বিস্ময়কর নিদর্শন, আচার-অনুষ্ঠান ও মিথে ভরপুর এক সভ্যতার নাম প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা কিন্তু এক দিনে গড়ে ওঠে নি, আবার হুট করেই এর পতন হয় নি। ধীরে ধীরে বিকশিত হওয়া এই অভূতপূর্ব মিশরীয় সভ্যতা তৈরী করেছে নিজের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যার মূল শেকড় ও শক্তি ছিলো উত্তর আফ্রিকায় প্রবাহিত দীর্ঘতম নদ, নীল নদ।
নীল নদের তীরে বসবাসরত মানুষেরা সভ্য জীবনযাপনের সাথে পরিচিত ছিলেন না। বেঁচে থাকার জন্য তারা পশু শিকার করতেন এবং ফলমূল সংগ্রহ করে খেতেন। তবে নীল নদের তীরের উর্বর ভূমি বেশি দিন তাদেরকে বর্বর থাকতে দেয় নি। মানুষ শিকারী থেকে কৃষকে পরিণত হয়ে সভ্যতার দিকে ঝুঁকতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে অন্য জায়গা থেকেও মানুষ এসে বসতি গড়তে শুরু করলেন, যার ফলে শিকারের পশুর সংখ্যা একেবারে কমে গেলো এবং প্রায় সবাই-ই পুরদস্তুর কৃষকে পরিণত হলেন।
তবে কৃষিকাজ করতে গিয়েও এই অঞ্চলের মানুষ বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। প্রতি বছর বন্যায় নীল নদের পানি সমস্ত ফসল ভাসিয়ে নিয়ে যেতো। তবে বন্যার ফলে জমির উর্বরতা বেড়ে যেতো। বন্যার পানির সাথে জমা হওয়া পলিমাটিতে ফসলের উৎপাদন বেশ ভালো হতো। আবার বেশি দিন বৃষ্টি না হলে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে একেবারে চৌচির হয়ে যেতো। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে নীল নদ বাসীরা বাঁধ নির্মাণ ও বাঁধে ধরে রাখা পানি ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেয়ার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু এতো সব কাজ করার জন্য দরকার ছিলো প্রচুর শ্রমিকের। এই উদ্যোগের ফলে অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক শ্রমিকেরা এই এলাকায় এসে বসতি গড়লেন। কৃষক-শ্রমিকের সম্মিলিত এক সুগঠিত সমাজ তৈরী হলো নীল নদের তীরে।
আস্তে আস্তে তাদের কৃষি পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আসলো। উন্নত ধারণার সাথে সাথে উন্নত যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করলেন নীল নদ বাসীরা। এর ফলে এলাকায় দক্ষ কারিগরের উদ্ভব ঘটলো। শিল্পচর্চাও শুরু হলো ব্যাপকভাবে। অনন্য সব স্থাপত্য, ভাস্কর্য, কারুপণ্য তৈরী হতে লাগলো নীল নদের তীরে। এক সময়ের শিকারীদের ছোট্ট গ্রামটি পরিণত হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নগররাষ্ট্রে।
প্রতিটি সমাজেই একটি যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। নীল নদের বাসিন্দারাও নিজেদের সমাজের নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। আর এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই উদ্ভব হলো ‘ফারাও’ এর ধারণার।
নীল নদ বাসীরা নিজেদের দেশকে ‘কেমেট’ বা কৃষ্ণভূমি বলে ডাকতেন। ‘এইজিপ্টাস’ বা ‘ইজিপ্ট’ নামটি মূলত গ্রীকদের দেয়া। আর ‘মিশর’ হলো আরবী শব্দ। নীল নদের অববাহিকা দুটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত ছিলো- আপার ইজিপ্ট বা ঊর্ধ্ব মিশর এবং লোয়ার ইজিপ্ট বা নিম্ন মিশর। খ্রিস্টপূর্ব ৩১৫০ সালে এই দুই অঞ্চলকে একত্র করে একতাবদ্ধ রাষ্ট্র ‘মিশর’ প্রতিষ্ঠা করেন নীল নদ বাসীদের প্রথম ফারাও মেনেস।
ফারাও মেনেসের হাত ধরে মিশরে প্রথম রাজবংশের সূচনা হয় এবং পরবর্তী তিন হাজার বছর ৩২টি রাজবংশের শাসনের মাধ্যমে এই ধারা অব্যাহত থাকে। মিশর এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি অর্জন করেছিলো নিজের সৃষ্টিশৈলীর মাধ্যমে। হাজার বছর ধরে অসংখ্য শত্রুপক্ষ মিশর আক্রমণের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু মিশর এতোই শক্তিশালী ছিলো যে, যারাই মিশর দখলের চেষ্টা করেছে, তাদেরকেই উল্টো মিশরের কাছে পদানত হতে হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে মিশরের গোপন হাতিয়ার হিসেবে প্রতি বার দাঁড়িয়েছে মিশরের হাজার বছরের শক্তিশালী সংস্কৃতি।
তবে বিশাল শক্তিধর এই সভ্যতায়ও ভাঙন ধরেছিলো, যার শুরুটা হয়েছিলো শেষ ফারাও ক্লিওপেট্রার আবির্ভাবেরও এক হাজার বছর আগে, যখন থেকে মিশরের ক্ষমতা একটু একটু করে মন্দিরের পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রণে যেতে শুরু করেছিলো।
ফারাও তৃতীয় রামেসিস লিবিয়ান আগ্রাসন প্রতিহত করার পর বন্দী লিবিয়ানদেরকে মিশরের দাসে পরিণত করেন। কালক্রমে এই লিবিয়ান দাসদের বংশধরেরাই মিশরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন ও প্রায় ২০০ বছর তারা মিশর শাসন করেন। লিবিয়ান বংশোদ্ভূত প্রথম শশেঙ্ক একুশতম রাজবংশের শেষ ফারাও দ্বিতীয় সিসেনসের মেয়েকে বিয়ে করে মিশরের বাইশতম রাজবংশের প্রথম ফারাও হন এবং ফারাও হবার পর মিশরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের ছেলে ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে অধিষ্ঠিত করে মিশরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন।
এরপর নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও অন্তঃর্দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ ধীরে ধীরে মিশরের লিবিয়ান শাসনেও ফাটল ধরতে শুরু করলো, কারণ তারা মিশরের সমাধিগুলোর বিশাল সম্পদের ওপর লুটতরাজ চালিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত লোভী হয়ে উঠেছিলেন। এই সুযোগটি কাজে লাগালেন নুবিয়ার কুশাইটরা। মিশরীয় ফারাওরা প্রায়ই নুবিয়া অভিযানে যেতেন এবং সেখানে তারা দেবতা আমুনের মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। কুশাইটরাও এই সংস্কৃতির সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তারাও আমুনের পূজা করতেন এবং মিশরীয় সংস্কৃতি ও স্থাপত্যকলা তাদেরকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতো। লিবিয়ানদের দুর্বলতার সুযোগে কুশাইটরা প্রথম বারের মতো একতাবদ্ধ হলেন এবং শুধু মিশরীয় সংস্কৃতিকেই নয়, সমগ্র মিশরেই নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করলেন। মিশর কুশাইটদের কাছে পদানত হলো এবং পঁচিশতম মিশরীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হলো কুশাইটদের হাতে।
কুশাইটদের পর মিশরে আগমন ঘটে শক্তিশালী সেনাবাহিনী সম্বলিত অ্যাসিরীয়দের। কুশাইটদের মতো মিশরীয় স্থাপত্যকলার প্রতি অ্যাসিরীয়দের কোনো মায়া ছিলো না। অ্যাসিরীয় রাজা আশুরবানিপাল মিশরের থিবস নগরী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন এবং মিশরে অ্যাসিরীয় আধিপত্যের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু অ্যাসিরীয় রাজা প্রথম সামটিক নিজের পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখবার ইচ্ছায় মিশরকে অ্যাসিরীয়মুক্ত করবার জন্য উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রীক সেনাবাহিনী নিয়োগ দেন। সে সময় ট্রয়ের যুদ্ধের পর পর গ্রীকরা যুদ্ধক্ষেত্রে এবং সমুদ্র যাত্রায় নাবিক হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলো। তাই বহু বিদেশী জাতিই গ্রীকদেরকে নিজস্ব সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতেন।
মিশরের শেষ অ্যাসিরীয় রাজা এপরিজের কাছে গ্রীকদের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালনার জন্য লিবিয়ানরা অনুরোধ করতে থাকেন। তাই উপায়ান্তর না পেয়ে এপরিজ তার গ্রীক সৈন্যের বদলে সেই যুদ্ধে মিশরীয় সৈন্য পাঠাতে মনস্থির করলেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে মিশরীয় সেনাবাহিনী এপরিজকে ভুল বুঝলেন। তারা ভাবলেন, শুধুমাত্র গ্রীক সেনাবাহিনী গড়ার জন্যই মিশরীয় বাহিনীকে হঠানোর পরিকল্পনা করছেন ফারাও এপরিজ। এতে ক্ষুব্ধ মিশরীয় বাহিনী বিদ্রোহ করে বসলেন এবং ফারাও এর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি আমাসিসের কাছেই তিনি পরাজিত ও নিহত হন। আমাসিসের সাথে পার্সিয়ানদের বিরোধ ছিলো এবং এরই ফলশ্রুতিতে মিশর আক্রমণ করে এর মূল ক্ষমতা অর্জন করে নেন পার্সিয়ানরা। তখন সাইরাস দ্য গ্রেটের নেতৃত্বে পারস্য সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলো এবং যে কোনো বিদেশী শক্তি পারস্যের অসীম ক্ষমতার প্রতি আতঙ্ক অনুভব করতেন।
অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কাছে তৃতীয় ডেরিয়াসের শোচনীয় পরাজয় ঘটলে নিজেকে মিশরের ফারাও হিসেবে ঘোষণা দেন আলেকজান্ডার। তবে স্বদেশে ফেরার আগেই পথে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হলে তার প্রধান সাত জন সেনাপতি নিজেদের মধ্যে আলেকজান্ডারের অধীনস্থ অঞ্চলগুলোর শাসন ভাগ করে নেন। এ ক্ষেত্রে মিশরের শাসনভার ন্যস্ত হয় সেনাপতি টলেমীর ওপর। এ থেকেই মিশরের শেষ রাজবংশ টলেমী বংশের শাসন শুরু হয়। টলেমী বংশের পুরুষ সদস্যদের নামকরণ হতো ‘টলেমী’, আর নারী সদস্যদের নামকরণ হতো ‘ক্লিওপেট্রা’। এই টলেমী বংশেরই শেষ ফারাও ছিলেন সপ্তম ক্লিওপেট্রা, যিনি নিজের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও রূপের জন্য চিরকাল সুপরিচিত হয়ে আছেন। ক্লিওপেট্রাই ছিলেন মিশরের সর্বশেষ ফারাও। ঘটনাচক্রে ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেন এবং এরই মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় ফারাও এর শাসন। রয়ে যায় শুধু তাদের অমূল্য সব নিদর্শন ও সৃষ্টিশৈলী, যা আজও আমাদেরকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে চলেছে।
রেফারেন্স:
- ‘মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত’ –এস এম নিয়াজ মাওলা