ইউরোপে মধ্যযুগ জুড়ে বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের প্রতাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। সামরিক শক্তির সাথে ধর্মীয় আবেদন এই সাম্রাজ্যকে একটি সমীহ জাগানো শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু ১১ শতকের দিকে এসে সম্রাটদের ভুল সিদ্ধান্তে বাইজান্টিন সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। একই সময়ে খোরাসানে আব্বাসী সাম্রাজ্যের ছায়া হিসেবে চলছিল সেলজুক সাম্রাজ্যের শাসন। আব্বাসীদের আড়ালে সেলজুক সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এই সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন আল্প আরসালান। এর আগে ১০৫৪ সালে সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তুঘ্রিল বেগ বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের সামরিক ও প্রশাসনিক ইউনিট মানজিকার্ট অবরোধ করে ব্যর্থ হন। পূর্বপুরুষের ব্যর্থতা আল্প আরসালানকে মানজিকার্ট জয় করতে উদ্বুদ্ধ করে। ১০৭১ সালে আর্মেনিয়ার মানজিকার্ট (বর্তমানে তুরস্কে)  নামক স্থানে সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের কাছে পরাজিত হন বাইজান্টিন সম্রাট চতুর্থ রোমানস দিওগেনেস। আর এর সাথে এশিয়া মাইনরে তার্কদের প্রভূত্ব কায়েম হয়। বাইজান্টিন সেনাবাহিনীর প্রতাপ হ্রাস পায় এবং বাইজান্টিন সম্রাটের নৈতিক ও ধর্মীয় আবেদন ভূলুণ্ঠিত হয়। সাথে করে ভৌগোলিক সীমাও হাতছাড়া হয়ে যায় সেলজুক তার্কদের কাছে। সিংহাসন নিয়ে জেনারেলদের দ্বন্দ্ব একটা সময় এই সাম্রাজ্যকে পতনের দিকে ধাবিত করে।

মানজিকার্ট যুদ্ধ যে জায়গাতে হয়েছিলো

মানজিকার্টের যুদ্ধের অবস্থান মানচিত্র, ১০৭১ সিই (CE)

বাইজান্টিন ও সেলজুক

সম্রাট চতুর্থ রোমানস দিওগেনেস (১০৬৮-৭১) নিজে ছিলেন একজন প্রাক্তন জেনারেল। তিনি একটি দুর্বল সেনাবাহিনীর অধিকারী হয়েছিলেন। অস্ত্রের স্বল্পতা, ভাড়াটে সৈন্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ও অদক্ষ বাধ্যতামূলক সৈন্য ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত ছিল বাইজান্টিন সামরিক বাহিনী। তার পূর্বের শাসকেরা বেসামরিক বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে সামরিক বাহিনীকে অবহেলা করেছেন। এছাড়া আরও একটি বড় সমস্যা ছিল সাম্রাজ্যের সীমান্ত। অধিক সীমান্ত থাকার কারণে এই সীমান্ত প্রতিরক্ষার কাজও ছিল চ্যালেঞ্জিং। একইসময় যাযাবর তার্কদের নতুন সাম্রাজ্য সেলজুকরা পুরো এশিয়া মাইনরে (আনাতোলিয়া) কোনভাবেই নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারছিল না। এজন্য তারা বিক্ষিপ্তভাবে বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের সামরিক ফাঁড়িগুলো আক্রমণ করতে থাকে। তাদের আক্রমণের দরুন আর্মেনিয়া ও মধ্য এশিয়ার রুটের নিরাপত্তার জন্য বাইজান্টিন সম্রাট দুর্গব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করে তুলেন।

সেলজুক সাম্রাজ্যে তখন আসীন আল্প আরসালান ( ১০৬৩-১০৭৩)।  আল্প আরসালানের সেলজুক সাম্রাজ্যের সীমা ছিল প্রায় পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। তার সামরিক বাহিনী ছিল অধিক দক্ষতাসম্পন্ন এবং এর মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনী ছিল সবচেয় গতিশীল ও ক্ষিপ্র। অপরদিকে রোমানসের বাহিনী ছিল সংখ্যার দিক থেকে অনেক শক্তিশালী, প্রায় ৩ লাখ সৈন্য ছিল তার অধীনে। তবে এদের মধ্যে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও আনুগত্যের অভাব ছিল।

মানজিকার্টের যুদ্ধের একটা তেল চিত্র

১৫শ শতাব্দীর ফরাসি অণুচিত্রে প্রদর্শিত মানজিকার্টের যুদ্ধ।

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

সেলজুক বাহিনীর নজর ছিল মানজিকার্টে, যেটি ছিল বাইজান্টিন সামরিক ও প্রশাসনিক অঞ্চল। এই মানজিকার্ট তুঘরিল অবরোধ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা মানজিকার্ট দখল করার জন্য সেনা সমাবেশ শুরু করে। আগস্ট ১০৭১ সালে আর্মেনিয়ায় আসেন বাইজান্টিন সম্রাট রোমানস। রোমানস তার সৈন্যদের দুইটি ভাগে ভাগ করেন। একটি অংশকে লেক ভ্যান নামক জায়গার উত্তরে পাঠান জেনারেল জোসেফের নেতৃত্বে, অন্য অংশ নিয়ে সম্রাট নিজে রওনা দেন মানজিকার্ট দুর্গের উদ্দেশ্যে। জোসেফের সৈন্যরা সেলজুকদের কাছে পরাজিত হয়। তবে বাইজান্টিন কোন সূত্র এই পরাজয়ের ব্যাপারে কোন কিছু প্রকাশ করতে বিরত থাকে। তবে জোসেফ একজন অভিজ্ঞ জেনারেল ছিলেন। তার এত সহজে পরাজিত হবার কথা নয়। সন্দেহ করা হয় তিনি যুদ্ধ না করে ফিরে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি নিজেই সাম্রাজ্যের সম্রাট হবার ইচ্ছা পোষণ করতেন। যাহোক, এই ঘটনা রোমানসের জন্য একটা দুঃসংবাদ ছিল। যুদ্ধ হবার আগেই তিনি তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক অংশ হারিয়ে ফেলেন।

যে সেলজুক যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়

আল্প আরসালান সেলজুক তুর্কিদেরকে বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

যুদ্ধ শুরু

খ্রিস্টান ও মুসলিম দুই নেতা অবশেষে ২৫ আগস্ট ১০৭১ সালে মানজিকার্টে মুখোমুখি হন। প্রথমে একটি খণ্ডযুদ্ধ হয়। এই খণ্ডযুদ্ধে বাইজান্টিন সেনাদের অপদস্ত করা হয়। যুদ্ধ শুরুর আগেই বাইজান্টিন সৈন্যের একটি অংশ পালিয়ে যেতে শুরু করে। কিছু ভাড়াটে সৈন্য আবার পক্ষ ত্যাগ করে সেলজুকদের সাথে যোগ দেয়। বিক্ষিপ্ত অবস্থায়ও প্রথমদিন এভাবে যুদ্ধ শেষ হয়। দ্বিতীয় দিনে সেলজুকদের সৈন্য বৃদ্ধি পেতে থাকলে এদের বেতন দেয়ার একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হয় যা সেলজুকদের সামর্থ্যের বাইরে ছিল। এছাড়া আল্প আরসালান সিরিয়া অভিযানে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে তিনি এই যুদ্ধ শেষ করতে রোমানসের কাছে একটা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু রোমানস তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। রোমানস তার পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীকে পাশে রেখে নিজে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেন। একজন সাবেক জেনারেল হয়েও তিনি যুদ্ধ ফরমেশনে ভুল করেন এবং তার পরিকল্পনা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। আল্প আরসালান এদিকে তার সেনাদের অর্ধচন্দ্রাকার আকারে সাজান এবং বাইজান্টিন সেনাদের অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দেন যাতে করে তারা সেলজুল তীরন্দাজদের সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়ে। বেলা শেষে সূর্যের আলো কমতে শুরু করলে রোমানস তার সৈন্যদের ক্যাম্পে ফেরার নির্দেশ দেন। আর এই সুযোগই যেন খুঁজে ফিরছিল সেলজুকরা। পশ্চাৎপদ বাইজান্টিন পদাতিক সৈন্যদের ওপর তারা হামলা চালায়। একই সময় গুজব রটে যে স্বয়ং সম্রাট মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে বাইজান্টিন বাহিনীর মধ্যে ভীতি তৈরি হয়। এই গুজবটি আন্দ্রোনিকস ডুকাস নামের রোমানসের এক প্রতিদ্বন্দ্বী ছড়িয়েছিল। তার এই গুজবের ফলে বাইজান্টিন বাহিনী প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এদিকে রোমানস কেন্দ্রীয়ভাগে বীরত্বের সাথেই সেলজুকদের প্রতিহত করে যাচ্ছিলেন। তবে তাকে পিছু হটতে হচ্ছিল। বাইজান্টিন বাহিনীর বাম পাশের অংশ রোমানসের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এক পর্যায়ে রোমানসের ঘোড়া নিহত হয় এবং আহত রোমানসকে সেলজুকরা বন্দী করে। চাক্ষুষ সাক্ষীদের ভাষ্যমতে, রোমানসের সাথে খুব একটা খারাপ ব্যবহার করেননি সুলতান আল্প আরসালান। তাকে এক সপ্তাহব্যাপী ভালমন্দ আপ্যায়ন করা হয়। ১১ শতকের Scylitzes chronicles এর পান্ডুলিপি অনুযায়ী রোমানসের সাথে আল্প আরসালানের একটি কথোপকথন জানা যায়। আরসালান এসময় রোমানসকে জিজ্ঞেস করেন যে, রোমানস যদি আজ তার অবস্থানে থাকতেন তবে আরসালানের প্রতি রোমানসের প্রতিক্রিয়া কেমন হতো।  রোমানস উত্তর দেন, “আমি হলে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে তোমাকে হত্যা করতাম”। আরসালান রোমানসকে মুক্ত করে দেন। তবে মুক্তিপণ হিসেবে গ্রহণ করেন, পুরো আর্মেনিয়া, এডেসা, হায়ারোপলিস, এন্টিওকের মত বড় শহর। শর্ত হিসেবে আল্প আরসালানের পুত্রের সাথে রোমানসের এক কন্যার বিয়েও দেয়া হয়। এছাড়া এককালীন দেড় মিলিয়ন স্বর্ণ ও বার্ষিক ৩ লক্ষ ৬০ হাজার স্বর্ণ প্রদানেরও প্রতিশ্রুতি দেন সম্রাট রোমানস।

যুদ্ধের মানচিত্র

বাইজেন্টাইন অঞ্চল (বেগুনি), বাইজেন্টাইন আক্রমণ (লাল) এবং সেলজুক আক্রমণ (সবুজ)

ফলাফল কি হয়েছিল?

রোমানস মুক্তি পেয়েছিলেন বটে তবে অচিরেই তিনি সব হারান। তিনি যখন কনস্টান্টিনোপল যান তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়, তাকে অন্ধ করে দেয়া হয়। তার কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নেন প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল সপ্তম মাইকেল দুকাস। পরবর্তীতে বাইজান্টিন সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। ফলে সেলজুক শক্তিকে প্রতিহত করার শক্তি হারায় তারা। আরসালান পুরো এশিয়া মাইনরে সেলজুকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রুম সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।  ১০৭৮ সালে নিকিয়াকে সেলজুকদের রাজধানী করা হয়। আর এই সেলজুকরাই ১০৮৭ সালে জেরুজালেম দখল করে।

তথ্যসূত্র