আলাউদ্দিন খলজীর পর দিল্লি সালতানাতের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক। ইতিহাসে তিনি এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং একইসাথে তিনি একজন কৌতুহলদ্দোপীক শাসকও। ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন জাগতিক শান শওকত থেকে মুক্ত, শাসক হিসেবে ছিলেন সৎ, প্রশাসক হিসেবে ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং আচরণে তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর। তার সম্পর্কে ইতিহাসে পরস্পরবিরোধী মত প্রচলিত আছে। কিছু ঐতিহাসিক তাকে উন্মাদ, নিষ্ঠুর হিসেবে উল্লেখ করলেও অনেক ঐতিহাসিক তাকে এক মহান সুলতান হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন। ভারতের ইতিহাসের এই রহস্যময় চরিত্রটির গল্প শুনাবো আজ।
তুঘলক রাজবংশের দ্বিতীয় সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের পিতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ছিলেন তুঘলক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। মোহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রকৃত নাম ছিল ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ জুনা খান। তিনি বাল্যকাল থেকেই জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। তিনি দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানের একজন পণ্ডিত শ্রেণীর লোক ছিলেন। তার ঔষধবিজ্ঞানের ওপরও ভাল ধারণা ছিল। তার উর্দু, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষায় পাণ্ডিত্য ছিল। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ইসলাম ধর্মের অনুশাসন তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন তবে তিনি গোঁড়া ছিলেন না। তিনি পরধর্মে সহিষ্ণু ছিলেন। তিনি মদ্যপান থেকে বিরত থাকতেন। তিনি একজন কোরানে হাফেজ ছিলেন এবং মোহাম্মদের বাইরে ভিন্ন কোন সুলতান সুলভ পদবী গ্রহণ করেননি।
সামরিক জীবনেও তিনি ছিলেন দক্ষ এক কমান্ডার। তার কর্মজীবন শুরু হয় এক সাধারণ সৈন্য হিসেবে। সুলতান নাসিরুদ্দিন খসরু শাহের আমলে তিনি আমির-ই-আখুর বা রাজকীয় অশ্বশালার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হোন। পিতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সময় তিনি দাক্ষিণাত্য অভিযানে নেতৃত্ব দেন। পিতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যু নিয়ে মোহাম্মদ বিন তুঘলককে জড়িয়ে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচলিত আছে। ঘটনাটি এরকম, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক যখন তুঘলকাবাদে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাতির কুঁচকাওয়াজ দেখছিলেন তখন হঠাৎ করে মঞ্চটি ভেঙে যায়। অকস্মাৎ গিয়াসউদ্দিন ও তার দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ খান মারা যান। অনেকে মনে করেন মোহাম্মদ বিন তুঘলক এই ঘটনার জন্য দায়ী কারণ তিনি সিংহাসন গ্রহণে অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন।এই ঘটনার তিন দিন পর দিল্লীর সুলতান হিসেবে তার অভিষেক হয়। তুঘলাকাবাদে নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করার ৪০ দিন পর তিনি দিল্লীতে গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গিয়াসউদ্দিন বলবনের লাল রাজপ্রাসাদে ঘটা করে তার অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সততা ও প্রজ্ঞার জন্য জনগণের তার নিকট প্রত্যাশা ছিল এবং তিনি নিজেও তার পূর্ববর্তী শাসকের তুলনায় ভাল কিছু করতে চেয়েছিলেন। আর এজন্য তিনি তার শাসনের শুরু থেকে পরীক্ষামূলক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল দিল্লী থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর, প্রতীকী তাম্রমুদ্রা প্রচলন, দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি ও কারাচিল অভিযান।
মোহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে প্রথম কৃতিত্ব ছিল মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ। ১৩২৮-২৯ সালে তারামাসিরিনের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী উত্তর পশ্চিম সীমান্তে হামলা চালায় এবং মুলতান ও লাহোর দখল করে। তবে মোহাম্মদ বিন তুঘলক দৃঢ়তার সাথে মোঙ্গলদের প্রতিহত করতে সক্ষম হোন। ফলে পরাজিত মোঙ্গলরা ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তিনি প্রথমদিকে কৃষির উন্নয়নে হাত দেন। তিনি দিওয়ান-ই-কোহী নামের কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিভাগের কাজ ছিল পতিত ও অনাবাদি জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসা, ভূমিহীনদের খাস জমি বণ্টনের ততত্বাবধান করা। ধীরে ধীরে সুলতানের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। তার মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া খেলতে থাকে। আর এই আইডিয়াগুলো তিনি প্রয়োগ করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেন। তিনি ইতিহাসে বিতর্কিত হয়ে উঠেন তার পাঁচ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার জন্য। ঐতিহাসিকরা তার মুণ্ডুপাত করতে থাকেন। কেউ তাঁকে বদ্ধ উন্মাদ, কেউ তাকে অসংগতির স্তূপ ইত্যাদি ভাবে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন।
রাজধানী স্থানান্তর
সুলতানের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত ছিল দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের এই পদক্ষেপ। ১৩২৬-২৭ সালে তিনি এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার এই রাজধানী স্থাপনের বেশকিছু কারণ ছিল। দেবগিরি ছিল দিল্লি সালতানাতের কেন্দ্রে অবস্থিত। ফলে প্রশাসনিক দিক দিয়ে এখান থেকে শাসন করা সুবিধার ছিল। আবার দাক্ষিণাত্যের ওপর নজরদারির জন্যও দেবগিরি ছিল উপযুক্ত স্থান। মোঙ্গল আক্রমণের হুমকি হিসেবে দিল্লি থেকে দেবগিরি ছিল কৌশলগতভাবে নিরাপদ। আগা মাহদী হোসাইন মনে করেন, দেবগিরিকে সুলতান ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর নিয়ে তার উপর সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। ইবনে বতুতা ও জিয়াউদ্দিন বারাণী সুলতানের বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ করেছেন যে তা কখনো ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইবনে বতুতার মতে, সুলতানের আদেশে দিল্লি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল। এমনকি অন্ধ ও খোঁড়া ব্যক্তিকেও টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, দিল্লি থেকে প্রায়ই সুলতানের কাছে বেনামী কিছু চিঠি আসত। এসব চিঠিতে সুলতানকে গালাগালি করা হতো। সুলতান এদের শাস্তি দেয়ার জন্য দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করার পরিকল্পনা করেন।
ইবনে বতুতা মোহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে কাজীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ পরে তার করা এক অপরাধের কারণে সুলতান তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। যদিও পরে তাকে আবার এই দায়িত্বে তিনি বহাল করেন। ধারণা করা হয় সুলতানের প্রতি এই আক্রোশের রেশে তিনি তার সম্পর্কে অতিশোয়ক্তি করেছেন। ১৩৩৪ সালে তিনি দিল্লিকে ধনসম্পদ ও লোকসংখ্যায় বৃহৎ ও সমৃদ্ধ এক শহর বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। ১৩২৭ সালে জনমানবহীন শহর হঠাৎ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে না। ১৩২৯ সালে বাহরাম কিসলু খানের বিদ্রোহ দমন করার জন্য দিল্লি থেকে এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হয়। দিল্লি জনমানবহীন হলে এটা সম্ভব হতো না। এই ঘটনার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে ১৩২৭-২৮ সালে আবিষ্কার হওয়া দুটি সংস্কৃত শিলালিপি। নানান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অবশেষে সুলতান দেবগিরি থেকে প্রত্যাবর্তন করেন ৮ বছর পর। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, সুলতান আসলে রাজধানী স্থানান্তর করেননি। শুধুমাত্র দেবগিরিকে একটি ইসলামি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলার জন্য সেখানে সুফি সাধক নিয়ে গিয়েছিলেন।
খোরাসান অভিযান
পারস্যের ইলখানি শাসক আবু সাঈদের দুর্বল শাসনে সেখানে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এ অবস্থায় সুলতানের দরবারের খোরাসানি আমির তাকে খোরাসান আক্রমণের আহ্বান জানান। মিশরের মামলুক সুলতান আল নাসির ও ট্রান্স অক্সিয়ানার মোঙ্গল শাসক তারামাশিরিন মোহাম্মদ বিন তুঘলককে সহায়তার আশ্বাস দেন। ফলে তিনি ৩ লক্ষ ৭০ হাজারের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেন। কিন্তু মধ্য এশিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সুলতান এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। এই কাজে সাম্রাজ্যের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
প্রতীকী তাম্রমুদ্রা প্রবর্তন
সুলতান তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। ফলে রাজকোষে অর্থের ঘাটতি দেখা দেয়। এছাড়া তার সময়ে ভারতে রূপার ঘাটতি ছিল। ফলে সুলতান নতুন প্রতীকী তাম্রমুদ্রা প্রবর্তন করেন। জনগণ এই সংস্কার ভালভাবে গ্রহণ করেনি। বিদেশি বণিকরাও এই মুদ্রা বিনিময়ে অসম্মতি জানায়। একসময় এই মুদ্রা ব্যাপক হারে জাল হতে থাকে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। নিরুপায় সুলতান অতঃপর এই মুদ্রা বাতিল করেন।
দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি
গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী উর্বর উপত্যকা দোয়াব ছিল দিল্লি সালতানাতের সবচেয়ে উর্বর জায়গা। ১৩৩৪ সালে সুলতান এই অঞ্চলে কর বৃদ্ধি করেন। সুলতান তার সামরিক পরিকল্পনার পেছনে যে অর্থ ব্যয় করেছিলেন তা পোষাতে এবং সে অঞ্চলের কৃষকদের বিদ্রোহী মনোভাব দমন করতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে জিয়াউদ্দিন বারাণী বলেন, কৃষকরা সুলতানের অত্যাচারে ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তখন আসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন কম হয় এবং বর্ধিত করের কারণে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের শস্য পুড়িয়ে বিদ্রোহ করে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। ফলে সুলতানের এই পরিকল্পনাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
কারাচিল অভিযান
সুলতানের আরেকটি উচ্চাভিলাষী সামরিক পরিকল্পনা ছিল চীন ও হিন্দুস্তানের মধ্যবর্তী হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত কারাচিলের হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে ১৩৩২-৩৩ সালে অভিযান। ঐতিহাসিক ফিরিশতা বলেছেন, সুলতান আসলে চীন অভিযানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি সেখানে অভিযান করেন। ১৩৩২-৩৩ সালে ভাইপো খসরু মালিকের নেতৃত্বে তিনি কারাচিলে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। প্রথমদিকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি দখল করলেও প্রাকৃতিক বাঁধা, বৃষ্টিপাতের কারণে সুলতানের বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার পার্বত্য সর্দারদের বার্ষিক করপ্রদানের শর্তে অভিযানের সমাপ্তি টানা হয়। এই অভিযানে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
মোহাম্মদ বিন তুঘলক তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার জন্য সমালোচিত হলেও তিনি আসলে ছিলেন এমন একজন শাসক যাকে ভুল বুঝা হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে সাম্রাজ্যের চেহারা বদলে দিতে৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার এসব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। অতঃপর ১৩৫১ সালে এই আকর্ষণীয় সুলতানের মৃত্যু হয়।