প্যারিসের বিবলিওথেক জাতীয় সংগ্রহশালায় সুলতান প্রথম মুর্তজার আরও একটি প্রতিকৃতি চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। চিত্রটিতে চিত্রকর স্বচ্ছ সাদা কাফতান পরা বারো তেরো বছরের কিশোর সুলতানকে উপস্থাপন করেছেন। কোমরে বাঁধা রয়েছে মধ্য এশিয়ায় তৈরি সোনার কালিতে আঁকা ধাতব টাকার থলি এবং বসনে রয়েছে দক্ষিণীরীতির ছোঁয়া।সোনার গাছপালায় ঘেরা এক প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে সুলতান প্রথম মুর্তজা ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলেছেন, যে প্রকৃতিতে ছুঁয়ে আছে দক্ষিণের মোহিনী হাওয়া। ছবির মধ্যে হাওয়ার আমেজ বা শব্দের আভাস এবং হাওয়ায় ওড়া ঘোড়ার কেশরে, চিত্রকর যে রস ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা পরবর্তীকালে ডেকান শৈলীর বৈশিষ্ঠ্য হয়ে ফুটে উঠেছিল।
সুলতান প্রথম মুর্তজার এই তিনটি প্রতিকৃতি চিত্রই পারসিক শৈলীতে সুলতানের মহিমান্বিত রূপ ফুটিয়ে তোলবার জন্য চিত্রকর তাঁকে ঈষৎ লম্বা করেই এঁকেছেন।গুপ্তযুগে ভাস্কর্যে যে রাজকীয় মহিমা ভারতীয় শিল্পকলার ঐতিহ্য ছিল, সুলতান প্রথম মুর্তজার প্রতিকৃতি চিত্রেও শিল্পী সেই ঐতিহ্য মেনে রাজকীয় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন এবং ছবির মধ্যে যে গীতি
কাব্যসুলভ ভাব এবং প্রেক্ষাপটে জ্বলজ্বলে, ঝলমলে সাজন তা পারসিক শৈলীর প্রভাবকেই স্মরণ করায়।
আবার চিত্রটির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ইউরোপীয় শৈলীর ছোঁয়াও পাওয়া যায়। প্যারিসের বিবলিওথেক জাতীয় সংগ্রহশালা এবং রামপুর চিত্রে প্রচ্ছন্ন সোনার পটভূমিতে প্রতিকৃতির চারপাশে কালো রঙে রঞ্জিত করবার শৈলী,ইতালিতে সোনালি রঙের প্রেক্ষাপটে আঁকা ‘সিনিয়াস চিত্ররীতি’কেই স্মরণ করায়। তেরোশো থেকে পনেরোশো শতাব্দীতে ইতালির সিয়েনা শহরে যে সিনিয়াস চিত্রশৈলী জনপ্রিয় হয়েছিল তা দাক্ষিনাত্যে পর্তুগিজদের হাত ধরে গোয়ায় প্রবেশ করেছিল এবং ধীরে ধীরে ঐ শৈলীর মতো সোনালি রঙে চিত্রের সাজন,ডেকানে মুসলিম শাসকদের রাজ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আহমদনগরের শাহী তসবিরখানাতেও তার প্রভাব পড়েছিল।
আহমেদনগর চিত্রশিল্পের পরবর্তী ধাপে, দ্বিতীয় বুরহানের আমলে হালকা রঙের সাথে রেখ অঙ্কনের রীতি শুরু হয়। প্রথম মুর্তজার ভাই, দ্বিতীয় বুরহান সিংহাসনে বসে যতই সম্রাট আকবরের বিরোধিতা করবার চেষ্টা করে থাকুন, তাঁকে মুঘল দরবারেই নির্বাসিত হতে হয়েছিল।তাই তাঁর সময়ে নিজামশাহী চিত্রশৈলীতে মুঘলরীতির প্রভাব আসা খুব অবাক হওয়ার মতো নয়।সম্ভবত ১৫৯০ সাল থেকেই মুঘল কলমের দ্বারা আহমদনগরের চিত্রশৈলী প্রভাবিত হতে শুরু করেছিল বলেই মনে হয়।
একটি আমেরিকান বেসরকারী সংগ্রহশালায় দ্বিতীয় বুরহানের আমলে আঁকা আরও একটি ছবির সন্ধান পাওয়া যায়।মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বহু পুঁথিচিত্রে সম্রাটদের যে গতি মুঘল শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার সাথে এই চিত্রে বেগবান হাতির মধ্যে একই সাহসী মেজাজ আহমদনগরের শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছিলেন।সুলতান প্রথম মুর্তজার আমলে প্যারিসের বিবলিওথেক সংগ্রহশালার চিত্রে প্রকাশব্যাঞ্জনার মধ্যে যে রাজকীয় ভাব দেখতে যাওয়া গিয়েছিল তা দ্বিতীয় বুরহানের আমল থেকে আহমদনগরের চিত্রে হ্রাস পেতে থাকে। মুঘল চিত্ররীতির দ্বারা প্রভাবিত হলেও ঐ হাতির চিত্রায়নে বিশেষ করে, শুঁড়ের কুঁচন, বহুবর্ণে চিত্রবিচিত্র পিঠের চাদর ও নধরকান্তি পুচ্ছে দক্ষিণীশৈলীর সাজন ও অলঙ্কার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক আখ্যানে মুঘল কলমে যে এক্সপ্রেসিভ ফর্ম ফুটে উঠেছিল, আহমদনগরের চিত্রকর ঐ হাতির চিত্রেও সেই প্রকাশ ব্যঞ্জনাই ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় (লন্ডনে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক সংরক্ষণাগার, ১৯৪৭ সালের আগে ভারত সরকারের বহু নথি আজও এখানে রাখা আছে) দ্বিতীয় বুরহানের আমলে আঁকা একটি রাজকীয় বনভোজনের ছবির সন্ধান পাওয়া যায়। প্যারিসের বিবলিওথেক সংগ্রহশালায় রাখা ছবির চিত্রকর সুলতান প্রথম মুর্তজার চিত্রে যেমন রাজতন্ত্রের প্রতীককে উপস্থাপনা করেছিলেন তেমনই তাঁর ছবিতে সুলতানের আরাম করবার অনুভূতিও ফুটে উঠেছিল।এই ছবিতেও শিল্পী সুলতান দ্বিতীয় বুরহান (?) দ্বারা আয়োজিত বনভোজনের বিশদ বিবরণ যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনই চাপ মুক্ত দরবারী আমেজকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। চিত্রনিহিত শিল্পগুনে, শৈলী ও ব্যাখ্যার উজ্জ্বল সংমিশ্রণ ঘটলেও এককথা বলাই যায় যে শিল্পী প্যারিসের বিবলিওথেক সংগ্রহশালায় রাখা ছবির চিত্রকরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।বিশেষ করে, সুলতানের অলঙ্কৃত সিংহাসন, বাঁদিকে দাঁড়ানো অমাত্যকে ডান হাত বাড়িয়ে কাগজ (সম্ভবত আদেশনামা) এগিয়ে দেওয়া,বসনে পালকের মতো হালকা কিন্তু অত্যাধিকভাবে কুঁচিত উত্তরীয় ইত্যাদি লক্ষণ প্যারিসের শিল্পী তাঁর ছবিতে অতীতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।যদিও এই ছবিতে চিত্রকর ঐ সব কাব্যিক রস আরও বলিষ্ঠ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সম্ভবত দ্বিতীয় বুরহানের দ্বারা অনুষ্ঠিত বনভোজনের চিত্র এবং বেগবান হাতির ছবিটি একই শিল্পীর আঁকা।অবশ্য এই চিত্রে মূল চরিত্র (সুলতান)ও গৌণ চরিত্রের মুখের আবেগ প্যারিসের চিত্রকরের অনুকরণেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সুলতানের সিংহাসনের ডানদিকে গাছের গায়ে কালো রঙের যে কোটর শিল্পী এঁকেছেন সেই একই রীতিতে তিনি হাতির কানের কুহরটিও ফুটিয়ে তুলেছেন।যদিও সুলতানের বনভোজনের দৃশ্য অঙ্কনে চিত্রকরের প্রাণবন্ততার ঘাটতি এবং চিত্রদর্শনে খামতি থেকে যায়। ১৫৯০ সাল থেকেই আহমদনগরের সমৃদ্ধ শৈল্পিক ঐতিহ্য ও শিল্পসৃষ্টিতে সঙ্গতি, বৈচিত্র্য এবং ছন্দের ক্ষয় শুরু হয়েছিল।
সুলতান দ্বিতীয় বুরহানের আমলে রাগমালা রীতিতে আঁকা হিন্দোলা রাগের একটি ছবির সন্ধান পায় যায়। ১৫৯০ সালে আঁকা ঐ ছবিটি (২৬.৪ সে.মি. x ১৮.৭ সে.মি.) বর্তমানে দিল্লীর ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখা আছে। ছবির ডানদিকে নিচের অংশে রঙের পিচকিরি প্রমান করে নিজামশাহীদের দরবারে হিন্দু রীতিতে হোলি উৎসব পালন করা হতো। ডেকানি চিত্রশিল্পে নিজামশাহী চিত্রশালার এই চিত্রেই প্রথম রাগমালা রীতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
তৃতীয় এডউইন বিনি(১৯২৫-৮৬)একজন ভারতীয় চিত্র সংগ্রাহক ছিলেন, তাঁরই সংগৃহিত আহমদনগরের শেষ আমলের একটি চিত্র বর্তমানে আমেরিকায় সানদিয়েগো প্রদর্শনশালায় রাখা আছে। সম্ভবত চিত্রটি ১৫৮০ সাল থেকে ১৫৯৫ সালের মধ্যে আঁকা হয়েছিল।ছবিতে তরুণ শাহজাদাকে আলিঙ্গন করছেন এক বালিকা। নিজামশাহী রাজ্যের দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হয়েছে মুঘলরা।সম্ভবত সেই সময়ে একটি ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল।যে ভোজসভায় শুধুমাত্র ঐ শাহজাদা এবং বালিকাই অংশগ্রহণ করেছিলেন।মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বাসন এবং সুরার পাত্র। বালিকা ত্রস্ত হয়ে শাহজাদার বাহুকে শক্ত করে ধরে আছেন।শাহজাদা আশ্বস্ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বালিকাকে সামনে এগিয়ে আসতে বলছেন।পারস্যের তারুণ্যের যে কাব্যিক বর্ণনা দক্ষিণী কাব্য-সাহিত্যে পাওয়া যায়,ছবিতে শাহজাদা হয়েছেন ঐ সাহিত্যের মূল চরিত্র। মুঘল শক্তির কাছে তিনি আজ পুতুল ছাড়া আর কিছুই নন।চিত্রটিতে তাঁর মুখাবয়ব এবং পোশাক,বিশেষ করে দীর্ঘ উত্তরীয় এবং আলগাভাবে বাঁধা পাগড়ি এবং সোনার কোমরবন্ধনীতে ধাতুর তৈরি মুদ্রার থলি, যা তাঁকে আহমদনগরের নিজামশাহ শাহজাদার পরিচয়ে চিনতে অসুবিধা হয়-না।দ্বিতীয় বুরহান নিজামশাহের মৃত্যুর পর আহমদনগরের আকাশ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল।তাঁর মৃত্যুর পর নিজামশাহ তখত তাউসে একের পর এক নাবালক শাহজাদা সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। চাঁদবিবির প্রতিরোধ ও ব্যর্থ হয়েছিল। তাই এই ছবিটি কোন শাহজাদা বা নাবালক সুলতানের জন্য আঁকা হয়েছিল,তা আজ আর বলা যায়-না। অবশেষে ১৬০০ সালে নিজামশাহীর স্বাধীন পথ চলা রুদ্ধ হয়… মুঘল সাম্রাজ্যের রাজ্যসীমায় অন্তর্ভুক্ত হয় আহমদনগর।
বিকেলে এসে দাঁড়াই আহমদনগরের দুর্গের ভাঙা অলিন্দে। উঁচু খাসমহল দালানের দিকে ফিরে তাকাই …কোনো একটা জানলায় কি বেগম খানজাদা হুমায়ুন দাঁড়িয়ে আছেন!পড়ন্ত বেলায় চকচকে গাছের পাতা কিংবা বাতাসে দোলানো জালের ফাঁকে আমি খুঁজে বেড়াই তাঁর মুখ।যদি এক পলকও বেহশতের নূরের মতো তাঁর দেখা পাই। কানে ভেসে আসে গাইডের গলায় ওমর খৈয়ামের সুর…
‘বলো না কাহারে, বলো না কখনো
এ অতি গূঢ় সত্য সার
যে ফুল শুকায়ে ঝরিয়া গিয়াছে
সে নাহি ফুটিবে আর…’
তথ্য সূত্র:
Barrett, D. and Gray, B. 1963. Painting of India. Lausanne
Chandra, M. 1951. Portraits of Adil Shah. Marg.
Edwin Binney 3rd.1979. Indian Paintings from The Deccan. Journal of the Royal Society of Arts.Vol. 127.
Gray, B. 1937. Portraits from Bijapur’. British Museum Quarterly.1938. Deccani paintings: the school of Bijapur. Burlington Magazine.
Khandalavala, K. 1955–6. Identification of the portraits of Malik Ambar’. Lalit Kala.
Michell, George and Zebrowski,1999. Mark. Architecture and Art of the Deccan Sultanates. New Cambridge History of India. ed. Gordon Johnson. Cambridge: Cambridge University Press.
Michell, George.1978. Architecture of the Islamic World: Its History and Meaning, Published by William Morrow, London.
Michell, George.1986. Islamic Heritage of the Deccan, Marg Publications, Bombay.
Skelton, R. 1957. The Mughal artist Farrukh Beg. Ars Orientalis. 1958. Documents for the study of painting at Bijapur. Arts Asiatiques. 1971. Early Golconda painting. In Hartel, H. and Moeller, V. eds. Indologen-Tagung. Wiesbaden.
Welch, Stuart Cary. India Art and Culture: 1300-1900. The Metropolitan Museum of Art, New York. Holt, Rinehart and Winston, New York. 1985.
Zebrowski, M. 1981. Transformations in seventeenth-century Deccani painting at Bijapur. Chhavi. 1983. Deccani Painting. London and Berkeley.