মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবথেকে ভয়ংকর ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে। এত ব্যাপক, সর্বগ্রাসী ধংসযজ্ঞ মানবজাতি আর কখনও প্রত্যক্ষ করে নি। একে অপরকে নিঃশেষ করার অভিপ্রায়ে তৎকালীন বিশ্বশক্তিগুলো যেনো সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। টানা ছয় বছর (১৯৩৯-১৯৪৫) পর্যন্ত ধরে পুরো বিশ্ববাসী অবলোকন করেছে এই মহাযুদ্ধের নির্মমতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সবথেকে বড় কুশীলব ছিলেন জার্মানির এক নায়ক এডলফ হিটলার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সামান্য একজন কর্পোরাল থেকে তাঁর ক্ষমতার পাদপ্রদীপে আসাটাই যেনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিযজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলো। কিন্তু মিউনিখের রাজপথের উদীয়মান নাটুকে নেতা থেকে সমস্ত জার্মান জাতীর ফ্যুয়েরার হয়ে ওঠা পর্যন্ত তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে দুস্তর- দুর্গম পথ। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও কূটকৌশলের পর ক্ষমতা এসে ধরা দেয় হিটলারের কাছে।হের হিটলারের ক্ষমতারোহণের পেছনের গল্প নিয়েই আমাদের আজকের অবতারণা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হিটলার
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাক্রমশালী জার্মানির মিত্রপক্ষের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের মাধ্যমে নিস্তব্ধ হয়ে যায় ওয়েস্টার্ন এবং ইস্টার্ন ফ্রন্টের যুদ্ধ। পুরো জার্মানিতে পট পরিবর্তনের ধাক্কা লাগে।রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।একাধিক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটলো। কমিউনিস্ট শক্তিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কোন্দলে জার্মানির রাজনৈতিক অঙ্গন মুখরিত। কিন্তু খেটে খাওয়া গরিব মানুষদের জন্যে কারোর চিন্তা নেই। আরো আছে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা লাখ লাখ আহত সৈনিক, যুদ্ধবাজ জেনারেল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসার থেকে ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ। তারা ব্যাথিত, আহত বাঘের মত যেনো ফুসছে পুরো জার্মান জাতি। এজন্য সেইসময়ের পরিস্থিতিও আমাদের অনুভব করা প্রয়োজন। যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানিতে মুদ্রাস্ফীতি তখন চরমে। সামান্য খাবার কিনতেও লক্ষ রাইখমার্ক লাগে। কাজ নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে আছে। এর উপর, দিশেহারা জার্মানিকে একের পর এক কঠিন শর্ত চাপিয়ে বাধ্য করা হয় অবমাননাকর ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরে। সে সময়ে বিজয়ী মিত্র শক্তির কর্তাব্যাক্তিরা চেয়েছিলেন জার্মানি যেনো আর কখনোই ইউরোপের জন্যে হুমকি হয়ে উঠতে না পারে, জার্মানরা যেনো আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এটাই তারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। সে সময়ের জার্মান নীতিনির্ধারকেরা মিত্রপক্ষের সকল দাবী মেনে নিতে বাধ্যও হন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কর্পোরাল হিটলার
পুরো যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে দিতে দেউলিয়া হওয়ার দশা জার্মানির। অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। অরাজকতা, খুন- জখম, লুটপাটে জর্জরিত সাধারণ জার্মান নাগরিকেরা।এরই মধ্যে চলতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিটিং-মিছিল।নব্য নেতারা নিজেদের আদর্শের মেকি বুলি কপচাতেন জনসাধারণের উদ্দেশ্যে। এরকম পরিবেশে যুদ্ধফেরত সৈনিক হিসেবে মিউনিখে আসেন হের হিটলার। সেসময়ে শুধু সৈনিকেরাই জনসাধারণের শ্রদ্ধা পেত। কারন সাধারন মানুষ ভাবত রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দের জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই জার্মানদের আজকের এই বেহাল দশা। আর সৈনিকেরা বীরের মতই যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করেছে। তাই হিটলার মিউনিখে সৈন্যদের মধ্যে বেশ ভালোই ছিলেন। এরকম সময়ে তিনি মিউনিখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উপর নজরদারি করার সরকারি দায়িত্ব পান। তিনি তখনকার রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকান্ড খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। এদের মধ্যে ন্যাশনাল জার্মান ওয়ার্কাস পার্টি নামক নব্যগঠিত একটি দল তাকে আগ্রহী করে তোলে। এন্টন ডেক্সলার নামের মিউনিকের একজন শ্রমিক নেতা ছিলেন এই দলের প্রতিষ্ঠাতা। শ্রমিক শ্রেণী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যারা কিছুটা জাতীয়তাবাদে সচেতন এমন মানুষদেরকে একত্র করাটাই এই পার্টির উদ্দেশ্য ছিলো। কার্ল হেরার নামের একজন সাংবাদিক ছিলেন পার্টির চেয়ারম্যান। বিভিন্ন কফিশপ, বিয়ার হাউসে রাজ রাজনৈতিক সভা আয়োজন করে আলাপ-আলোচনা করাই তাদের কাজ ছিলো। এমনই এক সভায় এ হের হিটলার একজন সভ্য হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন পার্টির সাত নম্বর কার্যকরি সদস্য। হিটলার নিজেও এমন একটি দলের সন্ধানে ছিলেন, যেখানে তিনি তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাশাকে পূর্ণতা দিতে পারবেন।

এন্টন ড্রেক্সলার
দলে যোগ দেয়ার পরপরই তিনি দলকে সাংগঠনিকভাবে মজবুত করতে মনোনিবেশ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে দলের অন্যান্য সদস্যদের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। প্রায়শই জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। স্থানীয় পত্রিকাতে নিয়মিত সংবাদ পাঠাতে থাকেন। তার মিটিং- রাজনৈতিক কর্মসূচীতেও মানুষজন বাড়তে থাকলো। ১৯২০ সালের দিকে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “ন্যাশনাল সোশালিস্ট জার্মান ওয়ার্কাস পার্টি” বা নাৎসী পার্টি। অবসরপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত সৈনিক, মধ্যবিত্ত কর্মহীন মানুষজনের মধ্যেই এই পার্টি জনপ্রিয়তা লাভ করে। আরোও কয়েক বছরের মধ্যে হিটলার দলের প্রধান ব্যাক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। এর মাঝে তাঁর পরিচয় আর্নেস্ট রোহম এর সাথে। রোহম ছিলেন একজন পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। হিটলারের সাথে তাঁর আদর্শগত মিল ছিলো, তাছাড়া দুজনেই ছিলেন মারাত্মক রকমের কমিউনিস্টবিরোধী। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে রোহমের ছিলো দারুন প্রভাব।নাৎসী পার্টির প্রচার প্রচারণা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে চালু করেন রোহম তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে। অভিজাত মহলেও হিটলারকে পরিচিত করান রোহম। পার্টির তহবিলে মোটা অংকের চাঁদার ব্যবস্থা করেন রোহম। দলের মুখপাত্র হিসেবে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা চালু হয়, ইংরেজিতে যার নাম দাঁড়ায় “Facist Observer”। এভাবে মিউনিখের রাজনীতিতে কেউকেটা হয়ে ওঠেন হিটলার। আর এসময় তাঁর পাশে সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন রোহম। দলের মধ্যে যারা যুদ্ধফেরত ও অবসরপ্রাপ্ত প্রশিক্ষিত সৈনিক ছিলেন, তাদের নিয়ে হিটলার তাঁর বিখ্যাত Strong Arm (SA) গঠন করেন। এ দলটি মূলত হিটলার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অপরাপর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিশেষত কমিউনিস্টদের শায়েস্তা ও তাদের মিটিং মিছিল পন্ড করার জন্যে।যদিও এরা ছিলো সেচ্ছাসেবী। মাথাগরম, রগচটা,ডানপিটে কর্মীদেরকে তিনি এ কাজেই লাগাতেন।রোহমের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সুসংঘটিত দল হিসেবে গড়ে ওঠে SA। মিউনিখে প্রাধান্য লাভ করার পর জার্মানির অন্যান্য শহরেও মিটিং-শোভাযাত্রার আয়োজন করেন হিটলার। SA কর্মীদের সুসজ্জিত মার্চ জনগণকে মুগ্ধ করতো। তারা অনেকক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর থেকেও সুশৃঙ্খল ছিলো।

völkischer beobachter “Facist Observer”
হিটলারের খাস সহকর্মীদের মধ্যে রোহমের পাশাপাশি গোয়েরিং, হেস, গোয়েবলস, হিমলারও আছেন, যাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই ইতিহাসে নিজ নিজ কর্মের দরুন কুখ্যাত হয়ে আছেন। ইতোমধ্যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম জনপ্রিয় জার্মান সেনাধ্যক্ষ লুডেনডর্ফের সাহচর্য হিটলারের জনপ্রিয়তা আরোও বাড়িয়ে দেয়। বক্তৃতায় ইহুদি ও কমিউনিস্টদের প্রতি ঘৃণা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ ব্যাপকহারে ছড়াতে থাকেন হিটলার। আর তাঁর SA বাহিনীর গুন্ডামিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সভা-মিছিল পন্ড হতে থাকে। SA দের তান্ডবে প্রতিপক্ষ দলগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনও ব্যবস্থা নিতে সাহস করতো না। এভাবে মিউনিখে সবচাইতে বড় ও ক্ষমতাধর দল হয়ে ওথে হিটলারের নাৎসী পার্টি। কিন্তু এত কিছুর পরও হিটলার তখনও ব্যাভেরিয়া প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। এই ব্যাভেরিয়া প্রদেশেরই রাজধানী মিউনিখ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন অখন্ড জার্মানির ভাগ্যবিধাতা হওয়ার। আর সেজন্যে প্রয়োজনে জাতীয় বিপ্লব করার রোমান্টিক স্বপ্ন তাঁর।

নাৎসী পার্টির প্রতীক
তিনি ভাবলেন মিউনিখ থেকেই শুরু হবে তাঁর বিজয়যাত্রা। তার আগে কব্জা করতে হবে মিউনিখ। সেইসময় মিউনিখের সবচাইতে প্রভাবশালী ছিলেন ব্যাভেরিয়ার শাসনকর্তা গুস্তাভ কার, ব্যাভেরিয়ান সেন্যদলের প্রধান ভন লসো এবং পুলিশপ্রধান রিটার ভন সিসার। এদেরকে কব্জা করতে পারলে মিউনিখ নাৎসীদের হয়ে যাবে। কেন্দ্রের শাসনে তখনকার রিপাবলিকান সরকার। নানা ইস্যুতে তখন কেন্দ্রের সাথে মিউনিখের টানা-পোড়েন চলছিলো। হিটলার গোপনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কার, ভন লসোর সাথে। তাঁরা ছিলেন রাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। তারা ও সম্মত হলেন নাৎসীদের সাথে হাত মেলাতে। এবারে কেন্দ্রের টনক নড়ল। এরইমধ্যে কমিউনিস্টদের এক ব্যার্থ বিপ্লবচেস্টা কঠোরভাবে দমন করে কেন্দ্র সরকার। এই হুজুগে বিরোধীদের উপর ব্যাপক ধরপাকড় চালায় সরকার। মিউনিখে নাৎসীদের গোলযোগ ঠেকানোর জন্যে ব্যবস্থা নেয় সরকার।এক বিরাট সেনাদল পাঠানো হয় মিউনিখের গোলযোগ দূর করতে।এরফলে কার ও ভন লসো আবার পল্টি খেয়ে কেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ফেলেন।এমন পরিস্থিতিতে হিটলার এক ভয়ংকর জুয়া খেলেন। তিনি পরিকল্পনা করেন যে, ৮ নভেম্বর তিনি তাঁর সশস্ত্র SA সদস্যদেরকে নিয়ে জাতীয় বিপ্লবের সূচনা করবেন। এদিন অস্ত্রের মুখে মিউনিখের আঞ্চলিক সরকারকে বন্দী করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। সেদিন মিউনিখ সরকারের এক সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো।কয়েকজন সশস্ত্র SA সদস্যদের নিয়ে সেই সভার মধ্যে ধুকে পড়েন হিটলার। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আরোও অনেক SA দল অবস্থান নেয়। হিটলার সেখানে ঘোষনা দেন যে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে এবং এ বিপ্লবে সর্বজনশ্রদ্ধেয় লুডেন্ডর্ফের সম্মতি আছে। এদিকে ব্যাভেরিয়ান পুলিশ ও সেনাবাহিনী SA সদস্যদের ঘিরে ফেলে।কোথাও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে প্রাণ হারায় বেশ কিছু SA সদস্য।পরবর্তিতে রুদ্ধশ্বাস নাটকিয়তার পর নাৎসীদের এই বিপ্লব নস্যাৎ হয়ে যায়।গ্রেফতার হন হিটলার।শুরু হয় অভিযুক্ত হিটলারসহ নাৎসী নেতাদের বিচার। হিটলার বিচার চলাকালীন শুনানিতে দিলেন দুর্দান্ত জ্বালাময়ী এক ভাষণ।তাঁর এই ভাষণে বিচারকেরাই প্রভাবিত হয়ে পড়েন তবুও হিটলারের বিচারে পাঁচ বছরের জেল হলো।যদিও তিনি মোট নয় মাস জেল খাটার পর মুক্তি লাভ করেন।

বাম থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের, জার্মান নেতা হিটলার এবং ইতালিয়ান নেতা মুসোলিনি মিউনিখ চুক্তিতে সম্মত হন;
আপাত দৃষ্টিতে নাৎসীদের অভ্যুত্থান ব্যার্থ হলেও হিটলার হাল ছেড়ে দিলেন না। তাঁর বুকে তখনও জ্বলছে আগুন। ইতালির মুসোলিনীর মত বার্লিনের মসনদ দখল করার স্বপ্নে তিনি বিভোর। আহত বাঘের মত জেলের মধ্যে ছটফট করতে থাকেন হিটলার। ক্ষমতা তাঁর চাই, সে যে কোনো মূল্যেই হোক। জেলে থাকতেই হিটলার তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী রুডলফ হেসের সাহায্যে রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “মাইন ক্যাম্ফ”(Mein Kampf)। বিভিন্ন ভাষায় বইটি আজও বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়। হিটলারের চিন্তা-ধারা ও রাজ রাজনৈতিক দর্শন ভালোভাবে বোঝা যায় এই বইটি থেকে।
হিটলারের অনুপস্থিতিতে দলের নের্তৃত্বে এগিয়ে আসেন । এদিকে সেইসময়ে, ১৯২৪ সালে জার্মান সাধারণ নির্বাচনে দলের কর্মপন্থা নিয়ে শীর্ষস্থানীয় নাৎসী নেতাদের মধ্যে অন্তঃকোন্দ্বল শুরু হয়ে যায়। স্ট্রেসার, লুডেনডর্ফ এর মত প্রভাবশালী নেতারা চেয়েছিলেন সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জোট করে নির্বাচনে অংশ নিতে। কিন্তু হিটলারপন্থী নেতারা চেয়েছিলেন হিটলার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সিদ্ধান্তে যেতে। এই বিবাদের ফল হলো মারাত্মক।১৯২৪ সালের নির্বাচন নাৎসী পার্টির জন্য হলো হতাশাজনক। এরকম পরিস্থিতিতে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন হিটলার। মুক্তি পেয়েই নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন হিটলার। দলকে সুগঠিত ও জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি দেন। নাৎসী দলের সভা-মিছিল গরম করে তোলেন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ইহুদীদ্বেষে পরিপূর্ণ বক্তৃতা দ্বারা। এদিকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বীতশ্রদ্ধ রোম তাঁর নিজ হাতে গড়া SA দলকে প্রাধান্য দেয়ার অনুরোধ করেন হিটলারের প্রতি। কিন্তু SA সদস্যদের গুন্ডামী, রাহাজানী সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলেন হিটলার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি শুনতে শুনতে তিনি বিরক্ত ছিলেন। SA দের রাশ ধরতে ও অনেকটা রোহমকে দলে একপেশে করার জন্যে হিটলার SA দের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নেন। এতে ক্ষুব্ধ রোহম পদত্যাগ করেন দল থেকে। সেইসময়ে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় পঙ্গু জার্মানিকে বিপুল পরিমাণ ডলার ঋণ দিতে এগিয়ে আসে আমেরিকা। কিন্তু বিনা স্বার্থে ঋণ দেয়ার বান্দা আমেরিকানরা নয়। বরঞ্চ তারা জার্মানিকে এই অর্থ গত মহাযুদ্ধের মিত্র শক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যে দিতো।এতে জার্মানির লাভ হচ্ছিলো না খুব একটা। বরং জার্মানি দীর্ঘমেয়াদী ঋণের জালে আটকা পড়ছিলো।হিটলারের নাৎসী পার্টি তৎকালীন জার্মান সরকারের এমন নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করে। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত জার্মানদের কাছে নাৎসীদের ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গের কাছ থেকে ক্ষমতা নিচ্ছেন চ্যান্সেলর হিটলার, ১৯৩৩
এরই মধ্যে জার্মানির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মারা যাওয়ার পর নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আবশ্যক হয়ে পড়ল। নাৎসী পার্টির লুডেনডর্ফ ও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেন। কিন্তু হিটলার এইবার সুযোগ বুঝে তাঁকে ছুড়ে ফেলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জার্মান জাতীয় বীর ভন হিন্ডেনবার্গকে সমর্থন করে এবং পরবর্তীতে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই বৃদ্ধ ফিল্ড মার্শাল যদিও গণতন্ত্রের প্রতি ততোটা আস্থাশীল ছিলেন না বরং তিনি রাজতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি চাইতেন পূর্বের রাজ পরিবারের কাউকে সমগ্র জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত করতে। পরবর্তীতে নাৎসীদের কর্মকান্ডকে খুব একটা পাত্তা দিলেন না তিনি বরং তৎকালীন ভাইমার রিপাব্লিকান সরকারকেই সমর্থন করতে লাগলেন।
এদিকে SA সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছিলো তখন। রোহমের পদত্যাগের পরও তাদের নৈরাজ্য কমছিলো না। ত্যক্তবিরক্ত হিটলার ভাবতে লাগলেন কিভাবে তাদের দুর্বল করা যায়। তখন নাৎসী তরুনদের নিয়ে আরেকটা দল গঠন করা হয়েছিলো। তারাই বিখ্যাত এস এস (SS)। তখন পর্যন্ত সংখ্যায় তারা ছিলো অনেক কম। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান ছিলো দারুন। হিটলারের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিলো অন্যরকমের। হিটলার চিন্তা করলেন SS দের দিয়েই তিনি SA দলের প্রভাব ক্ষুন্ন করবেন। তিনি তাঁর অন্যতম বিশ্বস্ত সহচর হিমলারকে দায়িত্ব দিলেন এ দলটিকে গড়ে তুলতে, সুসংঘটিত করতে। হিমলার লেগে পড়লেন কাজে। পরে এই SSরা দারুন দক্ষতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন ফ্রন্টে ও কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেছে সফলভাবে।যদিও জার্মানদের বেশিরভাগ যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হয়েছে তাদের দ্বারাই। এরই মধ্যে চলে আসে ১৯২৮ সালের নির্বাচন। এতে নাৎসীদের অবস্থা আরো খারাপ হয়। রাইখস্টাগে তারা মাত্র ১২ টি আসন পায়। হতাশ হিটলার সেই সময়ে দলের বিভিন্ন কোন্দল মেটাতেই ব্যস্ত ছিলেন। এর কিছু পরেই এলো ত্রিশের দশক। বিশ্বজুড়ে শুরু হলো বিরাট অর্থনৈতিক মন্দা। জার্মানির ঋণদাতা আমেরিকার অবস্থাও খারাপ। তবে জার্মানদের অবস্থা বেশি খারাপ হলো। মুদ্রাস্ফীতি চরমে পৌছালো। সবখানে অরাজকতা। এমন পরিবেশকেই হিটলার জন্যে অনূকূল বলে ধরে নিলেন। আবার বেজে উঠলো নির্বাচনের দামামা। ১৯৩০ সালের নির্বাচন নাৎসীদের জন্যে সুসময় বয়ে আনলো। রাইখস্টাগে নাৎসীরা ১০৭ টি আসন লাভ করে পাশাপাশি কমিউনিস্টদেরও শক্তি বাড়ে। তারাও ৭৭ টি আসন লাভ করে। উচ্ছ্বসিত হিটলার এতেও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না।

১৯৩৩ সালের নভেম্বরে হিন্ডেনবার্গ এবং হিটলারের জন্য নির্বাচনী পোস্টার
আদতে তিনি পার্লামেন্টারী সিস্টেমে বিশ্বাসই করতেন না। কিন্তু এ পথেই তাকে ক্ষমতার শিখরে উঠতে হবে। জনপ্রিয়তা বাড়ার পরপরই সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কান্নয়োনের দিকে জোড় দেন তিনি। এতদিন রোহমের মাধ্যমেই সেনাবাহিনীর সাথে লিয়াজো রাখতেন তিনি। কিন্তু রোহমের পদত্যাগের পর সেনাবাহিনীর সাথে কিছুটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে। এটা দূর করা প্রয়োজন কারন সেনাবাহিনী সাথে না থাকলে তিনি তাঁর লক্ষে পৌঁছাতে পারবেন না। তিনি প্রকাশ্যে ভার্সাই চুক্তি ও মিত্রপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন শর্তের বিরোধিতা করে বলিষ্ঠ বক্তৃতা করতে থাকেন। তাঁকে সমর্থন করলে তিনি জার্মান জাতীর পূর্বের গৌরব ফিরিয়ে আনবেন। এতে করে সেনাবাহিনীর সদস্য ও অফিসারদের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
এবার জার্মানির রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন আরোও দুই ব্যাক্তি। এরা হলেন পেপেন এবং আরেকজন সেলিসজার। প্রথম জন ঝানু রাজনীতিবিদ আর দ্বিতীয় জন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। এঁরা দুইজনই গুরুত্বপূর্ণ গুটি হয়ে ওঠেন। তখন রাইখস্টাগে চার প্রধান দল ছিলো। বামপন্থী কমিউনিস্ট, সোশাল ডেমোক্র্যাট, সেন্টার পার্টি ও হিটলারের নাৎসী দল। কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ না। এমন পরিস্থিতিতে বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ পেপেনকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেন। এদিকে পেপেন চ্যান্সেলর হয়েও পড়লেন ফাঁপড়ে। নাৎসীরা যদিও তাঁর মন্ত্রীসভায় যোগ দেয় নি কিন্তু বাকি দলগুলোর আনুগত্য ও তাঁর প্রতি নেই। এরকম অসহনীয় পরিস্থিতিতে তিনি মন্ত্রীসভা ভেঙে দেন। বিভিন্ন প্রদেশে SA দের সাথে কমিউনিস্ট ও অন্যান্য দলের কর্মীদের মধ্যে সংঘাত হয়। নতুন নির্বাচন হয়।এবারে নাৎসীরা ২৩০ টি আসন পায়। কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ হয় নি। হিটলার এখন অন্যতম প্রধান দলের নেতা।প্রেসিডেন্ট হিটলারকে মন্ত্রীসভা গড়তে বললেন। কিন্তু হিটলার রাজি হলেন না। তিনি একক ক্ষমতা চান, কারোর মুখাপেক্ষী হয়ে ক্ষমতার স্বাদ পেতে চান না। এদিকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেলিসজার হাত মেলালেন নাৎসীদের সাথে। দলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা স্ট্রেসার গোপনে সেলিসজারের সাথে পরামর্শ করে একটা আপোস করে ফেলেন, এতে সেলিসজার চ্যান্সেলর হলেও নাৎসীরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাবে। অর্থাৎ সেলিসজার নাৎসীদের নিয়েই তাঁর মন্ত্রীসভা গঠন করবেন। দলের প্রধানকে এড়িয়ে এই গোপন আপসের কথা জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন হিটলার। তিনি মানতে চাইলেন না।

১৯৩৯ সালের ১৫ মার্চ জার্মানি চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেয় (ছবিতে প্রাগের পতনের পর শহরটি ভ্রমণে হিটলার)
ফলে নাৎসীদের মধ্যে দুই গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেলো। একপক্ষে হিটলারের ঘনিষ্ঠ হিমলার, গোয়েরিং, হেস প্রমুখ ও অন্য দিকে স্ট্রেসারের অনুগত। সেলিসজার কিন্তু বুঝলেন হিটলার তাঁকে সমর্থন না করলেও স্ট্রেসারের পক্ষের অনেকেই তাঁর পক্ষে থাকবেন। তাই তিনি নিশ্চিন্ত। তিনি স্ট্রেসারকে ভাইস চ্যান্সেলর পদের লোভ দিয়ে রাখলেন।অপরদিকে পেপেন গিয়ে প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করলেন সেলিসজারকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তিনি স্বয়ং ক্ষমতা গ্রহন করতে। কিন্তু এর পরিণাম হত ভয়াবহ।কারন পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে সেলিসজারের প্রভাবও আছে।আবার নাৎসীদের গুন্ডাবাহিনী SAরা রয়েছেই।সবদিক চিন্তা করে বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট সেলিসজারকেই সরকার গঠন করতে বললেন। কিন্তু হিটলার স্ট্রেসারের কাছে তারঁ কৈফিয়ত চাইলে বাক-বিতন্ডার এক পর্যায়ে স্ট্রেসার পদত্যাগ করেন দল থেকে। ফলে এখন নাৎসীদের হাত করতে ব্যার্থ হয়ে সেলিসজার অন্যান্য দলগুলোকে হাত করে ফেলেন, ফলে তাঁর ক্ষমতা লাভে আর কোনো বাধা থাকলো না।এভাবে সেলিসজার নাৎসীশাসন পূর্ব জার্মানির শেষ চ্যান্সেলর হলেন।
সেলিসজারের এমন হটকারিতায় ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ পেপেন গোপনে হাত মেলালেন হিটলারের সাথে।এদিকে হিটলার স্ট্রেসারের ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে সেলিসজারের সাথে হাত মেলানো মেনে নিতে পারেন নি, তিনি স্ট্রেসারকে শায়েস্তা করার শপথ নেন।যদিও তিনি ছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার পূজারী, তাঁর পথের কাটা সেলিসজারকে হটানোর জন্যে পেপেনের সাথে হাত মেলালেন তিনি।দুজনে মিলে ঠিক করলেন সেলিসজারকে হঠিয়ে তাঁরা দুজনে মিলে জার্মানিকে গড়ে তুলবেন।এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক নির্বাচনে নাৎসীরা দারুন সাফল্য পায়। এসব ক্ষেত্রে পেপেন তাঁর শিল্পপতি শুভাকাঙ্ক্ষীদের দিয়ে নাৎসীদের তহবিল ভারী করেন।চারিদিকে নাৎসীদের জয়জয়কার। অবস্থা বেগতিকবুঝে সেলিসজার নিরুপায় হয়ে ছুটলেন প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ এর কাছে, নাৎসীদেরকে প্রতিহত করার প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে আগেই প্রভাবিত করে রেখেছিলেন পেপেন ও হিটলার।প্রেসিডেন্ট সাফ জানিয়ে দিলেন রাইখস্টাগে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে না পারলে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে।এরপর প্রেসিডেন্ট সেলিসজারের অনুগত সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন উর্ধতন অফিসারকে বরখাস্ত করলেন।তখন সেলিসজারের আর কিছু করার থাকলো না।তিনি পদত্যাগে বাধ্য হলেন।এবারে প্রেসিডেন্ট হিটলারকে বললেন সরকার গঠন করতে।এবারে চ্যান্সেলর পদ গ্রহন করলেন এডলফ হিটলার।

১৯৪২ সালের জুনে আর্মি গ্রুপ সাউথের সদর দফতরে একটি বৈঠকের সময় হিটলার
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নিলো নাৎসীরা। হাজার হাজার নাৎসী নর– নারী বিজয়ের আনন্দে বার্লিনের রাজপথে স্বস্তিকা স্বম্বলিত বিজয় শোভাযাত্রা বের করে। এবারে দলে দলে নাৎসী SA আর SS কর্মীরা যোগ দেয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে। এতে করে নাৎসীদের প্রভাব আরোও বেড়ে গেলো।হিটলারের রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণ হলেও তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না, কারন তিনি ক্ষমতায় এসেছেন সেন্টার পার্টির সাথে জোট করে।একক সর্বময় ক্ষমতার স্বাদ তিনি পাচ্ছিলেন না। এবারে তিনি এক মোক্ষম চাল দিলেন।সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ ঘোষনা দিয়ে বসলেন যে, সেন্টার পার্টি তাঁর সাথে একত্রে কাজ করতে চাইছে না।সেন্টার পার্টির নেতারা প্রতিবাদ করার সময়ই পেলেন না। ফলে আবার নির্বাচনের সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। কিন্তু এবারে পরিস্থিতি ভিন্ন। এবারে নাৎসীরা আরো সুসংগঠিত এবং প্রশাসন ও তাদের অনূকূলে।এবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কমিউনিস্টদের সাথে। তাদেরও শক্তি বেড়েছে রাইখস্টাগে।রাষ্ট্রীয় মদদে তাদের উপর ব্যাপক ধড়-পাকড় শুরু হোলো।বড় বড় কমিউনিস্ট নেতারা হয় গ্রেফতার বা গুম হয়ে যেতে লাগলো।এর মধ্যে ঘটলো বিরাট এক ঘটনা। জার্মান রাইখস্টাগে রাতের অন্ধকারে কে বা কারা আগুন লাগালো। সেখান থেকে ভ্যানডার লুবে নামক একজন কমিউনিস্ট কর্মীকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হয়। এরপর নাৎসী প্রোপাগান্ডা শুরু হোলো এসব কমিউনিস্টদের কাজ। সোভিয়েত গুপ্তচরেরা বলশেভিক বিপ্লবের নামে জার্মানীকে অস্থিতিশীল করার চেস্টা করছে। পরবর্তীতে অবশ্য এ ঘটনার পেছনে নাৎসীদের যোগাযোগ প্রমানিত হয়েছে।প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সুযোগ ভালোই কাজে লাগায় নাৎসী শিবির।বড় বড় শিল্পপতিরা দেদারসে টাকা ঢালতে লাগলেন তাদের তহবিলে।হিটলার চ্যান্সেলর হোলেও কিন্তু এই নির্বাচনেও নাৎসীরা একক সংখাগরিষ্ঠ হতে পারলো না।কমিউনিস্টদের জনপ্রিয়তায় এ সময় কিছু ভাটা পড়ে কিন্তু তারাও উল্লেখযোগ্য আসন লাভ করে। হিটলার কমিউনিস্টদের সমূলে উপরে ফেলতে চান। মিথ্যা বলশেভিক বিপ্লবের ভয় দেখিয়ে জনগনকে বিভ্রান্ত করে নাৎসী প্রোপাগান্ডা যন্ত্র। এরপর হিটলার তাঁর ডিক্টেটর হওয়ার পথে শেষ অস্ত্রটি ব্যবহার করলেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে এক বিশেষ আইন পাশ করিয়ে নেন সুকৌশলে। এতে নাৎসী পার্টি ছাড়া জার্মানিতে অন্য সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ততদিনে গোয়েরিং-এর হাতে গড়া গেস্টাপো নাৎসীবিরোধী নেতা-কর্মীদের উপর ব্যাপক দমন- পীড়ন চালাতে থাকে।

হিটলার 1928 সালে SA সদস্যদের সাথে নুরেমবার্গে ।
হিটলারের সামনে তখন আর কোনো চ্যালেঞ্জ থাকলো না।এতদিন নির্বাচন আর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে তিনি নিজ দলের বিরোধী পক্ষের দিকে নজর দিতে পারেন নি।এবারে তিনি দলের মধ্যে তাঁর বিরোধী পক্ষ নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। SA দলের নেতা রোহম আগে পদত্যাগ করলেও তিনি ততদিনে ফিরে এসে SA দলের হাল ধরেছেন।তিনি প্রকাশ্যেই হিটলারের বিরোধিতা করতে লাগলেন। তাঁদের বিরোধের মূল কারন ছিলো আগের সেই SA দের প্রাধান্যের দাবি।রোহম SA দলের দাপটে সন্দিহান হয়ে ওঠে জার্মান সেনাবাহিনী। রোহমও হিটলারের কাছে SA সদস্যদের সেনাবাহিনীর সাথে আত্তীকরণের আহবান জানান। চতুর হিটলার রোহমের দাবিকে উড়িয়ে দেন।তিনি জার্মান সেনাপ্রধান জেনারেল ব্লুমবার্গকে আশ্বস্ত করেন যে, তাঁর এমন কোনো ইচ্ছা আপাতত নেই। তিনিও SA দের লাগাম টেনে ধরতে ইচ্ছুক। পরে সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের পক্ষে পুর্ণ আনুগত্য জানান এবং সরকারের অধীনে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করে যান।
ক্ষিপ্ত রোহম গোপনে হাত মেলান স্ট্রেসার ও পূর্বের চ্যান্সেলর সেলিসজারের সাথে।স্ট্রেসার আগে থেকেই হিটলারকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন কিছুটা প্রগতিশীল। আগের নির্বাচনে সেলিসজারকে সমর্থন দেয়া নিয়ে হিটলারের সাথে বিরোধ শুরু হয় আর সেলিসজার তো আগে থেকেই ছিলেন।ফলে সমমনা এই তিনজন নেতা মিলে হিটলারের বিরোধী একটা চক্র গড়ে তুলতে চাইলেন।ইতোমধ্যে, ভাইস চ্যান্সেলর পেপেন হঠাৎ হিটলারের বিরোধী হয়ে উঠলেন।তিনি মনে করেছিলেন স্ট্রেসার, রোহমের পরিকল্পনায় হিটলার দূর্বল হয়ে পড়বেন। পরে প্রেসিডেন্টের সহায়তায় তিনি আবার ক্ষমতায় বসবেন। এবারে হিটলার তাঁর পথের কাটা পরিস্কার করার জন্যে সবথেকে নির্মম খেলা খেললেন।তিনি গোয়েরিং আর হিমলারকে গোপনে ডেকে তাঁর পরিকল্পনা জানিয়ে দেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেন।
পরিকল্পনামাফিক জুনের ২৮ তারিখ হিটলার বার্লিন ত্যাগ করলেন এক বন্ধুর বিবাহ উৎসবে যোগ দিতে। অন্তত এমনটাই জানানো হয়েছিলো তখন। এদিকে ২৯ ও ৩০ জুন গোয়েরিং তার গেস্টেপো আর হিমলার তার অনুগত সশস্ত্র SS সদস্যদের নিয়ে শুরু করে দিলেন হত্যাযজ্ঞ। এদেরই একটা দল গিয়ে গ্রেফতার করে রোহমকে।অকথ্য নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে জেলখানার মধ্যে।আর বার্লিনে হিমলার আর গোয়েরিং ততক্ষণে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেন।হিটলারের বিরোধী হিসেবে যাকেই সন্দেহকরা হয়েছিলো তাকেই হত্যা করা হয়েছে। নাৎসীদের নধ্যেও যারা হিটলার বিরোধী ছিলো তাদেরও হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। সেলিসজারের বাড়িতে একদল সশস্ত্র লোক গিয়ে তাঁকে সস্ত্রীক হত্যা করে আসে। ৩০ জুন স্ট্রেসারকেও ধরে আনা হয়।জেলখানায় নির্যাতনের পর তাঁকেও হত্যা করা পেপেনকেও হত্যার জন্যেও খুঁজেছিলো।পেপেন প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকে কোনোমতে নিজের জীবন বাঁচান। হিটলারের নির্দেশেই হিমলার বা গোয়েরিং এর কোনো লোক প্রেসিডেন্ট ভবনে হামলা চালায় নি।কিন্তু পেপেনের ঘনিষ্ঠ ব্যাক্তিদের প্রায় সবাইকেই হত্যা করা হয়। এভাবেই নিষ্ঠুরভাবে শেষ হয় হিমলার, গোয়েরিং এর ক্রাকডাউন।হিটলার পরে বার্লিনে ফিরে আসলে তাঁকে নাৎসীরা গার্ড অব অনার দিয়ে বরণ করে নেয়।এভাবেই হের হিটলার সমস্ত বিরুদ্ধমতকে দমন করে নিজেকে জার্মান জাতীর ফ্যুয়েরার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইতিহাসে এই কালো রাতটিকে “Night of the long Knives” বলে অভিহিত করা হয়।প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ ছিলেন অতিশয় বৃদ্ধ। কিছুই করতে পারেন নি তিনি।এর কিছুদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফলে হিটলারকে চ্যালেঞ্জ করার মত জার্মানিতে আর কেউই থাকলো না। এবার তিনি পুরো বিশ্বকে আরেকবার ঝাকুনি দিতে আসছেন। বিশ্বকে আরেকটি মহাযুদ্ধের তান্ডবলীলার মুখোমুখি করবেন তিনি।

১৯৩৪ সালে বাভারিয়ায় এসএ নেতা আর্নস্ট রোহম
হিটলারের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি মোটেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাস করতেন না।তিনি প্রথম থেকেই একনায়ক তথা একচ্ছত্র অধিপতি হতে চেয়েছিলেন সমগ্র জার্মানির। শুরুরদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুসোলিনীর মত ক্ষমতার স্বাদ নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেইসময়ের জার্মানিতে এটা খুব একটা সহজও ছিলো না। নাৎসী দলকে একটি প্রাদেশিক রাজনৈতিক দল থেকে পুরো জার্মানির প্রধান দলে পরিনত করার যাত্রা মোটেও সহজ ছিলো না। শুরুর দিকে রোহম ছিলেন হিটলারের অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁকে ছাড়া সেসময়ে হিটলার কল্কে পেতেন না। কিন্তু পরে সময় বুঝে রোহমকেও ঝেড়ে ফেলতে সময় নেন নি।আবার নিজের বিরুদ্ধ মতকেও শক্ত হাতে দমন করেছেন। আসলে রাজনীতির জুয়াতে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। অধ্যাবসায়, বাগাড়ম্বরতা, শঠতা, কূটবুদ্ধি নিয়ে তিনি পৌছে গিয়েছিলেন ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে। তাঁর ইস্পাতকঠিন ব্যাক্তিত্ত্বের সামনে কুঁকড়ে যেতেন জাদরেল সব জেনারেলরা, প্রভাবিত হত জনগন।জার্মানির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত নিজের একগুয়েমি, অহমিকা ও জেদের কারনে নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে এনেছিলেন তিনি, তারপরও তাঁর প্রতিভাকে অস্বীকার করার উপায় একদমই নেই।