পূর্ব ও পশ্চিমা সভ্যতার মধ্যে সংস্কৃতি ও বাণিজ্য বিনিময়ের এক দুর্দান্ত সংযোগ ছিলো এশিয়া ও ইউরোপ অতিক্রমকারী একটি বাণিজ্যপথ, সিল্ক রোড। এই পথের ধারে ধারে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ শহর গড়ে উঠেছিলো এবং অসংখ্য সভ্যতার এক মিলনস্থলে পরিণত হয়েছিলো এই সিল্ক রোড।
এই কিংবদন্তি প্রাচীন বাণিজ্য পথ মধ্য এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করেছে। ভ্রমণকারী এবং ব্যবসায়ীরা বর্তমান চীন, ইরান, তুরস্ক, গ্রীস এবং ইতালির মতো অঞ্চল থেকে এসেছিলো; যার সবকটিই ছিলো সিল্ক রোডের অংশ। সিল্ক রোডের শুরুটা চীনের পরবর্তী হান রাজবংশের শাসনামলে হলেও, এটি সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক হাবে পরিণত হয়েছিলো তাং রাজবংশের শাসনামলে।
ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে পণ্য ও সংস্কৃতি বিনিময়ের এক অবিরাম প্রবাহের প্রমাণ বিগত দুই দশকে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং টিকে থাকা লেখনীগুলোর মধ্যে স্পষ্ট। চীনে গিয়েছিলো রথ, উল, কাঁচ ও ওয়াইন; আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভ্রমণ করেছিলো চীনামাটির বাসন, সিল্ক, কাগজ ও বারুদ। এমনকি চীনের চ্যাংআনের রাজদরবারও উটপাখি এবং গন্ডারকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলো। বৈচিত্র্যময় বিদেশী ভূমি ও মানুষের এমন সংযোগ সিল্ক রোডকে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রে পরিণত করেছিলো। আর এর সবচেয়ে স্পষ্ট ছাপ পড়েছিলো বাণিজ্যপথটির ধারে ধারে গড়ে ওঠা শহরগুলোতে।
সিল্ক রোড-সংলগ্ন এমনই দশটি বৃহত্তম শহর নিয়েই আজকের দীর্ঘ আলোচনা:
১. চ্যাংআন (বর্তমান জিয়ান)
পূর্বে সিল্ক রোডের শুরুটাই হয়েছিলো চীনের প্রাচীন চ্যাংআন শহরের মাধ্যমে, যা আজকের শানজি প্রদেশে অবস্থিত জিয়ান নামেই পরিচিত। দশ লক্ষেরও বেশি অধিবাসী নিয়ে গড়ে ওঠা চ্যাংআন শহরটি তখন পরিণত হয়েছিলো বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরে। সিল্ক রোড হয়ে আসা বিদেশীদের জন্য শহরটি একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছিলো, কারণ চ্যাংআনই ছিলো প্রাচীন চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
তাং শাসনামলে চ্যাংআন শহরে দুটি প্রধান বাজার ছিলো- একটি পূর্বে, অপরটি পশ্চিমে। পূর্বের বাজারটি ছিলো মূলত রাজবংশীয় ও অভিজাত পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য; আর পশ্চিমের বাজারটি ছিলো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। পশ্চিমের এই বাজারটিই বিদেশী পণ্যের বাণিজ্যের জন্য ছিলো বিখ্যাত। সারা বিশ্বের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা গহনা, সিল্ক, চা, ভেষজ ও বিরল সব ওষুধগুলো পশ্চিমের বাজারটিকে একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করেছিলো। সিল্ক রোডের পথ ধরে শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলোও চ্যাংআনে পৌঁছেছিলো। ফলে চ্যাংআনবাসীদের খাবার ও ফ্যাশন থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতে এই প্রভাব স্থায়ী হয়েছিলো।
২. দুনহুয়াং
এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে দুনহুয়াং সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক কেন্দ্র ছিলো। দুনহুয়াং চীনের হেক্সি করিডোরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত; যেখানে গানসু, কিংহাই এবং জিনজিয়াং –এই তিনটি প্রদেশ মিলিত হয়েছে। এটি গোবি মরুভূমি দ্বারা বেষ্টিত একটি ছোট মরূদ্যান। পূর্বে চীনের মধ্য সমভূমিকে পশ্চিমে জিনজিয়াং এবং মধ্য এশিয়ার সাথে সংযুক্ত করে দুনহুয়াং একটি কৌশলগত অবস্থান দখল করেছে।
হান সম্রাট য়ু এর রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে জিওংনু সেনাবাহিনী হান সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। কেন্দ্রীয় সমভূমি অঞ্চল থেকে পশ্চিমের পথ পর্যন্ত দুনহুয়াং হান সাম্রাজ্যের সামরিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবহন কার্যক্রমের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। ধীর ভ্রমণ, যোগাযোগের অসুবিধা ও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে, দুনহুয়াং মানুষ ও প্রাণীদের একটি আশ্রয়স্থল এবং দীর্ঘ ভ্রমণের সময় পণ্য বিনিময়ের জন্য একটি ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়।
পূর্ব অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রথম বার দুনহুয়াং-এ প্রবর্তিত হয়েছিলো। জিন রাজবংশের শাসনামলে ঝু ফাহু ও তার শিষ্যরা দুনহুয়াং-এ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ এবং বৌদ্ধ মতবাদ প্রচার করেছিলেন। দুনহুয়াং এর দুর্দান্ত মোগাও গুহাগুলোর মধ্যে প্রথমটি খনন করেন দুনহুয়াং-এ আসা একজন সন্ন্যাসী, যার নাম ছিলো লেজুন। ‘ডায়মন্ড সূত্র’ নামে পরিচিত তাং-বংশীয় প্রাচীনতম বৌদ্ধ পান্ডুলিপিটি ১৯০৭ সালে দুনহুয়াং-এ পাওয়া গিয়েছিলো।
৩. কাশগর
চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাশগর বহু শতাব্দী ধরেই সিল্ক রোডের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। ভৌগোলিকভাবে, কাশগর হলো চীনের সুদূর পশ্চিমে অবস্থিত এক বন্য অঞ্চল; তবে কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে ছিলো না। শহরটি পশ্চিমের সমরকন্দ বা ভয়ঙ্কর তাকলামাকান মরুভূমি পেরিয়ে পূর্ব দিকে কাফেলাগুলির সমাবেশের স্থান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো এবং এভাবেই এটি মধ্য এশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি ইন্টারফেইস হিসেবে সমৃদ্ধ হয়েছিলো।
হান সম্রাট য়ু বিশ্বাস করতেন, এখানকার মানুষের বিশেষ ঘোড়া ছিলো, যারা স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিলো এবং যারা ঘামলে পানির বদলে রক্ত বের হতো। তিনি তার নিজের সেনাবাহিনীর জন্য এই ঘোড়াগুলো অর্জন করতে চেয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যেই কাশগরে একজন দূত পাঠান। এই মিশনটি মরুভূমি পেরিয়ে পশ্চিমের দিকে চীনের জন্য পথ খুলে দেয়। তারপর থেকে চীনারা কাশগর মরূদ্যান ও এর জনগণের উপর নিজেদের শাসন দাবি করে। তবে তাদের কখনোই এই অঞ্চলের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিলো না এবং বহু বাধা-বিপত্তির কারণে ৫০০ বছরেরও কম সময় কাশগরের ওপর তাদের শাসন কায়েম ছিলো। প্রাচীন মরূদ্যান নগরীটিতে সংখ্যালঘু উইঘুর জনগোষ্ঠী এখনও জনসংখ্যার এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।
গত শতাব্দীতে তিনটি প্রধান সাম্রাজ্য -ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও চীনের বিবাদের কারণে কাশগর এক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। মধ্য এশিয়া ও এর সম্পদের উপর শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারা যে যুদ্ধখেলায় মেতে উঠেছিলো, তাকে ‘গ্রেট গেইম’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। সারা বিশ্বের কূটনীতিবিদ ও গুপ্তচর, অফিসার ও প্রত্নতত্ত্ববিদ, অনুসন্ধানকারী ও দুঃসাহসিকদের একটি মিলনভূমিতে পরিণত হয়েছিলো এই কাশগর।
৪. সমরকন্দ
তাং রাজবংশের শাসনামলে চীনের সম্পদের প্রধান উৎস ছিলো বিলাস দ্রব্যের আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য, যা মূলত সগডিয়ানদের সংগঠন ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে সগডিয়ানদের একটি উন্নত সভ্যতা বিদ্যমান ছিলো। আর তাদের বড় দুর্গবিশিষ্ট শহরটিই ছিলো সমরকন্দ। গ্রীকদের কাছে এটি মারাকান্দা নামে পরিচিত ছিলো। আলাই পর্বতমালার পশ্চিম প্রান্তের মালভূমিতে অবস্থিত এই সমরকন্দ সিল্ক রোডের কেন্দ্রস্থলের একটি শহর। আর তার অবস্থানের কারণে সমরকন্দ প্রচুর উপকৃত হয়েছিলো। প্রায় ২৭৫০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই শহরটিকে তার দীর্ঘ ইতিহাসে বেশ কয়েক জন বিখ্যাত ও শক্তিশালী শাসক জয় করেছিলেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, চেঙ্গিস খান, তৈমুর প্রভৃতি।
ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত এশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যের সাম্রাজ্যকে শাসন করেছেন সগডিয়ানরা। এশিয়ার সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশগুলোতে তাদের সাফল্যের পূর্বশর্ত ছিলো ব্যাপক ভাষা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়গুলোর প্রতিও উন্মুক্ত মনোভাব। যদিও অনেক সগডিয়ানরাই জরথুষ্ট্রবাদকে অনুসরণ করেছিলো, তবুও অন্যান্য ধর্মের প্রতি উন্মুক্ত ছিলো তাদের নীতি। তাদের সাফল্যের আরেকটি স্তম্ভ ছিলো, তাদের ব্যবসাকে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে নমনীয়তা প্রদর্শন।
৫. বালখ
বালখের প্রাচীন শহরটি “শহরের জননী” নামে পরিচিত ছিলো। ১২২০ এর দশকে চেঙ্গিস খানের সেনাবাহিনী হাতে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় শহরটি। বালখ নদীর তীরে প্রাদেশিক রাজধানী মাজার-ই-শরীফ থেকে ২২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত নগরী বালখ।
আফগানিস্তান এক সময় এশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ছিলো। সিল্ক রোড তার সমগ্র অঞ্চলের অগণিত যাযাবর, যোদ্ধা, বসতি স্থাপনকারী, অভিযাত্রী এবং ধর্মপ্রচারকদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেছিলো; যাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ পদচিহ্ন রেখে গেছেন।
এখানেই আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সুন্দরী রাজকুমারী রোকসানাকে বিয়ে করার আগে বালখের রাজাকে হত্যা করার জন্য একটি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে পারস্যে আরব আক্রমণের আগে চীনা পরিব্রাজক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিউয়েন সাং আবিষ্কার করেছিলেন যে, অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীই বাল্খে বাস করতেন।
৩৫০০ বছর আগে প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রবর্তক ও দার্শনিক জোরোস্টার এই বালখেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং খুব সম্ভবত এখানেই তার মৃত্যুও হয়েছিলো। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মহান পারস্য কবি রুমির জন্মস্থানও ছিলো বালখ। অনেক আফগানরা বিশ্বাস করেন, রুমিকে তার মৃত্যুর পর এখানেই সমাহিত করা হয়েছিলো।
৬. মার্ভ
মার্ভের প্রাচীন শহরটি তুর্কমেনিস্তানের কারাকুম মরুভূমির একটি শহর মেরির পূর্ব উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি তুর্কমেনিস্তান ও মধ্য এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান, যা প্রাচীন সিল্ক রোডের সমৃদ্ধি ও গৌরবকে প্রত্যক্ষ করেছে।
প্রাচীন মার্ভ শহরের প্রথম রেকর্ডটি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো সময়ের প্রাচীন এক ফারসি বইতে পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে বিকাশের উচ্চতায় আসীন মার্ভ দামেস্ক, বাগদাদ ও কায়রোর সাথে একটি প্রধান ইসলামিক কেন্দ্র হিসেবে মিলিত হয়েছিলো এবং এই বিষয়টি এই অঞ্চলের ইসলামী সভ্যতার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলো।
মধ্য এশিয়া ও পারস্যকে সংযুক্ত করার একটি কেন্দ্র ছিলো মার্ভ। মার্ভের প্রাচীন শহরটি এমন একটি মঞ্চ ছিলো, যেখানে ইতিহাসের বেশ কয়েকটি সাম্রাজ্যের সংঘর্ষ হয়েছিলো। শহরটি ক্রমাগত প্রসারিত হয়েছে এবং স্থাপত্যশৈলী ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের এক দুর্দান্ত বৈচিত্র্য প্রদর্শন করেছে। প্রাচীন শহরটির সর্বোচ্চ স্থান হলো, এর প্রাচীনতম টিকে থাকা কাঠামো ‘এল কেকারা’। এটি মূলত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্যের আকেমেনিড রাজবংশের নির্মিত একটি দুর্গ। পার্থিয়ান, সাসানিদ এবং সেলজুক তুর্কি -এরা সবাই নিজেদের পদচিহ্ন রেখে গেছে মার্ভে। শহরটিতে বৌদ্ধ, জোরোস্ট্রিয়ান ও খ্রিস্টান –সব ধর্মেরই উপাসনালয় পাওয়া গিয়েছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মার্ভের প্রাচীন শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। ১২১৮ সালে মঙ্গোলিয়ানরা এসেছিলো এখানে এবং চেঙ্গিস খানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জোর খাটিয়েছিলো তারা মার্ভে। কিন্তু মঙ্গোলিয়ানদের পাঠানো দূতকে হত্যা করা হয়েছিলো। এর ফলশ্রুতিতে ১২২১ সালে চেঙ্গিস খানের ছেলে টোলুই এর নেতৃত্বে মার্ভে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মার্ভের কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো সেই যুদ্ধে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সমৃদ্ধ মার্ভ ছাই-এ পরিণত হয়েছিলো।
৭. টেসিফোন
টেসিফোন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একটি মহান শহর, পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী এবং এর উত্তরসূরি হলো সাসানিদ রাজবংশ। এটি ইরাকের রাজধানী বাগদাদের দক্ষিণ-পূর্বে টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত। এই স্থানটি মূলত সেলিউসিড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পার্থিয়ান শাসক প্রথম মিথ্রিডেটিসের মোতায়েনকৃত সৈন্যবাহিনীর অধীনে ছিলো, পরে রোমানরা একে দখল করে নেয় এবং শেষ পর্যন্ত সাসানিদ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে। দ্বিতীয় ইসলামি খলিফা ওমর যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তিনি ইরাক জয়ের জন্য সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। ৬৩৭ সালে আরবীয় সেনাবাহিনী সাসানিদ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এবং শহরটি দখল করে। পূর্ব দিকে সম্পূর্ণ পারস্য জয়ের জন্য তারা এটিকে একটি ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে।
শত শত বছরের দখলের পর, টেসিফোন সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সে সময়ে লোকেরা শহরটিকে পৃথিবীর স্বর্গ হিসেবে মানতো। কিন্তু আজ টেসিফোনের ধ্বংসাবশেষে যা অবশিষ্ট আছে, তা হলো, অনেক উঁচু মাটির ইটের দেয়াল ও প্রাসাদ। এর মধ্যে সাসানিদ রাজা প্রথম খসরুর বিশাল দরজাবিশিষ্ট প্রাসাদটি সবচেয়ে বিখ্যাত, যা ‘তাক কাসরা’ নামে পরিচিত। প্রাসাদের প্রধান হলের মধ্যে একটি ১০০ ফুট উঁচু অপ্রস্তুত ইটের দরজা রয়েছে, যেটি বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা এক পাল্লার ইটের দরজা।
৮. পালমিরা
মধ্য সিরিয়ার প্রাচীন শহর পালমিরা সিল্ক রোডের একটি বিখ্যাত শহর। পালমিরা সিরিয়ার মরুভূমির প্রান্তে দামেস্কের উত্তর-পূর্বে ভূমধ্যসাগর ও ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। প্রথম শতাব্দী থেকেই এটি পারস্য উপসাগর ও এশিয়াকে যথাক্রমে ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপের সাথে সংযোগকারী একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ছিলো। বণিকরা কাচের পণ্য, রং ও মুক্তার বিনিময়ে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে চীনা সিল্ক, মৃৎপাত্র ও ভেষজ নিয়ে আসতো।
পালমিরাকে প্রায়শই সিরিয়ার ‘মরুভূমির মুক্তা’ বলা হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই শহরটির ৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কলাম, টাওয়ার, আত্মরক্ষামূলক বেষ্টনী, সমাধি, মন্দির এবং অন্যান্য কাঠামো জুড়ে রয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের সময় পালমিরার দ্রুত উত্থান হয়েছিলো এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিলো। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের বৃহত্তম ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরে পরিণত হয়েছিলো পালমিরা। ১৯৫৭ সালে সিরিয়ার মরুভূমিতে একটি তেল পাইপলাইন প্রকল্পের সময় নির্মাণ শ্রমিকরা সাইটে একটি ক্যাটাকম্ব বা ভূগর্ভস্থ সমাধি আবিষ্কার করেছিলেন। এটি ছিলো প্রাচীন সিরিয়ার সবচেয়ে উন্নত-চরিত্র এবং সুন্দর প্রাচ্য রাণী জেনোবিয়ার সমাধি, যিনি রোমান শাসনের বেড়িবাঁধ ভেঙে পালমিরিন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২৭৩ সালে রোমানরা পালমিরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো।
৯. দামাস্কাস বা দামেস্ক
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক একটি সুন্দর ও মার্জিত শহর, যার ইতিহাস ৪৫০০ বছরেরও পুরনো। এটি কাসিউন পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। বারাদা নদীর সাতটি উপনদী শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং পশ্চিম এশিয়ার এই বিখ্যাত শহরটিতে প্রাণশক্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। ঐতিহাসিক নথি অনুসারে, ১১৫ সালের প্রথম দিকে দামেস্কে চীনা সিল্কের প্রচলন হয়েছিলো। চীনা সিল্ক ও সিরামিক পেট্রা (বর্তমান জর্ডান) হয়ে ফিনিশিয়ান রাজ্যে (ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে বর্তমানের সিরিয়া ও লেবানন) পরিবহন করা হতো। রোমানদের চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য সিল্ক প্রক্রিয়াজাত ও রঙিন করা হতো। তারপর এটি বিক্রির জন্য রোম এবং দামেস্কের বাজারে পরিবহন করা হতো।
দামেস্কে এখনও বেশ কিছু প্রাচীন ক্যারাভানসরাই এর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। কাঠ এবং পাথরের তৈরী এই স্মারক কাঠামোগুলোর বেশিরভাগই শহরের পুরনো অংশের সোক (বাজার এলাকা) এর কাছাকাছি পাওয়া যায়। এগুলো খোলা ও কেন্দ্রীয় উঠানসহ উপর ও নিচ তলায় বিভক্ত ছিলো। নিচ তলায় উট এবং ঘোড়া বাঁধা থাকতো। আর উপর তলার ঘরে রেশম ব্যবসায়ীরা থাকতেন। কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গনটি রেশম ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত হতো। এই ধরনের ক্যারাভানসরাইগুলো মূলত সিল্ক রোড বরাবর অবস্থিত ছিলো, যা ছিলো মূলত ভ্রমণকারীদের বিশ্রামের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য জায়গা।
১০. কন্সট্যান্টিনোপোল
ইস্তানবুল ছিলো রোমান সাম্রাজ্য, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, অটোমান সাম্রাজ্য এবং তুর্কি প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। এটি দীর্ঘকাল ধরেই ছিলো নিকট প্রাচ্যের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র। এই ইস্তানবুলই অতীতে কন্সট্যান্টিনোপোল নামে পরিচিত ছিলো। শহরটি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর মতাদর্শ, সংস্কৃতি ও শিল্পের সূক্ষ্মতাকে একত্রিত করে পূর্ব এবং পাশ্চাত্য মতাদর্শ ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হয়ে গড়ে উঠেছিলো।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে গ্রীকরা প্রথম শহরটি তৈরী করেছিলো। পরে এটি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠে। ৩৩০ সালে এর নাম রাখা হয় কন্সট্যান্টিনোপোল এবং ১৪৫৩ সালে অটোমান তুর্কিরা শহরটি অধিগ্রহণ করার পর একে ইস্তানবুল বলা হয়। এর পর ইস্তানবুল তুর্কি সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠে। ১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু ইস্তানবুল এখনও তুরস্কের বৃহত্তম শহর।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কন্সট্যান্টিনোপোল ছিলো একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং কৃষ্ণসাগরের দেশগুলো থেকে বাণিজ্য জাহাজের একমাত্র পথ। শহরটি এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে নির্মিত হয়েছিলো এবং সিল্ক রোডের এশিয়ান অংশের শেষ শহর হিসেবে পরিগণিত করা হয় একে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চীন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামে পরিচিত একটি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাচীন কালের সিল্ক রোডকে আবারো সক্রিয় করেছে। এটি একটি বিশাল উদ্যোগ। চীনকে অন্যান্য দেশের সাথে আরও ভালোভাবে যুক্ত করার জন্য দুটি বাণিজ্য পথ তৈরী করা হচ্ছে, একটি স্থলপথে এবং অপরটি সমুদ্রপথে। রুটগুলো এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার ৬০টিরও বেশি দেশের মধ্য দিয়ে যায়। আধুনিক সময়ে সিল্ক রোড ধরে বড় পরিবর্তনের সম্মুখীন হওয়া শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে নিউ লানঝৌ (চীন), য়ুউই (চীন), খোরগাস (চীন), আকতাউ (কাজাখস্তান), গোয়াদার (পাকিস্তান), আনাক্লিয়া (জর্জিয়া), ইস্তানবুল (তুরস্ক), ডুইসবার্গ (জার্মানি) এবং রোটারডাম (নেদারল্যান্ডস)।
রেফারেন্স: