খ্রিস্টপূর্ব তেরো শতক। দক্ষিণ-পূর্ব অ্যানাটোলিয়ার কিজুওয়াতনা রাজ্যের লাভাজান্তিয়া শহর। দেবী ইশতারের মন্দিরে পৌরোহিত্য করছেন পুরোহিত পেন্তিপসারি। পাশেই বসে আছেন তার মেয়ে পুদুহেপা। বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই দেবীর পূজা শিখেছেন পুদুহেপা। দেবী ইশতারকে অন্তরে ধারণ করেছেন তিনি। বাবার মতোই একজন পুরোহিত হিসেবে ইশতারের ঘরেই নিজেকে নিবেদিত করেছেন পুদুহেপা।
এক দিন দেবী ইশতার স্বপ্নে দেখা দিলেন পুদুহেপাকে। দেবী তাকে বার্তা দিলেন, শীঘ্রই বিয়ে হবে তার হিট্টাইট রাজা তৃতীয় হাতুসিলির সঙ্গে। তার স্বপ্ন সত্যি হলো! হঠাৎ করেই তৃতীয় হাতুসিলির আগমন ঘটলো লাভাজান্তিয়ায়। মিশরের বিরুদ্ধে সংঘটিত কাদেশের যুদ্ধ থেকে সবেই ফিরেছেন হাতুসিলি। লাভাজান্তিয়ায় তিনি এসেছিলেন দেবী ইশতারের সন্তুষ্টির জন্য বলি দেয়ার উদ্দেশ্যে। এখানে এসেই তার দেখা হলো পুদুহেপার সাথে। রাজা জানালেন, দেবী ইশতার তাকেও স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন এবং পুদুহেপাকে বিয়ে করাই ছিলো স্বপ্নে প্রদত্ত দেবীর নির্দেশ। হাতুসিলি এবং পুদুহেপা উভয়ই এই বৈবাহিক সম্পর্ককে দেবীর আশীর্বাদ মেনে শুভ দিন দেখে বিয়েতে আবদ্ধ হলেন।
হাতুসিলি এবং পুদুহেপার একে অপরের প্রতি জন্ম নিয়েছিলো অশেষ ভালোবাসা, বিশ্বাস ও ভরসা। স্বামীর প্রতি পুদুহেপার ভক্তিও ছিলো অটুট। সংসার জীবন ভালোই কাটছিলো তাদের। তবে কিছু দিন পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন তৃতীয় হাতুসিলি। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পুদুহেপা স্বামীর সুস্থতার জন্য মন্দিরে ভক্তিভরে পূজা ও প্রার্থনা করতে লাগলেন। প্রতিদিন দেবতাদের পূজার উদ্দেশ্যে প্রসাদ তৈরী, পানি দেয়া, পোশাক পরানো, গোসল করানো -কোন কিছুই বাকি রাখেন নি তিনি। হাতুসিলি যেনো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন, সে জন্য দেবী ইশতারকে একটি ষাঁড়ও নিবেদন করেন তিনি। শুধু দেবী ইশতারের কাছেই নয়, সূর্য দেবী আরিনার কাছেও স্বামীর সুস্থতা প্রার্থনা করেন পুদুহেপা।
পুদুহেপার ধারণা ছিলো, কেউ হয়তো তার স্বামীর মৃত্যু কামনা করে দেবীকে প্রসাদ নিবেদন করেছেন। তাই দেবী আরিনাকে উদ্দেশ্য করে পুদুহেপা বলেন, “আমার স্বামী তো আপনার পবিত্র শহর নেরিক পুনঃরুদ্ধার এবং সেখানে প্রতিনিয়ত পূজার্চনাও করেছেন, তার সঙ্গে এমনটা ঘটা অবিচার। আমি সামান্য একজন নারী, আমার প্রতি করুণা করুন, আমার সিঁথির সিঁদুর রক্ষা করুন”। স্বামীকে সুস্থ করে তোলার জন্য দেবীকে ঘুষও নিবেদন করেছিলেন এই নারী। সূর্য দেবী আরিনাকে তিনি প্রস্তাব করেন, তার স্বামী সুস্থ হয়ে গেলে সোনা-রূপার তৈরী হাতুসিলির মূর্তি তিনি দেবীকে উপহার দিবেন।
পুদুহেপা শুধু একজন পতিব্রতা স্ত্রীই ছিলেন না, স্বামীর পথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা হিসেবে প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন তিনি। ইশতারের পুরোহিত, রাজ্যের বিচারক, ধাত্রী, একজন রাজনীতিবিদ ও বহুবিবাহের মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও কাজ করেছেন প্রতিনিয়ত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ, তার এক মহৎ দৃষ্টান্ত ছিলো পুদুহেপা ও হাতুসিলির সম্পর্ক।
রাজা তৃতীয় হাতুসিলির সঙ্গে একত্রে প্রাচীন হিট্টাইট সাম্রাজ্য শাসন করেছেন পুদুহেপা। প্রশাসনিক, আইনি, কিংবা কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজার মতো সমান প্রভাব ছিলো তার। একমাত্র মিশরীয়দের শাসনেই এমনটা দেখা যেতো। নিজের সিলমোহর স্থাপনকারী ইতিহাসের প্রথম নারী ছিলেন পুদুহেপা। কাদেশের যুদ্ধের পর মিশরীয় রাজা রামেসিসের সাথে সংঘটিত শান্তিচুক্তিতে হাতুসিলির সীলমোহরের সাথে পুদুহেপার সীলমোহরও ব্যবহৃত হয়েছিলো। ইতিহাসে বিদেশী শক্তির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরীতে নারী শাসকের সহস্বাক্ষরের ঘটনা এটাই প্রথম। বোঝাই যাচ্ছে, পুদুহেপার স্বাক্ষর কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো! রূপার তৈরী একটি পাতের দুই দিকে পৃথক পৃথকভাবে হাতুসিলি এবং পুদুহেপার সীল ব্যবহৃত হয়েছিলো। ইচ্ছে করলেই এখানে পৃথক সীল ব্যবহার না করে একটিমাত্র যৌথ সীল ব্যবহার করা যেতো। কিন্তু পুদুহেপার সম্পূর্ণ নিজস্ব সীলের ব্যবহার তার যোগ্যতা, ক্ষমতা ও স্বাধীনতারই এক চমৎকার পরিচয় বহন করে।
পুদুহেপা এতো যোগ্য ও ক্ষমতাবান ছিলেন যে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়াই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবেও বিদেশে আদান-প্রদানকৃত চিঠিপত্রগুলোতে তিনি স্বাক্ষর করতে পারতেন। মিশরীয় রাজা রামেসিসের স্ত্রীর সঙ্গেও চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করতেন রাণী পুদুহেপা। রাজা দ্বিতীয় রামেসিসকে ‘ভাই’ এবং তার স্ত্রীকে ‘বোন’ সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন তিনি। রামেসিস নিজেও পুদুহেপাকে ‘বোন’ ডাকতেন, যদিও নিজের স্ত্রীকেও কখনও তিনি এতোটা মর্যাদা দিতে পারেন নি। সাইপ্রাস ও ব্যবিলনের শাসকদের সাথেও পুদুহেপার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি জানা গেছে মাটির ট্যাবলেটগুলো থেকে। এ ছাড়াও বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পদ আদান-প্রদানেরও স্বতন্ত্র ক্ষমতা ছিলো পুদুহেপার হাতে।
রাণী পুদুহেপা পরিণত হয়েছিলেন প্রাচীন ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের একজনে। ধর্ম এবং লিঙ্গ সমতার বিষয়ে এক অনন্য ধারণা উপস্থাপনকারী এই রাণী হয়ে উঠেছিলেন জনগণের প্রধান প্রতিনিধি। রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক জমকালো অনুষ্ঠানে স্বামীর পাশে প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিধবা নারীদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান এবং অভিভাবকহীন কমবয়সী ছেলে-মেয়ে ও এতিম শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্বও নিতেন পুদুহেপা। অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থাও তিনি করে দিতেন।
হিট্টাইট নারীদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো নথি পাওয়া যায় না। তাই রাণী পুদুহেপার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তবে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি হিট্টাইট সমাজে ছিলো খুবই স্পষ্ট। রাষ্ট্রই এই সমতা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতো। বিয়ে, বিচ্ছেদ, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষকে একই মানদন্ডে বিচার করা হতো। নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা সব ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন। স্বামী মারা গেলেও হিট্টাইট রাণীরা নিজের ছেলেদের সাথে সহশাসকের ভূমিকায় কাজ করতে পারতেন। তবে হিট্টাইট রাণীদের মধ্যে কেউই পুদুহেপার মতো এতো যোগ্য ও স্বীকৃত শাসকের মর্যাদা লাভ করেন নি। তিনি কথার মিষ্টতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও কৌশল দিয়ে অর্জন করে নিয়েছিলেন হিট্টাইট সাম্রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা।
হিট্টাইট সমাজে পুদুহেপার এই অবস্থান কিন্তু শুধুমাত্র তার রাণী হবার কারণেই ছিলো না। পুদুহেপা যথেষ্ট শিক্ষিত নারী ছিলেন। তিনি নিজের শহর কিজ্জুওয়াতনার ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ক সমস্ত কিউনিফর্ম ট্যাবলেট সংগ্রহ করে একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। এ ছাড়াও রাজা তৃতীয় হাতুসিলির নিজস্ব সংগ্রহও স্থান পেয়েছিলো পুদুহেপার লাইব্রেরিতে।
পুদুহেপা হিট্টাইট সাম্রাজ্যের শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সাহস ও বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন, তা সেই সময় অবধি কোনো শাসক দেখান নি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার খাতিরে নিজ সাম্রাজ্যের নাগরিকদের বিরুদ্ধে গিয়ে বিদেশীদের পক্ষে রায় ঘোষণা করতেও সামান্যতম কুন্ঠাবোধ করেন নি তিনি।
হিট্টাইট ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া ও লেবাননের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিলো এটি এবং এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে রাণী পুদুহেপা রাজত্ব করে গেছেন বহু বছর। হিট্টাইট সভ্যতার সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতায় সম্রাজ্ঞী বা রাণীরা এতো স্বাধীনচেতা ও প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন নি। সেদিক বিবেচনায় পুদুহেপাকে সে সময়ের অন্যতম স্বাধীন নারী শাসক হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। আধুনিক বিশ্বে নারীর অবস্থান তৈরীতে রাণী পুদুহেপাকে একটি রোল মডেল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।
মেসোপটেমীয় সভ্যতাসহ আরও বেশ কিছু সভ্যতার সংস্পর্শে এসে হিট্টাইট সংস্কৃতি হয়েছিলো অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ইতিহাস থেকে এই সভ্যতার চিহ্ন কিভাবে যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো। সম্প্রতি কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে এই সভ্যতার হাজার হাজার মাটির ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশ পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে এক অসীম জ্ঞানের রাজ্য ধরা পড়েছে ইতিহাসবিদদের কাছে। হয়তো এসব ট্যাবলেটের সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার এক দিন হিট্টাইটদের শক্তি, যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে আরও স্পষ্ট করে আমাদের সামনে তুলে ধরবে।
রেফারেন্স: