আগরা মুঘল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণতম শহর, রাজধানীও। নতুন রাজধানী শাহজাহানাবাদ তৈরি হতে আরও কয়েক দশক বাকি। এশিয় ব্যবসা রাজপথের হাজারো শহরের সঙ্গে আগরা তীব্রভাবে পাল্লা দেয়। ব্যবসায় উদ্বৃত্ত অর্থনীতি নির্ভর মুঘল হিন্দুস্তানের বড়তম পাইকারি বাজার আগরা – বিশ্বের এমন কোনও দ্রব্য নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। জাহাঙ্গিরকে পাঠানো পারস্যের সুলতানের মাছের দাঁতের হাতল ওয়ালা ছোরার হাতল খুঁজতে সম্রাট তার দলকে পারস্যে পাঠাবার নির্দেশ জারির আগেই কড়িরও কম দামে সেই ধবধবে সাদা মাছের দাঁত আগরা বাজারে মিলেছিল।
আগরায় তখন বিশ্বমানবের মেলা। আকবর পর্তুগিজ জেসুঈটদের জলপানি দিয়ে আগরায় চার্চ বানিয়ে ঠাঁই দিয়েছেন। ব্যবসায়ী উইলিয়াম ফিঞ্চ যখন ১৬১১য় আগরায় আসছেন, আগরায় তখন ফিরঙ্গিদের জন্যে একটা আলাদা পাড়াই তৈরি। তাকে আগরায় স্বাগত জানাচ্ছেন এক পেশাদার ব্রিটিশ সেনা, তিনজন ফরাসী সেনা, একজন ডাচ প্রযুক্তিবিদ এবং একজন ভেনিসিয় ব্যবসায়ী। বহু ইওরোপিয় শুধু মুঘল বাহিনীতেই নয় নানান স্বাধীন রাষ্ট্রের, জমিদারের সেনাবাহিনীতে ভাড়া খাটে।
—
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব জাহাঙ্গিরের স্মৃতিকথা তুজুকইজাহাঙ্গিরিতে উল্লিখিত একমাত্র ফিরঙ্গি অগাস্টিন হিরিয়ার্ত বা সম্রাটের দেওয়া নাম অগাস্টিন হুমরমন্দ এর [দক্ষ অগাস্টিন] কথা। গোটা পশ্চিম পূর্ব এশিয়া বিদেশি বলতে ফিরিঙ্গি অর্থাৎ ফরাসি দেশের মানুষ বুঝত সেই ক্রুসেডের আগের আমল থেকে। ফরাসী দেশ থেকে আসা মণিকার অগাস্টিন। তিনি জাহাঙ্গিরের সোনার সিংহাসন এবং একটি সোনা আর মণিমাণিক্য লাঞ্ছিত বাঘও তৈরি করেন। তিনি শুধু ভারতীয় নামই নেন নি, তিনি জীবনযাপনে ভারতীয়ও বনেছিলেন। নিজে কারিগর হয়ে উঠেছিলেন এবং মুঘলদের মানসিকতা বুঝে তাদের মন জোগানো কাজও করেছেন।
সেই আকবরের আমল থেকে মুঘলেরা কারখানা ব্যবস্থা চালু করেছিল কারিগরদের কেন্দ্রে রেখে। হুমরমন্দ সেই কারিগরদের একজন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কারিগরিবিদ্যা আর প্রযুক্তিকে সমর্থন জানাতে হুমায়ুন হুমরমন্দ উপাধিসহ ৩০০০ দারব, ১৫০০ টাকা[আজকের কয়েক কোটি টাকার সমান], একটি ঘোড়া আর একটি হাতি দিয়ে দরবারি সম্মান জানান।
—
হিরিয়ার্ত বর্দুঁতে জন্মান ১৮৮৫তে। তিনি ভারতবর্ষে পোঁছন ১৬১০এ ইংলন্ড হয়ে। মুঘল হিন্দুস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করা, ভারতীয় মহিলা বিয়ে করা জন মিডেনহলের সঙ্গী হয়ে হিরিয়ার্ত পারস্যে আসেন। ১৬১৩য় যখন তারা লাহোর পৌঁছন তখন মিডেনহল মৃত্যুশয্যায়। হিরিয়ার্তকে তিনি সম্পত্তি দিয়ে যান কন্যাকে বিয়ে করার শর্তে। তবে কন্যার ভবিষ্যৎ বিষয়ে ইতিহাস নীরব।
জাহাঙ্গিরের নজরে পড়েন হিরিয়ার্ত। ১৬৩০ পর্যন্ত মুঘল দরবারে কাটান। সম্রাট তাকে ৮ হাজার লিভার মূল্যের যমুনার তীরে একটি প্রাসাদ দান করেন। আগরায় ইওরোপিয়রা যখন প্রায় দারিদ্র্যে দিন কাটাচ্ছে, তিনি অযুত আভিজাত্যে জীবন যাপন করছেন। দরবারে দীর্ঘকাল টিকে থাকার অন্যতম কারন হল শুধু জাহাঙ্গিরের নয় শাহজাহানেরও কাঞ্চন এবং রত্নের প্রতি দুর্বলতা আবিষ্কার। শুধু হাতি নয় সম্রাট তাঁকে চিতা, গণ্ডার, বাঘও উপহার দেন। প্রতিদানে তিনি জাহাঙ্গির এবং ব্রিটিশ রাজদূতকেও উপহারে ভরিয়ে দিতেন, কিন্তু ব্রিটিশ রাজদূত কোনও উপহারই গ্রহণ করেন নি।
জাহাঙ্গির হুমরমন্দকে তার ব্যক্তিগত জহুরি এবং সামরিক প্রযুক্তিবিদ হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি চিঠিতে জানাচ্ছেন মুঘল সাম্রাজ্যে তার পরিচিতি জহুরির থেকে বেশি সামরিক প্রযুক্তিবিদ হিসেবে। ১৬২৭এ জাহাঙ্গিরের প্রয়াণের পরেও এই পরিচয়েই তিনি আগরায় কাটাতে থাকেন।
ইওরোপিয়দের অপছন্দ করা সম্রাট শাহজাহান সিংহাসনে আসীন হওয়া সত্ত্বেও হুমরমন্দ তার দরবারেও টিকে থাকেন। শাহজাহানের তখতএতাউস বা কোহিনুর লাঞ্ছিত সোনায় মোড়া ময়ূর সিংহাসনের অন্যতম স্থপতি ছিলেন হুমরমন্দ। তিনি ১৬৩২এর ৯ মার্চের চিঠিতে লিখছেন দুবছর ধরে তিনি “making plans for a new throne … the King had required that two hundred times a thousand livres should be spent on this throne in gold, diamonds, rubies, pearls and emeralds.”
তিনি তাজমহলের স্থপতি এরকম একটা মিথ্যে গুজব আজও বাজারে ছড়িয়ে রয়েছে। মাথায় রাখতে হবে এই স্থাপত্যটি মানসিকভাবে এতই অপশ্চমি ধাঁচের যে এটি কোনও পশ্চিমির পরিকল্পনা, এমন ভাবাই কষ্টকর। তিনি হয়ত তাহমহলের মূল রূপোর দরজাটা তৈরি করার বরাত পেয়ে থাকলেও থাকতে পারেন। এছাড়াও আগরা দুর্গেও এধরণের কিছু ধাতুর কাজ হয়তপেয়ে থাকবেন।
ফার্স্ট ফিরঙ্গিজের লেখক Jonathan Gil Harris বলছেন তিনি ২ নম্বর জাতীয় রাজপথের পাশে আগরা ক্যাথলিক সমাধিক্ষেত্রতে গিয়ে হিরিয়ার্ত যার হাত ধরে মুঘল হজিন্দুস্তানে এসেছিলেন জন মিডেনহলের সমাধি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু মিডেনহল যার ভরসায় কন্যা জেনকে ছেড়ে গিয়েছেলেন, সেই হিরিয়ার্ত কন্যাকে গ্রহণ করেন নি, কারন জেন হিরিয়ার্ত নামে কোনও সমাধি খুঁজে পান নি।