ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধের সবেমাত্র সমাপ্তি হয়েছে। বিজয়ী মৌর্য সম্রাট অশোক নিজের কীর্তি ঘুরে দেখছেন। লাশের কারণে হাটতে বেগ পেতে হচ্ছে। ধৌলি পাহাড়ের ময়দানে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে মৌর্য সেনারা। অশোকের স্বপ্ন এবার সত্যি হয়েছে। বেয়াড়া আর অহংকারী কলিঙ্গ রাজকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়েছে। পূর্বপুরুষের সাধের কলিঙ্গ এবার পদানত হয়েছে অশোকের হাতে। কিন্তু হঠাৎ করে সম্রাট অশোককে কিছুটা বিচলিত দেখা গেল। যেই কলিঙ্গ জয় করার জন্য অশোক অনেক আগ থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন এমনকি দাঁতে দাঁত কামড়ে যুদ্ধ ময়দানে পড়ে থেকেছেন জয় করে ফিরে যাওয়ার জন্য সেই অশোক-ই কিনা বিচলিত। সম্রাট অশোকের বিচলিত হওয়ার কারণ আমরা পরে জানব। তার আগে দেখে নেব দুই পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য মৌর্য এবং কলিঙ্গের মধ্যকার যুদ্ধের প্রেক্ষাপট কিভাবে তৈরি হল।
মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯-২৩২) ছিলেন এ বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রতিষ্ঠিত এ সাম্রাজ্য পিতা বিন্দুসারের হাত দিয়ে অশোকের কাঁধে এসে বর্তায়। তার আমলেই মৌর্য সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বেশি বিস্তার ঘটে। অশোকের দক্ষতায় মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমানা পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্বে বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার হাত ধরেই প্রায় পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ মৌর্য সাম্রাজ্যের কব্জায় চলে আসে। নবাগত সম্রাট যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন পিতামহ এবং পিতার নীতি অনুসরণ করে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে মনোযোগী হোন। আর এ কাজে তিনি বেশ সফলও হোন যার প্রমাণ আগেই পাওয়া গেছে। কিন্তু তখনো পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের শক্তিশালী রাজ্য কলিঙ্গকে বাগে আনা সম্ভব হয়নি অশোকের পক্ষে। এর আগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং বিন্দুসারও কলিঙ্গ দখলের চেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। তাই এবার অশোক চিন্তা করলেন যে করেই হোক কলিঙ্গ জয় করে ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের নিরংকুশ আধিপত্য কায়েম করতে হবে। তাছাড়া সে আমলে কলিঙ্গ রাজ্যের অর্থনৈতিক গুরুত্বও ছিল তুঙ্গে। বর্তমান ভারতের ওডিশা রাজ্যের ভেতরে পড়া কলিঙ্গের সাথে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সমুদ্র বন্দরের বর্তমানতার কারণে পুরো ভারতে কলিঙ্গের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ঈর্ষা জাগানোর মত ছিল। তাছাড়া ভারতের বুকে সমমনা আরেকটি শক্তিকে মেনে নিতে পারছিলেন না সম্রাট অশোক। কেননা কলিঙ্গ রাজ্যের সামরিক শক্তিও ছিল আকাশছোঁয়া। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস যখন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে ভারতে আসেন তখন কলিঙ্গের সামরিক শক্তি সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়ে যান তা তাঁক লাগানোর মতে। শুধুমাত্র কলিঙ্গের রাজার নিরাপত্তার জন্য ৬০ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী এবং ৭০০ যুদ্ধহাতি মোতায়েন থাকত। তাদের যুদ্ধহাতি সেসময়ে অপরাজেয় ছিল। বহিরাগত কোন শক্তি কলিঙ্গ আক্রমণ করতে দুইবার ভাবত। পরাক্রমশালী অশোক কলিঙ্গের এমন সমৃদ্ধি সহ্য করতে পারলেন না। বাপ দাদার ইচ্ছা বাস্তবায়ন ও নিজের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বাস্তব রূপ দিতে কলিঙ্গ আক্রমণের বাহানা খুঁজতে থাকেন তিনি।
ময়দানে কলিঙ্গ যুদ্ধঃ অশোকের নৃশংসতা
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে কলিঙ্গ আক্রমণ মৌর্য সাম্রাজ্যের জন্য অবশম্ভাবী হয়ে দাঁড়ালো। আর এজন্য সম্রাট অশোক বহু আগ থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ সালে সম্রাট অশোকের রাজ্যভিষেকের নবম বছরে কলিঙ্গ অভিযানের জন্য মনস্থির করেন মৌর্য সাম্রাজ্যের এই গর্বিত সম্রাট। আর এর জন্য তিনি এক অপমানজনক চিঠির মাধ্যমে কলিঙ্গের রাজা পদ্মানাভানের কাছে মৌর্য সাম্রাজ্যের নিকট আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠান। কলিঙ্গ রাজ অশোকের এমন স্পর্ধা দেখে যারপরনাই অবাক হোন এবং দূতকে অপমান করেন (দূতের ভাগ্যে কি ঘটেছিল অজানা)। স্বাভাবিকভাবেই সম্রাট অশোক যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। ওদিকে পরম শক্তিমান কলিঙ্গ রাজ্যও প্রস্তুত হতে থাকে ভাবী আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য। দু পক্ষই প্রায় লাখ খানেক সৈন্য নিয়ে প্রথম মুখোমুখি হয় ধৌলি পর্বতের সমতল ময়দানে। বর্তমান ওডিশার দয়া নদীর তীরে দুই অমিত শক্তিধর বাহিনী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অশোক যেহেতু অনেক আগ থেকেই এ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেজন্য তার সৈন্যরা প্রথম থেকেই যুদ্ধে এগিয়ে থাকে। কলিঙ্গের সৈন্যরা পালটা প্রতিরোধে রুখে দিতে থাকে অশোকের বাহিনীকে। অশোকের বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলে ময়দানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কলিঙ্গের দেশপ্রেমী সৈন্যরা মৌর্য সৈন্যদের আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু সহসাই অশোকের অমিত শক্তিধর বাহিনীর হাতে মার খেতে থাকে কলিঙ্গের সেনারা। তাদের যুদ্ধহাতিও শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে যায়। যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ যখন সম্রাট অশোকের হাতে চলে যায় তখন ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য কলিঙ্গের সাধারণ জনগণ যুদ্ধে নেমে পড়ে। সক্ষম যুবকরা যে যার মত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালাতে থাকে। হতভম্ব অশোক বাহিনী মনোবল হারালেও মুষড়ে পড়েনি। শেষ পর্যন্ত রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে শেষ কলিঙ্গ সৈন্যকে হত্যা করে সম্রাট অশোক ক্ষান্ত হোন। নৃশংস এ যুদ্ধে লাখের উপর কলিঙ্গ সৈন্য প্রাণ হারায়। পুরো রাজ্য পরিণত হয় বিরাণভূমিতে। দয়া নদীর পানিতে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। কথিত আছে, লাশের স্তুপ পরিস্কার করার জন্য সেসময় কলিঙ্গে একজন দাসও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে অশোক কলিঙ্গ জয় করলেন ঠিকই কিন্তু শান্তি পেলেন না। এমন সময় এক বৃদ্ধার হৃদয়বিদারক আর্তিতে বিচলিত হয়ে পড়েন মৌর্য সাম্রাজ্যের বিজয়ী সম্রাট অশোক। অশোকের সামনে যখন ঐ বৃদ্ধা এসে বললেন,
“আপনি আমার স্বামী, সন্তানকে হত্যা করেছেন। আমার আর জীবিত থেকে কি হবে?”
বৃদ্ধার এমন মর্মস্পর্শী আবেদনে বিদ্যুৎ খেলে অশোকের মনে। রক্তাক্ত কলিঙ্গের দিকে অনুশোচনায় জ্বলেপুড়ে মরতে লাগলেন সদ্য কলিঙ্গ জয় করা নৃশংস এই শাসক। ইতিহাসের মোড় ঘুরতে আর বেশি দেরি হল না। অশোক ঘোষণা দিলেন তিনি আর কোন যুদ্ধে অংশ নিবেন না। এখন থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠাই হবে তার শাসনের মূল কথা। বৈদিক ধর্ম ত্যাগ করে গ্রহণ করলেন অহিংসার বৌদ্ধ ধর্ম। অহিংসার বাণী ছড়িয়ে দিতে লাগলেন স্তম্ভের মাধ্যমে। এই অশোক স্তম্ভই আজকের ভারতের জাতীয় প্রতীক। পৃথিবীর ইতিহাসে কলিঙ্গ যুদ্ধ ছিল একই সাথে নিষ্ঠুরতম এবং মোড় পরিবর্তনকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পরই সাম্রাজ্যবাদী অশোক হয়ে যান প্রিয়দর্শী সম্রাট অশোক।
তথ্যসূত্র