১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, মঙ্গল পান্ডে, নানা সাহেব ও আজিমুল্লাহ খাঁন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে সিপাহী বিদ্রোহের নেতা নানা সাহেব। তিনি প্রথমে কোষাগার দখল করে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের নিয়ন্ত্রণ করেন। তারপর তিনি পুরো কানপুর থেকে বৃটিশকে তাড়াতে আরো অগ্রসর হন। এই সময় অন্য একটি বিদ্রোহী সিপাহীদের দল দিল্লিতে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল। নানা সাহেবকেও তারা দিল্লী যাওয়ার জন্য বললো। তবে, আজিমুল্লাহ খাঁন পরামর্শ দিলেন যে, সম্রাটের কাছে যাওয়ার চেয়ে আগে কানপুর দখল করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ঘটে গেল মহাবিদ্রোহ।
কিন্তু, কে এই আজিমুল্লাহ খাঁন? এবং রাশিয়ার যুদ্ধের সাথে তার সম্পর্ক কি? আজ আমরা ১৬০ বছর পর কেন আবার তাকে স্মরণ করছি, তারও ব্যাখ্যা পাবেন এই প্রবন্ধে। মূল ঘটনার আগে জেনে আসা যাক আজিমুল্লাহ খাঁনের পরিচয়। সিপাহী বিদ্রোহের ভুলে যাওয়া মহানায়ক আজিমুল্লাহ খাঁন ইউসুফজাই ১৮৩০ সালে কানপুরে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮৩৭ সালের দিকে দুর্ভিক্ষপীড়িত হয়ে তিনি কানপুরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বড় হন। পরে একটি ইংরেজ পরিবারে কাজ শুরু করে এবং সেখানে তিনি ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজী ভাষা শেখেন। তিনি বেশ কয়েকজন ইংরেজ কর্মকর্তার সাথে কাজ করার ফলে নিয়োগ পান ব্রিগেডিয়ার জন স্কটের অনুবাদক হিসেবে। ১৮৫১ সালে বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পর তিনি নানা সাহেবের দরবারে সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। তখন থেকে তিনি দেওয়ান আজিমুল্লাহ খাঁন নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
নানা সাহেব ছিলেন দ্বিতীয় বাজি রাওয়ের দত্তক নেয়া ছেলে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনিই ছিলেন মারাঠাদের পেশোয়া আর আজিমুল্লাহ ছিলেন তার নায়ক। বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পর নানা সাহেবের সাথে তখন ইংরেজদের বিরোধ চলছিল। কারণ, মারাঠা পেশোয়া বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পর ইংরেজরা তার পালক পুত্র নানা সাহেবকে ভাতা প্রদান বন্ধ করে দেয়। তাদের যুক্তি ছিল উত্তরাধিকারী হলেও নানা সাহেব পালক পুত্র। সেসময় ভারতীয় রাজাদের চরম খারাপ যাচ্ছিল এবং ইংরেজদের দয়ার উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় তাদের ছিল না। তাই নানা সাহেব আজিমুল্লাহকে কোম্পানির ‘কোর্ট অব ডিরেক্টরসদের’ সভায় ভাতার দাবি আদায়ের চেষ্টা করতে ইংল্যান্ড পাঠান। আজিমুল্লাহর এই ইংল্যান্ড যাত্রা ‘মারাঠা মিশন’ নামে পরিচিত। অগত্যা জাহাজে চড়ে ১৮৫৩ সালে তিনি ইংল্যান্ড গেলেন l সেখানে গিয়ে তিনি নানা সাহেবের সাথে ইংরেজ সরকারের নানা অন্যায়ের একটা চিত্র তুলে ধরে বৃটিশের কাছে এবং নানা সাহেবের ভাতা পূণর্বহালের জন্য আবেদন করেন। সেসময় ইংল্যান্ড শহরে এটি একটি বিরাট আলোচিত ঘটনা ছিল। জানা যায়, আজিমুল্লাহ খাঁন লন্ডনে গেলে তাকে দেখার জন্য প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল। কারণ তিনি ততদিনে অনেক বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন।
চার্লস ডিকেন্স, কার্লাইল, প্রমুখ বিখ্যাত লেখকদের সাথেও তার সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে হতাশার বিষয় যে আজিমুল্লাহ লন্ডনে যে কাজের জন্য গিয়েছিলেন, তা কিন্তু ফলপ্রসু হয়নি। বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে, এবং বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে অবশেষে ১৮৫৫ সালে তিনি ব্যর্থ ও হতাশ হয়ে লন্ডন থেকে বিদায় নেন। তবে সরাসরি ভারতে না এসে তিনি বেড়িয়ে পড়লেন ইংরেজদের ভারত থেকে কিভাবে তাড়ানো যায় তার রাস্তা খুঁজতে। ঘটনার শুরু এখান থেকেই, আজিমুল্লাহ জানতে পারলেন যে, রুশ সৈন্যদের কাছে কনস্টান্টিনোপোলে ব্রিটিশ-ফরাসি মিলিত বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে । দেরি না করে তিনি চলে গেলেন কনস্টান্টিনোপোল। তখন কনস্টান্টিনোপোল উসমানীয় সাম্যাজ্যের অধীনে। তিনি সেখানে কিছুকাল অবস্থান করে, সেখান থেকে পরে তিনি ক্রিমিয়ান যুদ্ধক্ষেত্রেও যান।
এসব যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের ব্যর্থতা নিজ চোখে দেখে তার মনে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আরো শক্ত হয়। সেই সাথে বিদ্রোহের বিষয়ে তিনি সেখানে রুশ ও তুর্কি গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং আসার সময় বুদ্ধি করে একটি ফরাসি প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে আসেন, যা ব্যবহার করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। এজন্য তাকে অনেকে সিপাহী বিদ্রোহের স্পাই বা গোয়েন্দা বা ভারতের দূত বলে থাকেন। তার বুদ্ধির প্রশংসাতো আগে থেকেই সবার কাছে ছিলই, যেকারণে নানা সাহেব তাকে প্রধানমন্ত্রীও করেছিলেন। আজিমুল্লাহ খাঁনের সহযোগিতায় নানা সাহেব কানপুর দখল ও অবরোধ করেন।
১৮৫৭ সালে পলাশী ট্রাজেডির শততম বছরে ইংরেজ শাসনের পতন ঘটবে এই বিশ্বাসে চারদিকে সিপাহীরা নতুন উদ্যমে আক্রমণ চালায় এবং কানপুরে ইংরেজের পতন ঘটে। কিন্তু সিপাহীরা সুশৃঙ্খলভাবে তা ধরে রাখতে না পারায়, আবার ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন নানা সাহেবের বাহিনী। আজিমুল্লাহ খাঁন উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন সুদর্শন, দক্ষ বিদ্রোহী নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও ইংরেজ ঐতিহাসিকগণের একটি বড় অংশ তাকে ধূরন্ধর ও বেঈমান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া পরাজিত হওয়ার কারণে আমরা আজিমুল্লাহ খাঁনদের ভুলে গেছি। তবে তাদের তো ভুলে গেলে চলবে না, কারণ পরবর্তীতে তারাই স্বাধীনতার আন্দোলনের জন্য প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন। অবশেষে, আজিমুল্লাহ খাঁনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল আমরা ঠিক জানতে পারিনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য ! সম্ভবত তিনি বিদ্রোহে নিহত হয়েছিলেন অথবা বিদ্রোহের পর তাকে কোনো বিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছিল। আজিমুল্লাহ খাঁনের মৃত্যু নিয়ে আছে ধোঁয়াসা, কারণ, কারও মতে, ১৮৫৯ সালে তিনি নেপালের তেরাই সীমান্তের কাছে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আবার কারও মতে, তিনি তুরস্কের কনস্ট্যান্টিনোপলে নিহত হন। যাইহোক, তার স্মৃতি রক্ষার্থে কানপুরে তাঁর নামে একটি সড়ক রয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তিনি হারিয়ে যাননি l আমরা তাদের হারাতে দিবো না l