পনেরো শতক জুড়ে ইউরোপীয় দেশগুলো নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। আর সব ইউরোপীয় শক্তিরই দৃষ্টি ছিল প্রাচ্যের দিকে। পৃথিবীর পূর্বদিকের এই অঞ্চলের লোভনীয় মসলার কথা জানতে পেরেছিল ইউরোপীয়রা। আর এই মসলা বাণিজ্যের অংশীদার হতে পশ্চিম হয়ে পূর্বে একটি জলপথ আবিষ্কার করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৪৯৩ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা যখন উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেন তখন তিনি এই অঞ্চলে জমজমাট এক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে দেখতে পান। এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক ব্যাপ্তি আর সম্পদের প্রাচুর্যতা সম্পর্কে ইউরোপীয়দের কোন ধারণাই ছিল না। প্রাচ্যে ইউরোপীয় আবিষ্কার ও উপনিবেশের যে সময় সেই সময়ের পূর্বে ভারত মহাসাগর ছিল বাণিজ্যিক কেন্দ্র যেখানে মুক্তার মালা হয়ে ঘিরে রেখেছিল বিভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্য।
সেসময় তিনটি শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য ঘিরে রেখেছিল ভারত মহাসাগরকে। পশ্চিমে অটোমান সাম্রাজ্য অধিভুক্ত এলাকা যা বাইজান্টাইনদের কাছে জয় করেছিল তারা। অটোমানরা এখানকার লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করত যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে ভেনিসকে যুক্ত করেছিল। ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রে ছিল সাফাভীদ সাম্রাজ্য যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল পারস্য উপসাগরীয় বাণিজ্য পথ আর পূর্বে নিয়ন্ত্রণ ছিল ভারতের শক্তিশালী মুঘল সাম্রাজ্য। যদিও এই অঞ্চলে মুঘলদের সাথে দক্ষিণ ভারতের হিন্দু সাম্রাজ্য কোজিকোড (কালিকট) কিংডম, বিজয়নগর সাম্রাজ্য এবং শ্রীলংকার বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের বিবাদ ছিল।
সেসময় ভারত মহাসাগরের দুটি প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণ করতো মুসলিমরা। লোহিত সাগরে এডেন বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ছিল অটোমানদের হাতে। ভারত মহাসাগরের সাথে লোহিত সাগরের সংযোগ পথ হিসেবে এডেন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পথ আবার চলে গিয়েছিল গ্রিস, মিশর আর রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত। পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের মধ্যবর্তী হরমুজ প্রণালী ছিল সাফাভীদ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারত মহাসাগরে যাওয়ার দ্বিতীয় প্রবেশপথ। এই প্রবেশপথ দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভারতীয় ও পারসিয়ানদের মধ্যে যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় অব্যাহত রাখতে সহায়তা করেছিল।
ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যের কেন্দ্রে ভারত একটি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে শতাব্দীব্যাপী তার প্রভাব বজায় রেখেছিল। ভারতের সেসময়কার প্রভাবশালী বাণিজ্যিক শহর ছিল কালিকট, কোচিন, কুইলন এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মালাবার উপকূলের সাথে থাকা মুসলিম গোয়া। এছাড়া গুজরাটের ক্যামবে শহরও ছিল মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। পনেরো শতাব্দীর শেষ নাগাদ ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গুজরাটের হিন্দু ব্যবসায়ীদের সাথে আরব মুসলিমদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
কালিকট বন্দর ছিল ভারতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং মরিচের প্রাপ্যতার দিক থেকে পৃথিবীর একমাত্র বাণিজ্যিক শহর। শতাব্দীব্যাপী কালিকট বন্দরই ছিল ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলোর প্রধান গন্তব্য। এডেন, হরমুজ, মালাক্কা এবং চীন থেকে ব্যবসায়ীরা কালিকট শহরে এসে জড়ো হতেন।
পনেরো শতাব্দীতে বিশাল ভারত মহাসাগরীয় গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুসলিম বণিকরা আরব উপদ্বীপ থেকে নিজেদের বাণিজ্যিক জাল ছড়িয়ে দেয় আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে। মুসলিমরা এ অঞ্চলে শক্তিশালী হওয়া শুরু করলে তারা নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে। আর এই ধারাবাহিকতায় মালয় উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠা পায় মালয় সাম্রাজ্য। মলুক্কাসের (ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ) টারনেট ও টিডোর দ্বীপ ছাড়াও পূর্ব আফ্রিকার উপকূল জুড়ে মুসলিমরা সমৃদ্ধ নগর রাষ্ট্রেরও পত্তন করে।
আফ্রিকার সাহিল উপকূল
আফ্রিকার সমৃদ্ধ মুসলিম নিয়ন্ত্রিত নগররাষ্ট্রের ব্যাপ্তি শুরু হয়েছিল দক্ষিণ দিকে সোফালা (আধুনিক মোজাম্বিক) হয়ে উত্তরে মোগাদিসু ( আধুনিক সোমালিয়া)। এর মধ্যখানে ছিল মোম্বাসা, গেডি, পেইট, লামু, মালিন্ডি, জাঞ্জিবার এবং কিলওয়ার মত শহর। সাহিল নগর রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামো ছিল অনেকটা আদিবাসী আফ্রিকান ও আরব মুসলিম রক্তের মিশেলে গড়ে উঠা নতুন একটি প্রজন্ম। পূর্ব উপকূলে আফ্রিকার সবচেয়ে শক্তিশালী নগররাষ্ট্র ছিল মোম্বাসা, কিলওয়া ও মালিন্ডী। এই রাষ্ট্রগুলোর প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য ছিল আইভরি ও স্বর্ণ৷ এছাড়া দাস ব্যবসারও প্রচলন ছিল। কিলওয়া ও মোগাদিসু তাদের নিজস্ব টেক্সটাইল ব্যবসা শুরু করেছিল। একই সাথে এই নগররাষ্ট্র গুলো পার্শ্ববর্তী খনি থেকে তামা উত্তোলন করেও নিজেদের অর্থনীতির ভিত মজবুত করেছিল। সাহিলের নগররাষ্ট্রগুলো লৌহ ও মৃৎপাত্র ব্যবসাও করতো অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সাথে।
মালাক্কা
১৬ শতকের শুরুর দিকে মালয় উপদ্বীপের মালাক্কা শহরটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। মালাক্কা প্রণালীর সংকীর্ণ জায়গায় অবস্থিত এই মুসলিম নিয়ন্ত্রিত রাজ্যটি সারাবছরই যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত থাকত। ইন্দোনেশিয়ায় উৎপন্ন মরিচের ক্লিয়ারিং হাউস হিসেবে মালাক্কা ব্যবহার হতো। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন করে মালাক্কা সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছিল বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে। ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের প্রধান বাণিজ্যিক রুট হিসেবে মালাক্কা প্রণালী আবির্ভূত হয় এবং পূর্ব ও পশ্চিমের প্রায় সব ধরনের বাণিজ্যিক চালান এই প্রণালী দিয়েই পার হতো। ফলে ব্যাপক ব্যবসায়িক গুরুত্বের কারণে মালাক্কায় গড়ে উঠে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রীয় কাঠামো। ভারত মহাসাগর ও চীন সাগরের সকল নাবিকরা এসে জড়ে হতেন মালাক্কায়। মালাক্কার লবঙ্গ, জায়ফল, মরিচ ইত্যাদির ব্যবসা ছিল তখন তুঙ্গে। মালাক্কায় এর বদৌলতে একটি আন্তর্জাতিক ডায়াসপোরা গড়ে উঠে। চীনা, ভারতীয়, জাভানীয়রা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এদের মধ্যে গুজরাটের অধিবাসী ছিল সংখ্যায় বেশি।
শ্রীলঙ্কা
মালাক্কায় যাওয়া ও আসার পথে শ্রীলঙ্কায় যাত্রাবিরতি নিতো জাহাজগুলো। আর এই যাত্রাবিরতিতেই সম্পন্ন হয়ে যেত আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শ্রীলঙ্কায় পাওয়া যেত উন্নতমানের দারুচিনি। এছাড়া আইভরি, মুক্তা ইত্যাদির ভাণ্ডারও ছিল শ্রীলঙ্কা। ভারত মহাসাগরের শ্রীলঙ্কার কৌশলগত অবস্থানও দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সংযোগ সাধনের জন্য শ্রীলঙ্কার ভূখণ্ড জরুরি ছিল। ভারতের পাশে অবস্থানের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা এমন সামুদ্রিক রুটে অবস্থান করছিল যা পূর্ব এশিয়ার সাথে ভূমধ্যসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যকে যুক্ত করেছিল। জাহাজ নোঙ্গর করার জন্য প্রচুর জায়গা ছিল শ্রীলঙ্কায়। ফলে এখানে এসে বড় বড় জাহাজগুলো নোঙ্গর করতো। ১৫ শতকের শেষ দিকে কলম্বো শহর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই শতকের শেষে এসে কলম্বো মুসলিমদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পুরো শ্রীলঙ্কা শাসন করতো তিনটি বৌদ্ধ কিংডম, এই তিন রাজ্যকে আবার নিরাপত্তা দিত চীন।
স্পাইস দ্বীপ
ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের দূরতম পূর্বের স্পাইস দ্বীপ বা মলুক্কাস দ্বীপ (বর্তমান মালুকু দ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া) ছিল লবঙ্গ ও জায়ফলের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান। যদিও ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক হাব থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত ছিল এ দ্বীপ তা সত্ত্বেও বণিকদের এই দ্বীপে লবঙ্গ ও জায়ফলের জন্য আসতেই হতো।
এই অঞ্চলের আরেকটি দ্বীপ ‘বান্দা’ সম্পর্কে জানা যায় প্রাচীন চীনের ঐতিহাসিক রেকর্ড থেকে। এই বান্দা দ্বীপটি মুসলিমদের হাত হয়ে গড়ে উঠেনি। এখানকার বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করতো ‘কায়া’ নামের এক গোষ্ঠী। ইন্দোনেশিয় ভাষায় যার অর্থ ধনী মানুষ। ইউরোপীয়রা আসার আগে বান্দার নাগরিকরা নিজেদের বাণিজ্যে খুব সক্রিয় ছিল। তারা তাদের লবঙ্গ মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেত এবং চীনা ও ভারতীয়দের সাথে ব্যবসা করার জন্য ইন্দোনেশিয়ার বড় দ্বীপগুলোতে লবঙ্গের চালান পাঠাত।
টারনেট ও টিডোর দ্বীপে মুসলমান বণিকদের আগমন ঘটে পনেরো শতকের শুরুতে এবং এই শতকের শুরুতে দুই দ্বীপেই প্রতিদ্বন্দ্বী সালতানাতের উত্থান হয়। এই দুই সালতানাত আবার জায়ফল ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে চীনা ও ইন্দোনেশিয়ার ব্যবসায়ীদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উভয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে চীনা-ইন্দোনেশিয়া ও মুসলিম সালতানাত সংঘর্ষে জড়িয়ে প্রচুর অর্থ অপচয় করে মুসলিম সালতানাত। ইউরোপীয়রা এই অবস্থায় এসে নিজেদের ফায়দা লুটার জন্য টার্নেট ও টিডোর দ্বীপের সাথে একে অপরের বিবাদ আরো উস্কে দেয়।
ইউরোপীয়দের আগমন
ইউরোপে মসলার দুষ্প্রাপ্যতা এই মহাদেশকে পাগল করে তুলেছিল। ফলে তারা মসলার সন্ধানে বারবার পূর্বদিকে অভিযান চালাতে লাগল। মধ্যযুগের ইউরোপীয়দের ধারণা ছিল মসলার উৎস সম্পর্কে জানা থাকলে যেকোন মূল্যে মসলা আহরণ করা যাবে। আর এই উদ্দেশ্যেই যাত্রা শুরু হয় ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও ভাস্কো দা গামার। ভাস্কো দা গামা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করলেন তখন এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের গভীরতা, সুসংগঠিত অবস্থা এবং সম্পদের পরিমাণ দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। ইউরোপীয়দের কোন ধারণাই ছিল না যে এখানে এত গতিশীল একটা অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। ইউরোপীয়রা আসার পর থেকেই ভারত মহাসাগরের দৃশ্যপট বদলে যায়। তাদের শক্তিশালী কামান দ্বারা তারা এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয় যা পরবর্তীতে উপনিবেশবাদের সূচনা করে।