মেক্সিকোর পাইনালা শহর। দিনের আলোয় ঝকঝক করছে শহরের আনাচে-কানাচে। মিষ্টি-মধুর সুরে ডেকে চলেছে পাখিরা। ছুটোছুটি করে খেলছে বাচ্চাদের দল। তাদের মাঝেই রয়েছেন সাত বছর বয়সী এক ছোট্ট রাজকন্যা। নাম মালিনালি। পাইনালা শহরের প্রধান রাজার ভীষণ আদরের মেয়ে এই দুরন্ত রাজকন্যা মালিনালি। প্রাণ ও চাঞ্চল্যে ভরপুর রাজকন্যার দু চোখ ভরা স্বপ্ন। বেশ ভালোই চলছিলো সব কিছু। হঠাৎ করেই একদিন মারা গেলেন পাইনালার রাজা। বাবাকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লেন ছোট্ট রাজকন্যা। বাবাই তো ছিলেন তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
রাজার মৃত্যুর পর যতোই দিন যেতে লাগলো, ততো বেশি খারাপ দিন গুণতে লাগলেন মালিনালি। কিছু দিন পরই অন্য এক অঞ্চলের রাজাকে বিয়ে করে ফেললেন মালিনালির মা। নতুন ঘরে মালিনালির মা জন্ম দিলেন ছেলে সন্তান। এবার সতর্ক হয়ে গেলেন তার মা। রাজ্যের উত্তরাধিকার একমাত্র ছেলেকেই করতে চান তিনি। মালিনালি পরিণত হলেন তার জন্য এক উটকো ঝামেলায়। যেভাবেই হোক, এই আপদ বিদায় করতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে মালিনালিকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিলেন তার মা। লাভই হলো তার। আপদও বিদায় হলো এবং টাকাও পেলেন। আর ওদিকে দুর্ভাগ্য ও অনিশ্চয়তার পথে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কেনা-বেচা হতে লাগলেন পাইনালা শহরের রাজকন্যা মালিনালি।
ক্রীতদাসী হয়েও মালিনালি সত্যিকারের একজন রাজকন্যার মতোই ছিলেন। বুদ্ধি, সৌন্দর্য ও গুণে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়া। ক্রমাগত নতুন নতুন জায়গায় বিক্রি হবার সুবাদে খুব দ্রুতই অসংখ্য ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে ফেলেন তিনি। সেই সাথে অর্জন করেন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দক্ষতাও। তবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার গুণ ও দক্ষতার দিকে দৃষ্টিপাত করবার সময় কারো ছিলো না। তিনি শুধুই একজন ক্রীতদাসী ছিলেন মানুষের কাছে।
মালিনালি পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে থাকলেন ক্রমাগত। এক পর্যায়ে মিষ্টি ও নিষ্পাপ রাজকন্যার মনে বাসা বেঁধে বসলো রাগ, ক্ষোভ ও ঘৃণা। এই ঘৃণা নিজের পরিবার, নিজের স্বজাতির প্রতি, যারা আপন হওয়া সত্ত্বেও প্রতি মুহূর্তে তার সাথে অন্যায় আচরণ করেছে। মেক্সিকান জগণকে তিনি সব সময় নিজের শত্রু হিসেবে দেখতেন। সবাই মিলে তো তার নামটিও কেড়ে নিয়েছিলো। অন্য অনেক ক্রীতদাসীর সঙ্গে তাকেও কিছু না জানিয়ে খ্রিস্টান বানানো হয়েছিলো এবং তার নাম পাল্টে রাখা হয়েছিলো ডোনা মারিনা। তিনি একটি ভালো সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। নিজের স্বজাতিকে উচিৎ শিক্ষা দেবার সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি।
এদিকে মেক্সিকোর সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছিলো অ্যাজটেক জাতি। স্বর্ণের প্রাচুর্যই ছিলো তার প্রধান কারণ। তবে তাদের সুযোগ্য রাজা দ্বিতীয় মকটেজুমার প্রচেষ্টাকেও অবহেলা করা যাবে না। অ্যাজটেকদেরকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির চরম শিখরে পৌছে দিয়েছিলেন রাজা মকটেজুমা। তার শাসনকালে অ্যাজটেক সাম্রাজ্য দখল করবার সাহস কারো ছিলো না। তবে সুদূর স্পেনে একজন ছিলেন, যার নিয়তিতে লেখা হয়েছিলো মকটেজুমার পরাজয়। তার নাম হার্নান্দো কোর্তেস। দেখতে তিনি ভীষণ রোগা ও ফ্যাকাশে। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যেকেই ছিলো সন্দিহান। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় এই তরুণের যোগ্যতা ও মনোবলের সামনে সবাই-ই হার মেনেছিলো।
অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থেকেই শক্তিশালী স্বর্ণভূমি অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের দিকে এগোতে থাকেন কোর্তেস। অনেক প্রতিকূলতা পার হয়ে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ লাভ করেন কোর্তেস। তবে তার গন্তব্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষার দুর্বোধ্যতা। এমন সময় তিনি পেয়ে যান বহুদিন ধরে মায়ানদের কাছে আটক থাকা জেরোনিমো ডি অ্যাগুইলারকে। অ্যাগুইলার ছিলেন স্প্যানিশ। কিন্তু মায়ান ভাষাও জানতেন তিনি। তাই মায়ানদের সাথে যোগাযোগ করবার জন্য কোর্তেস তার সাহায্য নিলেন। কিন্তু অ্যাজটেকদের নাহুয়াতল ভাষা তো এখনো দুর্বোধ্য তাদের কাছে। এমন সময় কোর্তেসের সাথে দেখা হয়ে গেলো মালিনালির। আর এই ঘটনার সাথে সাথে কোর্তেস এবং মালিনালি উভয়ের জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের।
মালিনালিকে দেখে অদ্ভূত অনুভূতি হয় কোর্তেসের। মায়ানদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া বিশ জন ক্রীতদাসীর মাঝে এই মেয়েটিই কেনো তার নজর কাড়লো, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কোর্তেস। মালিনালির মতো আকর্ষণীয় নারী তিনি কখনোই যেনো দেখেন নি। আস্তে আস্তে তার সাথে কথা বলে কোর্তেস বুঝে ফেললেন মালিনালি অসম্ভব যোগ্য ও বুদ্ধিমতী। মালিনালি নাহুয়াতল ভাষাও জানতেন, আবার মায়ান ভাষাও জানতেন। ফলে কোর্তেসের জন্য মালিনালি এবং অ্যাগুইলারকে নিয়ে কাজ করা খুব সহজ হয়ে গেলো। কিছুদিনের মধ্যে স্প্যানিশও শিখে ফেললেন মালিনালি, যার ফলে অ্যাগুইলারের প্রয়োজনীয়তাও মিটে গেলো। শুধু তা-ই নয়, কোর্তেস আবিষ্কার করলেন, এই মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া পরামর্শগুলোই তাকে সবচেয় বেশি সাহায্য করছে।
ওদিকে মালিনালিও কোর্তেসের মাঝে হঠাৎ করেই এক নতুন জীবন খুঁজে পেলেন নিজের জন্য। কোর্তেস অ্যাজটেকদের পদানত করতে চান। এটাই তো সুযোগ তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবার। তা ছাড়া বাবার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে কোর্তেসের কাছে যে সম্মান তিনি পেয়েছেন, তার জন্য তিনি জীবন দিতেও পিছপা হবেন না। তিনি তার সর্বোচ্চটা দিয়ে কোর্তেসের সহযোগিতা করে গেলেন।
শেষ পর্যন্ত কোর্তেস ঠিকই সক্ষম হয়েছিলেন শক্তিশালী অ্যাজটেক রাজা মকটেজুমাকে পরাজিত করে অ্যাজটেকভূমি দখল করতে। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, মালিনালির সহযোগিতা না থাকলে কোর্তেসের এই জয় কখনোই সম্ভব হতো না। মালিনালির ভূমিকা কোর্তেসের জীবনে ছিলো সবচেয়ে বেশি। তার গর্ভে কোর্তেসের একটি ছেলে সন্তান হবার কথাও জানা যায়। আসলে মালিনালি এবং কোর্তেস উভয়েই ছিলেন উভয়ের গন্তব্য এবং সুযোগমতো উভয়েই নিজের সঙ্গীকে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। কিন্তু এতো সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যের ইতি টানবার জন্য হার্নান্দো কোর্তেসকে ইতিহাস যতোটা না খারাপ দেখিয়েছে, তার চেয়ে বেশি খারাপ বানিয়েছে ভুক্তভোগী মালিনালিকে।
অসংখ্য নামে পরিচিত এই মালিনালি বা ডোনা মারিনাকেই বর্তমানে লা মালিনশে পরিচয়ে সবাই চেনে। তবে লা মালিনশেকে অধিকাংশরাই একজন কুখ্যাত প্রতারক হিসেবেই জানে। স্বজাতির সাথে প্রতারণা করবার জন্যই এমন অভিযোগ। আসলে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হলো অপর কারো উপর নেতিবাচক অঙ্গুলি প্রদর্শন। যারা লা মালিনশেকে প্রতারক আখ্যা দেয়, তারা কিন্তু কখনো এই প্রশ্ন তোলে নি যে, কেনো প্রতারকে পরিণত হলেন এক সময়ের এক বুদ্ধিমতী সুন্দরী মিষ্টিকথার রাজকন্যা। কারো সাথে ক্রমাগত ঘটে যাওয়া অন্যায় এবং পরিস্থিতির প্রতিকূলতা একজন মানুষকে চিরতরে বদলে দিতে পারে। আর সেটাই ঘটেছিলো মালিনশের জীবনে। মালিনশে আসলে একজন চরম ভুক্তভোগী ছিলেন, যিনি পরিস্থিতির কারণে একজন প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ নারীতে পরিণত হয়েছিলেন।
রেফারেন্সঃ
- ডোনা ‘লা মালিঞ্চে’ মেরিনা সম্পর্কে 10টি তথ্য
- The origin story of Malinche, controversial translator, advisor & lover of Cortes| History of Mexico – YouTube Link
- La Malinche : A Misunderstood Legend | Untold Stories of Malintzin’s Life -YouTube
- Doña Marina “La Malinche”, the Most Important Woman in Mexican History: Mexico Unexplained, Ep 20 – YouTube