সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’ দেবীর প্রতিরূপ, যাকে সুমেরীয়-ব্যবিলনীয় দেবী ইনান্নার আরেক সমন্বয় বলে মানা হয়। তবে দুর্গার সাথে এই মধ্য এশীয় দেবীর এতো মিল কেনো? তাহলে কি দুর্গার ধারণার উৎপত্তি এই মধ্য এশিয়াতেই হয়েছিলো?
প্রাচীন পারস্যের সগডিয়ানা রাজ্য; বর্তমানের উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখিস্তান ও কিরজিস্থানের এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে প্রসারিত হয়েছিলো এই এলাকা। সিল্ক রুটের অন্যতম অঞ্চল সগডিয়ানা প্রদেশের গুরুত্ব সবকালেই ছিলো বিশেষ। আর তাই সাইরাস দ্য গ্রেট থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও এই অঞ্চলের প্রতি বিশেষ নজর দিতে কার্পণ্য করেন নি।
জেরাভশান নদীর তীরবর্তী বর্তমান পশ্চিম তাজিকিস্তানের পানজিকান্ত শহরটি ছিলো প্রাচীন সগডিয়ানা রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে গড়ে উঠেছিলো এক পরিপূর্ণ নগর-সভ্যতা। ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে পূর্ব পানজিকান্তের মুগ পর্বতের কাছে একটি ছোট প্রাসাদ-দুর্গের ভেতর কিছু লিখিত দলিল উদ্ধার করেছিলেন স্থানীয় একজন রাখাল। এরপর ১৯৪৬ সালের যুদ্ধের পর পানজিকান্তে প্রথম আনুষ্ঠানিক খনন শুরু করেন আলেকজান্ডার ইয়াকুবোভস্কি। ত্রিশ ফুট উঁচু প্রাচীরে ঘেরা পানজিকান্তের প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ সে সময় জনমনে বিস্ময় তৈরী করেছিলো। সেই সাথে বেরিয়েছিলো চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য ও নিদর্শন।
যত্ন করে তৈরী করা পথ, পথের দুই পাশে ইটের দুই-তিন তলাবিশিষ্ট দালান, দোকানপাট –কি ছিলো না সেই নগরীতে! তবে সবচেয়ে তাৎপর্যবহুল ছিলো বড় একটি দুর্গ এবং দুটি মন্দির। মন্দির দুটোর একটিতে মিলেছে সগডিয়ানদের প্রধান ধর্মদেবতা ‘অধভগ’ এর মূর্তি, যা সম্ভবত জোরোস্ট্রিয়ান ঈশ্বর ‘আহুরা মাজদা’-রই আরেক নাম। অপর মন্দিরটিতে মিলেছে সিংহের ওপর বসে থাকা দুর্গাদেবীর সাথে অসাধারণ সাদৃশ্যপূর্ণ সেই ‘নানায়াহ’ দেবীর মূর্তিটি। আসলে পানজিকান্তেরই নগরদেবী ছিলেন এই ‘নানায়াহ’। ইনান্নার রূপে এই দেবী প্রথমবার পরিলক্ষিত হয়েছিলেন কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের মুদ্রায়। আমু দরিয়া নদীর কাছে খোয়ারিজমে পাওয়া একটি রূপার বাটিতেও এই নানায়াহ বা ননা দেবীর চিত্র খোদিত হয়েছে।
‘নানায়াহ’-র মন্দিরটির সাথেই আরেকটি ছোট মন্দির ছিলো। সেখানে পাওয়া গেছে ‘নানায়াহ’-র আরেকটি কৃষ্ণ বর্ণের মূর্তি। দেবী এখানে একটি সিংহের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছোট মন্দিরটিতে আরও কিছু বহু হাত-পা বিশিষ্ট প্রাচীন পার্সিয়ান দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। সেই সাথে ছিলো সগডিয়ানদের আবহাওয়া ও জলবায়ুর দেবতা ‘ওয়েশপার্কার’ এর মূর্তি, যার সাথে রয়েছে হিন্দু দেবতা শিবের ভীষণ মিল। এ ছাড়াও সগডিয়ানদের প্রাচীন লিখিত দলিলগুলো থেকে জানা যায়, জেরাভশান নদীকে তারা যে দেবতা বলে মানতেন ও পূজা করতেন, তার সাথে হিন্দুদের ব্রহ্মার রয়েছে অদ্ভূত সাদৃশ্য। মহাভারতে বর্ণিত পাশা খেলার দৃশ্যও মিলেছে একটি চিত্রে।
পারস্যে সগডিয়ানা এমন এক অঞ্চল ছিলো, যেখানে অসাম্প্রদায়িকতা ভীষণভাবে লক্ষণীয়। জরাথ্রুস্টবাদ, খ্রিস্টান ধর্ম, ম্যানিকিজম, হিন্দুত্ববাদ, জুডিজম, ইসলাম ইত্যাদি সব ধর্মেরই সহাবস্থান ছিলো সগডিয়ানায়। কারণ তারা ছিলো ব্যবসাসুলভ জাতি। হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীর উপর সগডিয়ানার দেব-দেবীর প্রভাব স্পষ্টভাবেই লক্ষ করা যায়। তাই হিন্দুত্ববাদের আবির্ভাবের শুরুটা যে এখান থেকেই হয় নি, তা হলফ করে বলা যায় না। কিছুটা পরিবর্তিত, কিছুটা পরিবর্ধিত রূপে হয়তো মধ্য এশিয়া থেকেই দুর্গা, শিব, নারায়ণ, ব্রহ্মাদের কাহিনী বিস্তৃতি লাভ করেছে বিশ্বব্যাপী।
রেফারেন্স:
- মধ্য এশিয়ায় দুর্গা
- Kala Kshetram
- Nana: The “Original” Goddess on the Lion
- A Four-Armed Goddess from Ancient Chorasmia: History, Iconography and Style of an Ancient Chorasmian Icon
- Nanâ, the Sumero-Akkadian Goddess of Transoxiana
- GODDESS NANA ON THE BRONZE COINAGE OF KANISHKA I
- Panjikent is a Sogdian city, the ruins of which are located in the southern periphery of the present-day city of Panjakent (in western Tajikistan).