থেমে থেমে ঢাকের গুরু-গম্ভীর শব্দ শোনা যাচ্ছে ইতালীর আলবা লংগা (Alba Longa) নগরে। রাজ্প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে কয়েকটি বিশাল ঢাকে ক্ষনে-ক্ষনে আঘাত করছে কিছু রাজকর্মচারী। ঢাকের বিশেষ ছন্দের শব্দ জানান দিচ্ছে রাজার চিরপ্রয়াণ। বর্তমান ইতালীর রোম শহরের ১৯ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত আলবা লংগা অঞ্চলের অধিপতি প্রকাসের (Procas) মৃত্যূতে প্রাসাদে তখন চলছিল শোক। ছোট্র এলাকাটির জনগোষ্ঠীর চোখে-মুখে শোকের ছায়া। সময়টি ছিল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৭৯৪ সাল। এখন থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগের কোন একটি কাল।
অধিপতি প্রকাস রেখে যান তার দু’ ছেলে, ন্যুমিটর (Numitor) এবং আমুলিয়াস (Amulius)। ন্যুমিটরকে করা হয় আলবা লংগার নতুন রাজা। ন্যুমিটারের ছিল দুই মেয়ে, রহেয়া সিলভিয়া (Rhea Silvia) এবং লাউসাস (Lausus)। আমুলিয়াস কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি তার ভাই ন্যুমিটারের ক্ষমতারোহন। পরিকল্পনা করতে থাকলো কি করে ন্যুমিটারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা যায়। শুরু হয় কুটিলতা। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চলছে ক্ষমতার জন্য ষড়যন্ত্র, যা’ সৃষ্টি করেছে অনেক ইতিহাস। কোনটি চমকপ্রদ এবং বিনোদনপূর্ণ, আবার কোনটি বেদনাদায়ক।
বিভিন্ন প্রাচীন লোক-সাহিত্য থেকে জানা যায়, ন্যুমিটারের মেয়ে রহেয়া সিলভিয়া গর্ভবতী হয় যখন দেবতা মার্শ (Mars) তার সাথে মিলিত হয় একটি বিশেষ উদ্যানে। অবশ্য প্রাচীন রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাটুস লিভিররের (Titus Livy) বর্ণনায় রহেয়ার সন্তানের পিতা অন্য এক ব্যক্তি। রহেয়া সিলভিয়া যখন গর্ভবতী, হঠাৎ করেই তার বাবা ন্যুমিটারকে ক্ষমতাচ্যূত করে আমুলিয়াস নিজেকে আলবা লংগার রাজা ঘোষণা করে। এ’র কিছুদিন পরেই রহেয়া সিলভিয়া আলবা লংগায় জন্ম দেয় দুই যমজ পুত্র-সন্তান, যাদের নাম রোমুলাস এবং রেমুস।
রোমুলাস এবং রেমুসের জন্মের সংবাদ শুনে রাজা আমুলিয়াস হয়ে পড়ে ক্ষুদ্ধ। যমজ দুই ভাইকে তার ক্ষমতার হুমকি ভেবে, তাদেরকে হত্যার পরিকল্পনা করে আমুলিয়াস। তার নির্দেশে রাতের অন্ধকারে শিশু দু’জনকে একটি ঝুড়িতে করে গোপনে ফেলে আসা হয় টাইবের (Tiber) নদীতে। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস, নদীর দেবতা টাইবেরিনুস (Tiberinus) তাদেরকে উদ্ধার করে রেখে আসে নদীর তীরে লুপেরকাল (Lupercal) নামের একটি গুহায়। অন্যদের ধারণা, ঝুড়িটি ভাসতে ভাসতে পৌঁছায় ফিকউস রুমিনালিস (Ficus Ruminalis) নামের এক ডুমুর গাছের নীচের লুপেরকাল গুহায়। রোমান লোক-সাহিত্যের বর্ণনায়, ঐ গুহায় তারা ধীরে-ধীরে বেড়ে উঠে একটি নেকড়ে বাঘের দুধ পান করে। প্রাচীন রোমান বিশ্বাসে আরো জানা যায়, একটি কাঠ-ঠোকরা পাখীও তাদেরকে খাবার সরবরাহ করতো নিয়মিত। পরে, ফাউসটুলুস (Faustulus) নামের এক রাখাল এবং তার স্ত্রী আক্কা ল্যারেন্টিনা (Acca Larentina) তাদেকে ঐ গুহায় পরিত্যক্ত দেখে নিয়ে যায় নিজেদের বাড়ীতে। তারা সন্তানের মতো লালন-পালন করতে থাকে রোমুলাস এবং রেমুসকে। দু’ভাইয়ের কৈশোর কেটে যায় ফাউসটুলুস এবং আক্কা পরিবারের গবাদি পশু প্রতিপালন এবং পরিচর্যা করে (দেখুন তথ্য সূত্র (২)।
সময়ের আবর্তে ভাতৃদ্বয় সেখানে স্থানীয়ভাবে হয়ে উঠে অনেক জনপ্রিয়। তারা যখন যুবক, দু’ভাই জড়িয়ে পড়ে ন্যুমিটর এবং আমুলিয়াসের সমর্থক নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে। পরিণতিতে, আমুলিয়াসের লোকজন রেমুসকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় কারাগারে। তাদের পিতামহ ন্যুমিটর এবং তখনকার রাজা আমুলিয়াস দু’ভাইয়ের পরিচিতি নিয়ে সন্দেহ করতে থাকে। ইতিমধ্যে, অনেক চেষ্টা করে রোমুলাস তার ভাই রেমুসকে কারাগার থেকে মুক্ত করে। রোমুলাস এবং রেমুস তাদের সমর্থক নিয়ে পিতামহ ন্যুমিটরকে সহায়তা করে আমুলিয়াসকে আলবা লংগা থেকে ক্ষমতাচ্যূত করতে সক্ষম হয়। অনেক প্রচেষ্টার পর আমুলিয়াস হয় নিহত এবং ন্যুমিটর ফিরে পায় তার ক্ষমতা।
রোমুলাস এবং রেমুস পরিকল্পনা করে নতুন একটি শহর গড়ে তুলতে। তারা উপস্থিত হয় সাত পর্বতের একটি এলাকায়।এলাকা বাছাই করা নিয়ে দু’ ভাইয়ের মধ্যে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। রোমুলাসের পছন্দ পালাটিন পাহাড় (Palatine Hill), কিন্তু রামুসের আগ্রহ এভেন্টিন পাহাড় (Aventine Hill)। যখন তারা তাদের দ্বন্দ্ব মিটাতে অক্ষম, তারা সাহায্য চায় বিধাতার কাছে আগুরি (Augury) নামের এক প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে। রেমুস প্রথম দেখলো ছয়টি শুভ পাখী, আর রোমুলাস দেখতে পেলো বারোটি। রোমুলাস দাবী করলো, প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে সে। কারণ, রোমুলাস দেখতে পেয়েছে সবচেয়ে বেশী পাখী। রেমুস মেনে নিতে পারলো না রোমুলাসের জয়। রোমুলাস পালাটিন পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তুলতে লাগলো নতুন এক শহর। নির্মাণ করলো নগর প্রাচীর। রেমুস রোমুলাসের প্রস্তাবিত শহরকে উপহাস করতে থাকলো বিভিন্নভাবে। রোমুস একদিন রোমুলাসের নগর প্রাচীরের উপর উঠে আঘাত করতে থাকলো ক্ষুব্ধ হয়ে। রোমুলাস আর সহ্য করতে না পেরে রেমুসকে হত্যা করে সেখানেই। অনেকের ধারণা, রেমুসকে হত্যা করা হয় নি, বরং রেমুস প্রাচীর থেকে পড়ে গিয়েই মৃত্যু বরন করে।
ধারণা করা হয়, রোম শহর প্রতিষ্ঠা করা হয় আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৭৫৩ সালের ২১শে এপ্রিল। রোমুলাস দ্রুত সম্পন্ন করে নতুন নগর প্রতিষ্ঠার কাজ, গড়ে তুলে শাসন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক স্থাপনা। শহরটির নামকরণ করা হয় রোমুলাসের নাম অনুসারে -রোম। গোড়াপত্তন হয় রোমান সাম্রাজ্যের। রোমুলাস রোম নগরের জনসংখ্যা বাড়াতে এলাকার সকল পলাতক এবং নির্বাসিতদের আহ্বান জানালো নতুন শহর রোমে ফিরে আসতে। পার্শবর্তী রাজ্য সাবিনের (Sabine) জনগণকেও আমন্ত্রণ করলো রোমের বিভিন্ন উৎসবে যোগ দিতে। রোমুলাস সাবিনের রাজা টিটুস ট্যাটিউসের (Titus Tatius) সাথে সন্ধি করে সহ-অবস্থানের এবং সহ-শাসনের। কিন্তু কিছুদিন পরেই রাজা টিটুসের মৃত্যু হলে, রোমুলাস হয়ে পরে সাবিন এবং রোমের একচ্ছত্র অধিপতি। গড়ে তুলে রোমান সাম্রাজ্যকে আরো শক্তিশালী করে। দীর্ঘ শাসনের পর হঠাৎ করেই এক ঝড়ের রাতে রোমুলাস হয়ে যায় অদৃশ্য। অনেক চেষ্টার পরও মিললো না রোমুলাসের সন্ধান। রোমানরা বিশ্বাস করতে লাগলো যে, রাজা রোমুলাস রুপান্তরিত হয়েছিলেন দেবতায়। রোমানরা তাকে দেবতা কুইরিনাস (Quirinus) মনে করে পূজা করতে লাগলো তখন থেকেই।
রোমুলাস এবং রেমুসের ইতিহাসটির মূল ভিত্তি জনপ্রিয় রোমান লোক-সাহিত্য এবং স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস। এই লোক-কাহিনীর প্রথম লিখিত প্রমান মেলে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে। রোমান কবি এবং লেখক ভার্জিল (Publius Vergilius Maro) তার অসমাপ্ত মহাকাব্য The Aeneid-তে বিবরণ দিয়েছেন রোমুলাস এবং রেমুসের এই লোক-কাহিনী। তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে রোম শহর এবং রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তার লেখায় দু’ ভাইয়ের নেকড়ে-বাঘের দুধ পান করার প্রতীকী জানান দেয় রোম সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের পেছনের গল্প। এক ভাইকে হত্যা করে অন্য ভাই; এরই মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি হয় রোমান সাম্রাজ্য। ২০০৭ সালে রয়টার জানায়, যে গুহায় রোমুলাস এবং রেমুস নেকড়ের দুধ খেয়ে বেঁচেছিল, সেটির সন্ধান পেয়েছে একদল ইতালীর প্রত্নতাত্ত্বিক (দেখুন তথ্য সূত্র (১))।
রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রোমুলাস এবং রেমুসের ইতিহাসটি ছাড়াও গ্রীক পৌরাণিক সাহিত্যে দেখা মেলে দার্শনিক স্ট্রাবোর (Strabo) বর্ণনায় অন্য আরেকটি উপাখ্যানের। স্ট্রাবোর মতে, রোম নগর আদতে প্রতিষ্ঠা করে গ্রীকরা। রোম প্রথমে ছিল ইতালীর একটি ছোট্র আরাকাডিয়ান (Arcadian) কলোনী। ট্রজান যুদ্ধের (Trojan War) ষাট বছর আগে পালাটিন পাহাড়ের (Palatine Hill) পাদদেশে ঐ কলোনীকে ভিত্তি করে রোম শহর প্রতিষ্ঠা করে এভান্ডার (Avander) নামের এক গ্রীক, যিনি গ্রীস থেকে ইতালিতে এসে বসবাস করেন ঐ সময়। স্ট্রাবোর বর্ণনায় রোমুলাস এবং রেমুসের নেই কোন উল্লেখ।
ইতিহাসেরও পেছনে থাকে আরেক ইতিহাস। কোনটি বিভ্রান্তিপূর্ণ, কোনটি একেবারেই ভিন্ন, আবার কোনটির ভিত্তি সম্পূর্ণভাবেই কল্প-কাহিনী -বিনোদন মাত্র। দিন শেষে পাঠকই সিদ্ধান্ত নেয়, কোনটি তার কাছে গ্রহণযোগ্য।
তথ্যসূত্র:
(১) Silvia Aloisi: “Romulus and Remus cave may have been found: experts,” Reuters news (২০ জুলাই ২০০৭)
Romulus and Remus cave may have been found: experts
(২) Britannica, “Ancient Rome,” Ancient Rome