ভারতীয় উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দেশভাগের অন্যতম কথাকার সাদাত হাসান মান্টো উপমহাদেশের আরো অনেক সাহিত্যিকের মতোই নিজের জীবদ্দশায় অবহেলিত ছিলেন। অথচ দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, দাঙ্গার আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিদ্বেষ তাঁর মত করে এত দরদী কলমে চিত্রিত করেছেন খুব কম সাহিত্যিকই। আবার সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগেও অভিযুক্ত হয়েছেন। আদালতে দাঁড়িয়ে অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, “একজন লেখক তখনই কলম ধরেন, যখন তাঁর সংবেদনশীলতা বা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়।”

১৯১২ সালের ১১ই মে পাঞ্জাবের লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামে মান্টোর জন্ম। তাঁর কৈশোর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ছাত্র হিসেবে খুবই খারাপ ছিলেন। জীবনের মধ্যভাগে যে মান্টো উর্দু সাহিত্যের সেরা ছোটগল্পগুলো রচনা করে গিয়েছেন, তিনি সেই উর্দুতেই তিনবার অকৃতকার্য হয়ে চতুর্থবারে কোনক্রমে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে মান্টো আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে পরিচিত হন। এই পরিচয় তাঁর জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কালক্রমে পণ্ডিত আবদুল বারির পরামর্শে মান্টো ফরাসি এবং রাশিয়ান সাহিত্য পড়তে শুরু করেন। কয়েক বছর পর তিনি এইসব ফরাসি এবং রাশিয়ান সাহিত্য উর্দুতে অনুবাদ করেন এবং ছোটগল্প লেখাও শুরু করেন। আবদুল বারির পত্রিকাতেই তাঁর প্রথম গল্প ‘তামাশা’ প্রকাশিত হয়, যদিও ছদ্মনামে। কলেজের পড়া শেষ করে ১৯৩৪ সালে তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর সেসময়কার ছোটগল্পগুলোর মধ্যে ‘ইনকিলাব পসন্দ’ নামে একটি প্রকাশিতও হয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিবাদীদের দলে মিশে রাজনীতিসচেতন এই নবীন কিশোর ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনেও যোগ দিতে শুরু করেন।

কিন্তু প্রগতিশীল লেখক সংঘের ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতার সাহিত্যে তিনি আটকে থাকেননি। প্রখ্যাত উর্দু লেখক আলি সর্দার জাফরি বলেছিলেন, “মান্টোর গল্প মধ্যবিত্ত মানুষের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের কথা বলে।” সর্দার জাফরির এই উক্তি যে কতখানি নির্মম সত্য তা বোঝা যায় মান্টোর যেকোন গল্প পড়লেই। সমাজের নিচুতলার পানওয়ালা, দোকানদার, ড্রাইভার, ধোপা, দালাল, বেশ্যা ও অসংগঠিত শ্রমজীবীদের আত্মার অন্দর খুলে উঁকি দিয়েছিলেন তিনি। যে চরিত্রগুলির প্রত্যেকের মানুষ হয়ে উঠবার কথা এবং যোগ্যতা দুইই ছিল, অথচ এই নির্মম সমাজ তাদের কাউকেই সে সুযোগ দেয়নি; ক্ষয়িষ্ণু সময়ের অবচেতনে অমানুষ হয়ে ওঠা সেইসব চরিত্ররাই ফুটে উঠেছে মান্টোর কলমে।

১৯৪১-১৯৪৩ সালের মধ্যে তিনি কয়েকটি রেডিও নাটক লেখেন। ১৯৪৫ সালের মধ্যে ‘ধুয়া’, ‘কালো সালোয়ার’ এবং ‘বু’ নামে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। কাশ্মীরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুফিয়া নামের তরুণীকে বিয়ে করেন। তাঁর তিন মেয়ে এবং এক ছেলে হয়েছিল। যদিও পুত্রসন্তানটি মাত্র এক বছর বেঁচেছিল। এরপর আসে তাঁর জীবনের মানসিকভাবে ভয়াবহ এক অধ্যায়। যে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে ১৯৩৬ সাল থেকে চলে এসেছে তাঁর বোহেমিয়ান দিনযাপন, চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে দহরম-মহরম, ফিল্মের চিত্রনাট্য রচনা থেকে মাতাল ও বেশ্যাদের ডেরায় ঘুরে বেড়ানো; স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর কি দ্রুতবেগে সেই শহরেই ছড়িয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাষ্প। বস্তুত সমগ্র উত্তর ভারতই, আর তত দিনে তত সেকুলার নেই। তার ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক শপথের আড়াল থেকে উঁকি মারছে মুসলিমদের একঘরে করার, কাজ না দেওয়ার, ভাতে মারার বা হুমকি দিয়ে তাড়ানোর প্রচ্ছন্ন চক্রান্ত। ঠিক ঐ সময়টাতেই তিনি একজন মুসলিম হবার ‘অপরাধে’ বোম্বে টকিজ ফিল্ম থেকে তার স্ক্রিন রাইটারের চাকরি হারান। পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে শরণার্থী হিসেবে তিনি পরিবারসহ আশ্রয় নেন পাকিস্তানের লাহোরে।

সেখানেও লেখক হিসেবে খুব বেশি গুরুত্ব পাননি। জীবিকা উপার্জনের জন্য পাকিস্তানেও যোগ দিয়েছিলেন ফিল্ম কোম্পানিতে। কিন্তু পরপর দুটো চলচ্চিত্র ফ্লপ হওয়ায় সে রাস্তায় খুব বেশি এগোতে পারেননি। একমাত্র অবলম্বন পত্রিকায় লিখে রোজগার। কিন্তু দেশভাগের পূর্বেও গল্পে অশ্লীলতা ছড়াবার দায়ে তিনবার মান্টো অভিযুক্ত হন। দেশভাগের পর পাকিস্তানে গিয়েও তাঁকে একই অভিযোগে আরো তিনবার অভিযুক্ত হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। ইংরেজ সরকারের সময়ের অশ্লীলতার অভিযোগে করা মামলা নতুন দেশের সরকার উঠিয়ে নেয়নি। আমৃত্যু সেই বোঝা তাঁকে বইতে হয়েছে। তাই তাঁর লেখা ছাপতে পত্রিকার সম্পাদক ভয় পান। শেষপর্যন্ত তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে গিয়ে নাছোড়বান্দার মতো টাকা চান, পরে লিখে শোধ করে দেবেন বলে। এমন হিসাবে তো পত্রিকা চলে না। সম্পাদক কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বলেন—মান্টো সাহেব, কিছু একটা লিখে দিন। মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে দেড় পৃষ্ঠা‌। এভাবে লেখা ৩২টা গল্প নিয়ে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘সিয়াহ হাশিয়ে’, মানে ‘কালো সীমানা’। এক অর্থে কালো সীমানা নতুন দেশের সীমান্ত, মান্টো যাকে কালোই বলতেন; আরেক অর্থ হলো, পত্রিকায় কোনো শোকসংবাদ বা দুঃখের সংবাদ যে কালো বর্ডারে ছাপা হয়, সেই কালো সীমানা।

আশ্চর্যের বিষয়, পাকিস্তানে থাকাকালীন লেখক হিসেবে তেমন গুরুত্ব না পেলেও তিনি সেই সময় যেসব গল্প লিখেছিলেন, সেগুলোকেই তাঁর সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে ধরা হয়। ভালোবাসার শহর বোম্বে থেকে পালিয়ে এসে তিনি অতিমাত্রায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তিনি খুব বেশি মাত্রায় অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। দেশভাগ নিয়ে এই সময়টাতে ‘টোবা টেক সিং’ সহ আরো বেশ কিছু বিখ্যাত গল্প তিনি লেখেন। “লিভার সিরোসিস”-এ আক্রান্ত হয়ে শেষপর্যন্ত ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারী লাহোরের হল রোডে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৪৩ বছরের জীবনে কি প্রবল উদ্যমে লিখে রেখে গেছেন ২২টি ছোটগল্পের সংকলন, ১টা উপন্যাস, রেডিও নাটকের ৭টা সংগ্রহ, ৩টা প্রবন্ধ সংকলন আর ২টা চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা!

ভারত ভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও সেই রক্ত হিম করা গল্পগুলো শুনিয়ে যাচ্ছেন সাদাত হাসান মান্টো। তিনি দেখেছেন যে বর্তমান যখন অতীত হয়, তখন সবকিছু প্রয়োজনমতো বদলে দেওয়া হয়। তাই যা ঘটেছে, তার অবিকল ফটোগ্রাফ যেন রেখে গেছেন, ঘৃণার বা সহমর্মিতার কোনো রং না লাগিয়ে। পক্ষপাতহীনভাবে যেন কোনো তত্ত্ব বিশ্লেষণ, কোনো বেদনাবোধও ছাড়াই মান্টো লিখে রেখে গেছেন চলমান ঘটনাপরম্পরা।

তিনি লিখেছেন ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’র মতো গল্প, যাতে প্রতিবেশী হিন্দু বালিকা শারদার প্রেমে পড়া মুসলিম কিশোর মুখ্তার ‘প্রেমের ধর্মের কাছে আর সব ধর্মই তুচ্ছ’ ঘোষণা করেও বিয়ের জন্য প্রেমিকাকে ইসলাম গ্রহণে চাপ দেয়। অথচ শারদা যখন তাকে হিন্দু হতে বলে, তখনই মুখ্তার ইসলামের উৎকর্ষ আর পৌত্তলিক হিন্দুত্বের অপকর্ষ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ‘বুকের মধ্যে ইসলাম গুঁজে নিয়ে’ শারদার বন্ধ দরজা থেকে ফিরে আসে।

কিংবা ‘ফিরে আসা’ গল্পটি, যেখানে দাঙ্গায় স্ত্রী-হারানো সিরাজুদ্দিন পরমাসুন্দরী কন্যা সাকিনাকে উদ্ধার করতে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করেন। কিছু দিন পর স্ট্রেচারে-শোয়া অচেতন মেয়েকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে দেখে ফিরে-পাওয়ার আনন্দে সিরাজুদ্দিন পিছু-পিছু ঢোকেন। ডাক্তার তাঁকে ঘরে আলো আসার জানলা দেখিয়ে বলেন, ‘খুলে দাও’। অর্ধচেতন সাকিনা তৎক্ষণাৎ নিজের সালোয়ারের দড়ি আলগা করে নামিয়ে দু’পা ফাঁক করে দেয়। এতবার সে বিধর্মী হিন্দু ও স্বধর্মী মুসলিমদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে, যে ‘খুলে দাও’ উচ্চারণে সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় তার হাত সালোয়ারের দড়িতে চলে যায়।

আবার তাঁর ‘গন্ধ’ গল্পটিতে বিত্তবান তরুণ রণধীর এক বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় ভিজে-কাপড়ের মজদুরনিকে তার বিলাসবহুল ঘরে আশ্রয় দিয়ে কালক্রমে সম্ভোগে লিপ্ত হয়। এই যৌনতায় সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তার ঘামে-ভেজা শরীরের দুর্গন্ধ, যা রণধীর নিজের সর্ব শরীর ও চেতনা দিয়ে আকণ্ঠ পান করে। গল্পের শেষে জেলাশাসকের গ্র্যাজুয়েট কন্যার সঙ্গে বাসররাত্রির আসঙ্গেও রণধীর সেই গন্ধের অনুপস্থিতিতে কামার্ত হয়ে উঠতে ব্যর্থ।


‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ গল্পে দেখি, দেশভাগের সময়কার দাঙ্গায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিংহ ঘরে ফিরে কিছুতেই প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছে না। প্রেমিকার সন্দেহ, তার মরদ নিশ্চয় অন্য নারীসঙ্গে মজেছে। ঈর্ষার জ্বালায় মরদেরই তরবারি কোষমুক্ত করে সে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে। মুমূর্ষু ঈশ্বর স্বীকার করে, সে এক অচেতন মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারে আসলে সে বালিকাটির শবের সঙ্গে…। কিন্তু এ গল্পের তীব্র সংবেদনশীলতা বোঝেনি পাকিস্তান। “আমরা মুসলমানরা এতই আত্মমর্যাদারহিত যে আমাদের মৃত কন্যাদেরও শিখরা ধর্ষণ করে যায়?”—এমন প্রশ্ন তুলে লাহোর আদালতে মামলাও দায়ের হয় মান্টোর বিরুদ্ধে। আদালতে যখন তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে প্রখ্যাত উর্দু কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ বলছেন, “এই লেখা অশ্লীলতা নয়, তবে সাহিত্য পদবাচ্যও নয়”, তখন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছেন মান্টো। প্রগতি সাহিত্য শিবিরের তরফ থেকে বারবার অভিযোগ উঠছে, মান্টোর সাহিত্য নৈরাজ্যকামী, হতাশাবাদী। আর মান্টো উত্তরে সব পক্ষকেই বলছেন, “আমি একটা আয়নার মতো, যাতে সমকাল আর জীবন প্রতিফলিত হচ্ছে। যদি তা কুৎসিত দর্শন হয়, তবে বুঝতে হবে সময়টাই কুৎসিত।”

রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল— সবাই একযোগে সাদাত হাসান মান্টোকে খারিজ করে দিলেও তিনি গল্পকার হিসেবে নিজের অবস্থান জানতেন। ১৯৫০ সালে মান্টো স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপে লেখেন, “এক দিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।” পাকিস্তানের জন্মের ৬৫ বছর উপলক্ষ্যে পাক সরকার ঠিক সেটাই করেছে। সেই সাদাত হাসান মান্টোকে তারা ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছে, যিনি মৃত্যুর এক বছর আগে তাঁর নিজের ‘এপিটাফ’-এ লিখে গিয়েছিলেন, “এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই ছোটগল্পকার, যে ভাবছে, খোদা, নাকি সে নিজে, কে বেশি ভাল গল্পকার!” ১৯৫৫ সালের ১৮ই জানুয়ারী তাঁর মৃত্যুর পর মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে মান্টোর পরিবার তাঁর সমাধিতে এটা খোদাই করার সাহস পায়নি।

লেখা – শোভন
ডিজাইন – Ramesh

লেখাটি প্যারালাল ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া