রাসাদে রাখা ছবি, বিজাপুর চিত্রশালায় আঁকা হয়েছিল। রাগিনীমালার ঐসব চিত্রের রঙ ও নকশার ঔজ্বল্য ও ভাবের সুর, গীতি কাব্যের আমেজ নিয়ে আসে। যদিও ঐসব চিত্রে হিন্দু প্রভাব প্রকট।সম্ভবত ছবিগুলো বিজয়নগরের হিন্দু শিল্পীরাই এঁকেছিলেন।যেখানে বিজাপুর কলমে পারসিক প্রভাব বেশি, সেখানে আহমদনগরের চিত্রশালায় দোহদা’র মতো চিত্র প্রমান করে শিল্পীরা পারসিক শৈলীর সাথে হিন্দু চিত্ররীতির মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন।চিত্রে তুলির কাজ যেমন স্বচ্ছন্দ তেমন সাবলীল।নারীদেহে ফুটে ওঠে বিনম্র বোধ।বেতসের মতো ত্বনী শরীর,টানাটানা চোখ, ছবিতে গুর্জরী রাগিণীর ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাই আহমদনগরের চিত্রশালায় রাগিনীমালার চর্চা হয়-নি একথা নিশ্চিত করে বলা যায়-না। 

চিত্রকর তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথিতে দোহদা আখ্যানের রূপকথাকে বাস্তবায়িত করবার জন্য একজন পুণ্যবান মহিলার স্পর্শে গাছের প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠার বিষয়কে নির্বাচিত করেছিলেন।ঐ চিত্রে মহিলার আলিঙ্গন বা স্পর্শ দ্বারা একটি গাছ প্রস্ফুটিত হয়েছে।দোহদা’র মূলভাব হলো কেবলমাত্র একজন সুন্দরী ও শুদ্ধ নারী জীবনে, সফলভাবে পরিপূর্ণ করে তোলার ঐ সংবেদনশীল আবেগ সৃষ্টি করতে পারেন।নারীর ঐ কমনীয় ভাব ভারতীয় শিল্পে ভারহুত এবং সাঁচির ভাস্কর্যের মধ্যেও দেখা যায়।শিল্পী বেগম খানজাদা হুমায়ুনের মহিমা প্রকাশ করবার জন্যই চিত্রটি এঁকেছিলেন। ছবির মূল এবং আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো, শিল্পী চিত্রে যেমন জমির জন্য পার্সিয়ান নীল রঙ এবং তার সাথে সোনালী রঙের আকাশ যোগ করেছেন তেমনই কাব্যিক রসে বৈপরীত্যর মেজাজ ফুটিয়ে তোলবার জন্য ফিকে লাল-গোলাপি ও কমলা এবং হলুদ রঙ্গের বসনে সজ্জিত মহিলাদের সাথে গাছের পাতার ধার বরাবর সোনালী রঙ ব্যবহার করেছেন। সম্ভবত ছবির মাঝখানে লাল ও কমলা বসনে সজ্জিত নারীই হলেন চিত্রকরের কল্পিত বেগম খানজাদা হুমায়ুন।সুলতান প্রথম হুসেইন ও বেগম খানজাদা হুমায়ূনের দুই পুত্র হলেন প্রথম মুর্তজা ও দ্বিতীয় বুরহান। কিন্তু কারুর মধ্যেই এমন কোনো সদগুন ছিল না যে, ১৫৬৯ সালে বেগম খানজাদা হুমায়ূনের মৃত্যুর পরও তারিফ-ই-হুসেইনশাহী’র মতো পুঁথির চিত্রকর্ম চালু থাকবে।তাই বেগম খানজাদা হুমায়ূনের মৃত্যুর পর ঐ পুঁথির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।১৫৬৫ সালে সুলতান প্রথম হুসেইনের মৃত্যুর পর বেগম খানজাদা হুমায়ূন তাঁর নাবালক পুত্র সুলতান প্রথম মুর্তজা’র অতালিক (অবিভাবক) নিযুক্ত হয়েছিলেন। একসময়ে যে মহিলার অঙ্গুলি হেলনে নিজামশাহ দরবার পরিচালিত হতো তাঁর পরিণতিও হয়েছিল মর্মান্তিক।১৫৬৯ সালে সুলতান প্রথম মুর্তজা’র আদেশে তাঁকে শিবনেরি দুর্গে ((আহমদনগর শহর থেকে শিবনেরি দুর্গের সড়কপথে দূরত্ব মাত্র একশো বারো কিলোমিটার)) বন্দি করা হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

শিবনেরি দুর্গে বেগম খানজাদা হুমায়ূনের ঘরের চিকের আড়ালে ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসে।জুঁইফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের চার কোণে। দুর্গের ভেতরে মহলের ঘরে ঘরে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানো হয়ে গেছে।ঘরের জানলা দিয়ে বেগম তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে… একদল দাসী বাঁদি তেলের বাতি ধরে মিছিল করে চলেছে, ঘরে ঘরে বাতিদান দেবে বলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বেগম দেখেন নক্ষত্রের চাঁদোয়ার তলায় এক ঝাঁক পাখি দক্ষিণ দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন একটা সূক্ষ্ণ দামি রেশমী চাদর বিছানো আকাশে বুকে … তাদের ডানায় কোজাগরীর হাল্কা সোনার রঙের ছোঁয়াচ লেগেছে।বেগম খানজাদা হুমায়ূনের কক্ষের বাতায়নে মিটমিট করে প্রদীপ জ্বলছে।বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে আতরের সুবাস। বেগম তাঁর একাকিত্ব আর নির্জনতাকে যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে বসে থাকেন। বেগম ছিলেন ভাবপ্রবণ মানুষ।বড় প্রিয় ছিল তাঁর কবি হাফিজের মসনভি। নিজেই হয়তো-বা বলে ওঠেন …

‘বলেন ডেকে, শোন রে সাকী,

সংসারে তোর আর কি বাকি?

বাঁধন ছিঁড়ে আয় না ছেড়ে বাসা।

কাজ কি রে তোর আসবাবে সই,

সম্পদে সুখ হয় না তো কই?

চল রে যেথা প্রেমের আছে আশা’।

ভারতের ইতিহাসে যে দুজন মহিলা শাসক তাঁদের সময়কালে ভারত শাসন করেছিলেন সেই রাজিয়া সুলতানা ও নূরজাহানের মতোই নিজামশাহ দরবার, বেগম খানজাদা হুমায়ূনের উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে।তাঁর সেই করুন পরিণতির প্রভাব থেকে তারিফ-ই-হুসেইনশাহী’র পুঁথিচিত্রও বাদ যায় নি। পুণা শহরে ভারত ইতিহাস সংশোধক মন্ডলে নিজামশাহ দরবারের যে চিত্রটি দেখতে পাওয়া যায়,সেটি ১৫৬৫ সালে আঁকা হয়েছিল, এবং ক্ষমতার শীর্ষে থাকা বেগমের ঐ প্রতিকৃতি চিত্র তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথিতে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ১৫৬৯ সালে বেগমের মৃত্যুর পর চিত্রটি থেকে বেগম খানজাদা হুমায়ূনের অবয়বকে ঘষে তুলে ফেলা হয় (সুলতানের হাঁটু ও কাঁধের পিছনে সেই ঘষা দাগ আজও দেখতে পাওয়া যায়)। সুলতান প্রথম মুর্তজা’র আদেশে যে ব্যক্তি নিজামশাহী চিত্রশালার সমস্ত চিত্র থেকে বেগম খানজাদা হুমায়ূনের অবয়বকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন সম্ভবত তিনি তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথির দোহদা আখ্যানের চিত্রতে সুলতানের চিত্র না থাকার কারণে নায়িকার চরিত্রটিকে বেগম খানজাদা হুমায়ূনের বলে সনাক্ত করতে পারেন-নি, হয়তো-বা, তাই ঐ চিত্রে বেগম খানজাদার প্রতিকৃতিটি রক্ষা পেয়েছিল। 

সুলতান প্রথম হুসেইনের আমলে টিকে থাকা আহমদনগরের চিত্রকলার মধ্যে একটি চিত্র বর্তমানে হায়দ্রাবাদ শহরে সালার জঙ মিউজিয়ামে রাখা আছে। নিজের প্রিয় হাতির দিকে চেয়ে থাকা ঐ চিত্রটিও সম্ভবত তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথির একটি খন্ড চিত্র। প্রথম হুসেইনের সময়কালের চারুকলার আরও একটি নিদর্শন বর্তমানে অক্সফোর্ডের আশমোলিয়ান জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।চকচকে কড়া পালিশের সোনালী কাঠের বাক্সটির উপর শিকার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।শিকার দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে গাছ, পাথর এবং ফুল দক্ষিণী চিত্রশৈলীতেই আঁকা হয়েছে। ছবিতে চিত্রকর গৌণ চরিত্রের মধ্যেও শিকারের উত্তেজনা দক্ষ ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।ঢাকনা খোলবার জন্য কাঠের বাক্সর হাতল গোঁফের আকারে তৈরি করা হয়েছিল।

সুলতান প্রথম হুসেইনের পর আহমদনগরের চিত্রকলায় মূল চরিত্রে প্রাণবন্ত আবেগের পরিবর্তে সূক্ষ্ম মানসিক অন্তর্দৃষ্টি ফুটিয়ে তোলা শুরু হয়।সম্ভবত ঐ সময় থেকে আহমদনগরের চিত্ররীতি ইউরোপীয় শৈলীর প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষিত হয়েছিল। হয়তো-বা নিজামশাহ দরবারের শিল্পীরা ইউরোপীয় নবজাগরণের দিকে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন।যদিও তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথিচিত্রের পর ইউরোপীয় শৈলীর প্রতি আহমদনগরের চিত্রকরদের আকর্ষণ একটু বেমানানই লাগে।তারিফ-ই-হুসেইনশাহী পুঁথিচিত্রের পরবর্তী সময়কালে আর কোনো ছবির সন্ধান না পাওয়ার ফলে ঐ  দুই বিপরীত শৈলীর মধ্যে কালানুক্রমিক সম্পর্ক সুনিশ্চিত করা যায় না।নিজামশাহীরা শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা বিষয়ে পুরাতন প্রথাতেই বিশ্বাসী ছিলেন, তাই তাঁরা তৎকালীন মুসলিম দুনিয়ার সেইসব চিত্রশিল্পীদের তাঁদের দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যাঁরা একই সঙ্গে সাফাভিদ ও মুঘল এবং ইউরোপীয় শৈলীর সাথে পরিচিত বা কারিগরি বিকাশে সচেতন ছিলেন।

১৫৭৫ সালে আঁকা সুলতান প্রথম মুর্তজার দুটি প্রতিকৃতি চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।যার একটি প্যারিসের বিবলিওথেক জাতীয় সংগ্রহশালায় এবং অপরটি রামপুর গ্রন্থশালায় রাখা আছে। ঐ দুটি ছবি নিজামশাহী দরবারের দ্বিতীয়ভাগের চিত্ররীতিকেই প্রকাশ করে। বিবলিওথেক জাতীয় সংগ্রহশালায় রাখা ছবিতে কৈশোর উত্তীর্ণ সুলতান প্রথম মুর্তজা মাদার অফ পার্ল পাথরে সজ্জিত সিংহাসনে বসে আছেন এবং সুলতানের বয়ঃসন্ধি বয়সকে বোঝানোর জন্য শিল্পী হাল্কা গোঁফ এবং গালে শ্মশ্রুর রেখা ফুটিয়ে তুলেছেন। ছবিতে সুলতান প্রথম মুর্তজাকে তাঁর ডানদিকে দাঁড়ানো এক সভাসদকে স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিতে দেখা যায়। সুলতানের মাথায় বালক সুলভ একটা লাল রঙের পাগড়িও চোখে পড়ে। ছবিটি দেখলে মনে হয়, যেন শিল্পী সচেতনভাবেই সুলতানের বাম দিক থেকে দর্শকের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করিয়েছেন। কোনো কোনো গবেষকের(মার্ক জেব্রস্কি) মতে, ঐ ছবিতে চিত্রকর যে মনস্তাত্ত্বিক আবেদন ফুটিয়ে তুলেছেন, তা মুঘল কলম থেকে একেবারেই পৃথক ছিল। যদিও অন্যান্য চিত্র গবেষক(স্টেলা ক্রামরিশ) এই ছবির মধ্যে মুঘল কলমের চিত্রকর ফারুখ বেগের শৈলী খুঁজে পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ভুল করে ছবিটি বিজাপুর কলমে আঁকা হয়েছিল বলে মনে করেছিলেন। রামপুরের গ্রন্থশালায় রাখা ছবিতে শামিয়ানা টাঙানো পালঙ্কের উপর সুলতানকে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে রাজকীয় স্বাচ্ছন্দ্যের মেজাজে বসে থাকতে দেখা যায়।এই ছবিতে চিত্রকর প্যারিসের

বিবলিওথেক জাতীয় সংগ্রহশালায় রাখা ছবিটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিন্যাসেই সাজন করেছেন।

সুলতান প্রথম মুর্তজার আমলে আহমদনগর রাজ্যের সাংস্কৃতিক চর্চা শীর্ষে পৌঁছায়। তাঁরই আমলে সুদূর ইরান থেকে কবি জুহুরি ও উরফী তাঁর দরবারে স্থান নিয়েছিলেন। ১৫৭৫ সালে সুলতান প্রথম মুর্তজার ঐ প্রতিকৃতি চিত্রদুটি যখন আঁকা হয়েছিল তখন তাঁর বয়েস ছিল মাত্র কুড়ি।

১৫৮৮ সালে নিজামশাহী দরবারে ঘটে যায় এক রক্তক্ষয়ী ঘটনা। সুলতান প্রথম মুর্তজাকে তাঁর ব্যক্তিগত হামামে হত্যা করা হয় …নিজের পুত্রের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। সুলতান প্রথম মুর্তজা আবার সম্পর্কে বিজাপুরের সুলতান প্রথম আলীর শ্যালক ছিলেন, অর্থাৎ চাঁদবিবির ভাই ছিলেন। শোনা যায়, সুলতান প্রথম মুর্তজা নিজেই তাঁর পুত্রকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যের ফেরে তাঁকেই পুত্রের হাতে নিহত হতে হয়। চাঁদবিবির ভাই সুলতান প্রথম মুর্তজা নিজামশাহ না-কি,মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন। তিনি নিজের হাতে বিজয়নগর রাজ্য থেকে পাওয়া সমস্ত লুঠের অর্থ,সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।তিনি নাকি কোনো এক বালক গোলামের প্রেমে মশগুল ছিলেন, তাঁর নাম ছিল ফাহিম খান।নিজামশাহী দরবারের ঐরকম চরম দুরাবস্থার মধ্যে আদিলশাহী বেগম চাঁদবিবি আহমদনগরের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি ছিলেন সুলতান প্রথম হুসেইন নিজামশাহের কন্যা। স্বামী প্রথম আলী আদিলশাহ মারা যাবার পর বিজাপুরের রাজ্যভার সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিমের হাতে অর্পণ করে তিনি তাঁর বাপের বাড়িতেই ফিরে আসেন। আমৃত্যু তিনি নিজামশাহী দরবারেই তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।

সুলতান প্রথম মুর্তজার মৃত্যুর পর তাঁর অপদার্থ পুত্র দ্বিতীয় হুসেইন নিজামশাহ (১৫৮৮ -৮৯)মাত্র ষোলো বছর বয়েসে সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন চারিত্রিক ভাবে উচ্ছৃঙ্খল। তাঁর চরিত্রের জন্যই দরবারের ওমরাহরা ১৫৮৯ সালে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে।তখত ঘিরেই তো সুলতান শাহজাদাদের জীবন আবর্তিত হয়। যুদ্ধের পর একজন হয়তো সিংহাসনে বসেন বাকি সবাই খসে পড়েন উল্কাপিণ্ডের মতো। আর মাটিতে উড়ে বেড়ায় মুঠো মুঠো ছাই। ১৫৮৯ সাল থেকে প্রায় তিনবছর নিজামশাহ সিংহাসন খালিই পরে থাকে। দরবারে ঘরিবান (জন্মসূত্রে বিদেশী মুসলিম) এবং স্থানীয় দক্ষিণী মুসলিমদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রাজ্য অরাজকতায় ছেয়ে যায়। অবশেষে মুঘল সম্রাট আকবরের মধ্যস্থতায় আহমদনগরে শান্তি ফিরে আসে। ১৫৯১ সালে প্রথম হুসেইন শাহ এবং বেগম খানজাদা হুমায়ূনের দ্বিতীয় পুত্র,দ্বিতীয় বুরহান নিজামশাহ (১৫৯১-৯৫) পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসে আহমদনগরের তখত-তাউসে অধিষ্টিত হন।মুঘল সম্রাট আকবরের ধারণা ছিল হয়তো-বা আহমদনগর এবার মুঘল অধীনতা স্বীকার করে নেবে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নামে আহমদনগরে খোতবা পাঠ করা হোক।কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় বুরহান নিজামশাহ অন্য চরিত্রের মানুষ ছিলেন,রাজ্যে বিনা অনুমতিতে সম্রাট আকবরের নামে খোতবা পাঠ করবার অপরাধে এক খতীবের(যিনি খোতবা পাঠ করেন)শিরচ্ছেদ করা হয়।অবশেষে ১৫৯৫ সালে দ্বিতীয় বুরহানের মৃত্যু হলে আহমদনগরের রাজ্যসীমায় মুঘল ফৌজ এসে উপস্থিত হয়… নিজামশাহ বংশের শেষের শুরু এই সময় থেকেই তার আগমন সংবাদ জানিয়ে দেয়।

সুলতান দ্বিতীয় বুরহান তাঁর প্রাসাদের অলিন্দে গবাক্ষের কাছে এসে দাঁড়ান।জাফরী দিয়ে দেখা যায় চাঁদ।মসজিদের মিনার আকাশ ছুঁয়েছে।ফুলকাটা জাফরির খোপে খোপে ফুটফুটে তারা। যেন নীল কিংখাবের উপর রুপালি চুমকি। মুঘলদের ভয়ে ভীরু বাতাসও যেন গবাক্ষ দিয়ে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে।মসজিদের মিনার ছাড়িয়ে চাঁদ এবার আকাশের পথ ধরেছে… ঘরে ফিরছে।বাইরের বাতাসও ফেরার পথ না পেয়ে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে উঠছে। সুলতানের কক্ষের দীপগুলোও আজ কেঁপে কঁপে উঠছে। অলিন্দের উপর থেকে নিচের প্রাঙ্গনে গোলাপের ঝাড় দেখতে পাওয়া যায়।সবুজ মখমলের গায়ে যেন খয়েরি বুটি।সবুজও নয় কালোও নয়।অন্ধকার আর সবুজ মিলেমিশে শুয়ে থাকে ওখানে। সুলতান       প্রথম মুর্তজার আমলে আহমদনগরের শাহী তসবিরখানায় যে চিত্রশৈলীর পথ চলা শুরু হয়েছিল, তাকে মুঘল কলমের খুব কাছাকাছি রাখা যায়। আবার কোনো কোনো চিত্র বিশেষজ্ঞ (ডেবোরা হুট্টন) মনে করেন ১৫৯০ সালে মুঘল কলমের প্রথমভাগে আহমদনগরের চিত্রশৈলীর প্রভাব দেখা গিয়েছিল।

…….(ক্রমশ)