১৭৫০ সালের আগস্ট,

কলকাতায় এই প্রথম পা রাখলেন একজন আইরিশ যুবক। নাম অগাস্টাস হিকি। অল্প বয়স। সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা এসেছেন ভাগ্যের সন্ধ্যানে। ততদিনে কলকাতা বহির্বিশ্বের কাছে হয়ে উঠেছে “প্রাসাদ নগরী”। সবাই জানে কলকাতায় টাকা উড়ছে। সুতরাং একবার ঠিক মত খুটি গাড়তে পারলে বেশ বড় অংকের অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।

কিন্তু বেচারা হিকি, ভাগ্য তার এতটাই খারাপ ছিল যে কোনো কিছুতেই যেন সাফল্যের দেখা মেলে না। শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লার্ক হিসেবে কলকাতা পাড়ি জমান। সেই থেকে শুরু, এরপর বিভিন্ন পেশায় নিজেকে জড়িয়েছেন। কখনো মুচি, তেলি, দর্জি, কামার, গরিব ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে আবার কখনো ডাক্তারি করছিলেন, ফোড়া কাটা, বদরক্ত বার করা ইত্যাদি। কিন্তু কোনোভাবেই যেন অর্থের যোগান হচ্ছেনা।

এরপর নিজের জমানো সামান্য কিছু অর্থ এবং সাথে ধার দেনা করে একটা ছোটখাটো জাহাজ কিনলেল। ঠিক করলেন ব্যবসা করবেন। কিন্তু সেই পোড়া কপাল, মাদ্রাজ থেকে কলকাতা ফেরার পথে ঝড়ের কবলে সমস্ত মাল হল নষ্ট । কি করা, দেনার দায়ে ঘরবাড়ি, আসবাব সব গেল। মড়ার উপর খাড়ার ঘা” এই কষ্টে রাগে, দুঃখে কোর্টে নিজের উকিলকে যাচ্ছেতাই বলে বসলেন। ব্যাস, হয়ে গেল জেল। কিন্তু এত কষ্টের পরও উপায় নেই পিছনে ফেরার ।

২৯ জানুয়ারি, ১৭৮০,

প্রকাশিত হল ‘বেঙ্গল গেজেট এর প্রথম সংখ্যা। বারো বাই আট ইঞ্চি আকারের দু’পাতার পত্রিকা। গড়নে ছোট কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর ভূমিকা ছিল অসামান্য। কলকাতা জন্মের দীর্ঘ ৯০ বছর পরে, ৬৭ নম্বর রাধাবাজারে হিকির ছাপাখানা থেকে প্রকাশ হল উপমহাদেশের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র হিকিস বেঙ্গল গেজেট, অর ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার ।

ছাপাখানা স্থাপন, পত্রিকার প্রকাশ পর্যন্ত আসতে কি না করছেন এই আইরিশ ভদ্রলোক। হাজার দুয়েক টাকা গচ্ছিত ছিল এক বন্ধুর কাছে। সেই টাকা দিয়ে একটা টাইপরাইটার কিনে নিলেন হিকি। ছুতোর দিয়ে প্রিন্টিং প্রেস বানালেন। তখনকার নিয়ম ছিল জেলে থাকা কয়েদীদের নিজের খাবার কাজ করে উপার্জন করতে হতো। অনেকে আবার বিভিন্ন কাজ করে অর্থ উপার্জনও করতে পারতেন। হিকি ছাপতে লাগলেন হ্যান্ডবিল, বিমার, বিজ্ঞাপন, দলিল, দরখন্তের ফর্ম, দিনপঞ্জিকা ইত্যাদি। ধীরে ধীরে সেখানেই গড়ে তোলেন ছাপাখানা।

ভোর থেকে রাত দুটো অবধি ছাপাখানা চালান হিকি। কিছুদিন পর এক সহৃদয়বান ইংরেজ উকিলের সহায়তায় দেনার দায় থেকে নিস্তার পান। এরপর অনেক ধরনের জিনিষ ছাপার কাজ করেছেন হিকি। কখনও সাধারণ মানুষের লেখা বা কখনো সেনাদের সব সংশোধিত নিয়মকানুন ছাপার মত বড় বড় কাজ। বেশ কয়েকবার ঠকেছেনও বটে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন সব বাদ, এখন থেকে শুরু করবেন খবরের কাগজ ছাপানোর কাজ। “অগাস্টাস হিকি” এক হতদরিদ্র আইরিশ যুবক তিনি কি তখন ধারণাও করতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে তার সাথে কি হতে যাচ্ছে!

বেঙ্গল গেজেট,

প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক হিকিস বেঙ্গল গেজেট’-এর প্রথম সংখ্যা। শুরুর দিকে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেশ ভীত ছিলেন হিকি। সাহস করে একটা কাজ করে ফেলেছেন এখন আর পিছনে ফেরার উপায় নাই। দল-মতনির্বিশেষে সবার জন্যউন্মুক্ত, কিন্তু কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়।’ এই স্লোগানের সাথেই যাত্রা শুর করেন সংবাদপত্রের।

পুরো কলকাতা জুড়ে সাড়া পড়ে গেছে। পত্রিকাটি ভারতবাসী বেশ উৎসাহের সাথেই গ্রহণ করে। কেউ পড়ছেন শখের বশে, কেউ বা স্রেফ কৌতূহলে। আবার কেউ আবার পত্রিকা। কিনছেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। কেওবা আড্ডায় নিজের প্রভাব ধরে রাখার জন্য। এখন আর কেও চিঠিতে এলাকার রাজনৈতিক ঘটনা বিস্তারিত লেখে না। পত্রিকার একটি কপি সাথে পাঠিয়ে দিলেই হয় অথবা লিখে দিলেই হয় যে, অমুক তারিখের পত্রিকায় বিস্তারিত আছে।

“জেমস অগাস্টাস হিকি” তিনি শুধু যে স্লোগানের জন্য স্লোগান রেখেছিলেন এমনটা নয়। তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন এবং মেনে চলার চেষ্টা করেছেন।

বিষয়,

চার পাতার কাগজ, দাম এক টাকা। সেখানে কলকাতার সাহেবদের কেচ্ছা কাহিনী যেরকম থাকতো তেমনই রস বাইতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মৃত্যু: শােভাবাজারে এক ধনীর জুড়িগাড়ি চাপা দিল এক গরিবকে’; ‘শোনা যাচ্ছে, কুড়ি টাকা দিয়ে কেসটা চাপা দেওয়া হয়েছে’ ইত্যাদি গােছের খবরও লিখেছেন হিকি। খবরের কাগজ থাকলে বড় বড় কর্তাদের নিয়েও দু-চার কথা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কোম্পানির বড় বড় অফিসারেরা ছিলেন এসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই কোম্পানির কর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ সৈনিকদের কাছের হিকির সংবাদপত্র বেশ জনপ্রিয় ছিল।

হিকির সাংবাদিকতা যে খুব উচু দরের ছিল, এমনটা নয়। তবে তার পত্রিকার অন্যতম বড় হাতিয়ার ছিল বিদ্রুপ, শ্লেষ, কৌতুক ও লেখার রম্যভঙ্গি। অসাধারন বিদ্রুপাত্মক বাক্যের সমাহার দেখা যায় তার সংবাদপত্রে। যেমন, কোম্পানির সৈনিকদের পক্ষে বলেছেন এভাবে, যারা না। লড়ে ফিরে গেল তারা পুরস্কারের টাকা পেল, আর আমরা আঙ্গুল চুষছি। যাদের চেনাশােনা আছে, তাদের প্রোমোশন হচ্ছে, আমরা বারো-চোদ্দো বছর তেতেপুড়ে মরছি। আবার কখনাে তার বিদ্রুপ স্রেফ চরিত্র হননের পর্যায়েও চলে গিয়েছে। যেমন, হেস্টিংসের বিরুদ্ধে লিখেছেন, যুদ্ধের চাপে হেস্টিংস যৌনক্ষমতা হারিয়েছেন। এছাড়াও শহরের রঙিন চরিত্রদের ডাকনামও দিতে শুরু করে তার পত্রিকা। যেমন কলকাতা শহরের জনকল্যাণ বিভাগের প্রধান এডওয়ার্ড টিরেটার ডাকনাম দেন ‘নােসি জার্গন। “নোসি” মানে, যে অন্যের ব্যাপারে অযথা নাক গলায়। আর “জান নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের পরিভাষা। প্রথমাংশটা আক্ষরিক অর্থে বললেও দ্বিতীয়াংশ দেওয়া হয়েছে বিদ্রুপ করে। কারণ, ইতালি থেকে আসা টেরেটা সাহেব ইংরেজি, ফ্রে, পর্তুগিজ ও হিন্দি ভাষা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি উদ্ভট এক ভাষায় কথা বলতেন। যা শুনতে অত্যন্ত বিরক্তিকর ছিল। এসব বিদ্রুপাত্মক বাক্য এবং ডাকনামের কারণে হিকিস বেঙ্গল গেজেট’ সাধারণের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল।

এছাড়াও হিকি লিখেছেন মহীশূর যুদ্ধের সময়েও। আবু হায়দার আলী যখন ৮০-৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে ৪-৫ হাজার সৈন্যকে কচুকাটা হয়েছে। তখনো তিনি হায়দার আলীকে ভিলেন’ বানাতে পারেননি। লিখেছেন, ইংরেজ কম্যান্ডার সাহায্যের আবেদন অগ্রাহ্য করে পুকুরে গুলি-বারুদ ফেলে পালালেন। ‘হায়দার আলীর হাতে বন্দী ইংরেজ সৈন্যরা নিরাপদেই আছে, নিজের ডাক মারফত চিঠি পাঠিয়েছেন। ইংরেজ মানেই যে সভ্যতার ঠিকাদার, আর ভারতীয়রা অমানুষ কিংবা ইংরেজ মানেই যে অপ্রতিরোধ্য, অদমনীয় এরকম প্রচার করে বেড়ানো কোম্পানির সাহেবরা প্রথম ধাক্কাটা খায় উপমহাদেশের প্রথম খবরের কাগজে। আর ভারতীয়দের কাছে। উন্মুক্ত হয় কোম্পানির আসল সত্য।

এছাড়া জনগনের মুখপাত্র হিসেবেও অনেক কাজ করে হিকি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রাস্তাঘাট, বিভিন্ন স্থাপনা, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং ময়লা-নর্দমার সঠিক ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের চেষ্টা করেন তিনি। সাধারণ পাঠককে চিঠি থেকে কবিতা, সব ধরনের লেখা পাঠাতেই উৎসাহ দেন হিকি।

তার পত্রিকায় আলাদা পাতা ছিল রাজনীতি, বিশ্ব সংবাদ এবং ভারতের খবর নিয়ে। তবে প্রমাণ ছাড়া কোনাে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা বিতর্কিত জিনিস ছাপাতেন না তিনি পত্রিকায়। কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখা ছাপার আগে অনেক যাচাই বাচাই করতেন। উসকানি বা দলাদলি মূলক কোন খবর তিনি প্রকাশ করতেন না, এরকম চিঠি পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন। কারণ রাজনৈতিক বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। সুতরাং সামান্য ভুল তার পত্রিকা পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে পারে। এছাড়া তিনি চেষ্টা করেছেন সবসময় নিরপেক্ষভাবে লেখার। কখনো কখনো নিজের মতের বিরুদ্ধে যায় এরকম খবরও প্রকাশ করতেন।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু যুগে যুগে বাকস্বাধীনতার গলা টিপে ধরেছে শাসকেরা। এক্ষেত্রেই বা কেন ব্যাতিক্রম হবে?

অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এবং শেষ,

কোম্পানির বিরুদ্ধে একের পর এক কলাম প্রকাশ করেই চলেছে ‘বেঙ্গল গেজেট’। এখন উ কি? ‘বেঙ্গল গেজেটে’র বিপরীতে আরেকটি পত্রিকা যাত্রা শুরু করলো, ‘দ্য ইন্ডিয়া গেজেট ক্যালকাটা পাবলিক অ্যাডভার্টাইজার।

হিকি নতুন পত্রিকার খবর পেয়ে তার পত্রিকার নাম বদলে রাখলেন, ‘হিকি’স বেঙ্গল গেজেট অর দ্য অরিজিনাল ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার । এসময় কোনো এক কারণে গভল জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী মেরিয়েন হেস্টিংসের এবং সঙ্গে সিমেয়ন ড্রোজ’ নামে কোম্পানির এক কর্মচারী হিকির কাছে ঘুষ চেয়ে বসে। হিকি তা দিতে অস্বীকার করে দেয়। হেস্টিংস কী করলেন? ঠিক তাই, যা আজকের শাসকরা করেন। অচিরেই হেস্টিংস পত্রিকার প্রচার বন্ধ করার পদক্ষেপ নেন। পোস্ট অফিস থেকে হিকির কাগজ বিলি বন্ধ করার নির্দেশ পাঠালেন। পোস্টমাস্টার জেনারেলকে পত্রিকা বহন করছে সন্দেহে যেকোনো চিঠি তল্লাশি করার ক্ষমতা দেন। একইসাথে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’- ‘-এর পোস্টেজ দিলেন ফ্রি করে দেয়। কারণ

কাগজ কোম্পানির পক্ষে কথা বলেছে তারা হায়দার আলিকে নর রাক্ষস’ বলে কলাম ছাপায় ।

হিকিও ক্ষেপে গেলেন। হিকি অভিযোগ করে পত্রিকায় কলাম ছাপলেন, মেরিয়ন হেস্টিংসকে ঘুষ না দেওয়ায় কোম্পানি তার পত্রিকা বন্ধের চেষ্টা করছে এবং ‘দ্য ইন্ডিয়ান গেজেট’কে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি, দুর্নীতি, শোষণের অভিযোগ থেকে শুরু করে হেস্টিংসকে ব্যক্তিগত পর্যায়েও আক্রমণ করেন তিনি। বিলেতি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি পদাধীকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনেন হিকি। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে কর্মরত প্রধান বিচারপতি এলিজাহ ইম্পের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ করেন তিনি। এই প্রকাশের মাধ্যমে হিকির অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। হিকি, হেস্টিংসের দন্দ তখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে পৌছে যায়।

গভর্নর হেস্টিংস স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার অপরাধে হিকির নিবন্ধিত পাঠকদের কাছে। ডাকযোগে পত্রিকা পাঠানো উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তখন হিকি হেস্টিংসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বসেন যে, জনাব হেস্টিংস তার বাকস্বাধীনতা খর্ব করছেন। ব্যাস, একদিকে ব্যাক্তিগত পর্যায়ের অভিযোগ অন্যদিকে কোম্পানির দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক কলাম। অতিষ্ট হয়ে ওঠেন হেস্টিংস সহ কোম্পানির বড় বড় হর্তাকর্তারা। মামলা করা হয় হিকির বিরুদ্ধে।

গবেষক অ্যা ওটিস দেখাচ্ছেন, এর আগে পর্যন্ত এগারো মাসে হিকি কোম্পানির দুর্নীতি নিয়ে দুটো, সংবাদের স্বাধীনতা নিয়ে মাত্র একটা লেখা ছেপেছিলেন। সেখানে ডাকঘরে বেঙ্গল গেজেট নিষিদ্ধ হওয়ার পর দুর্নীতি নিয়ে বাইশটা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে একুশটা, আর কোম্পানির স্বৈরতন্ত্র নিয়ে অন্তত চুয়াল্লিশটা নিবন্ধ বার করেন হিকি। আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হেস্টিংস। তিনি দালাল জাতীয় লোককে চুক্তি পাইয়ে দিয়ে বাজারের দামের তিনগুণ দাম দিচ্ছেন। সুপ্রিম কোর্টকে এড়াতে প্রতিষ্ঠা করেছেন সদর দেওয়ানি আদালতের। সেখানে যাকে প্রধান বিচারপতি করেছেন, সেই এলাইজা ইম্পিকে অজস্র ঘুষ খাওয়াচ্ছেন। হেস্টিংস তার উচ্চাশার জন্য কোম্পানিকে একের পর এক যুদ্ধে জড়াচ্ছেন আর প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ সেনাদের। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ১৭৮১ সালের জুনে মামলা খেয়ে চার দফা শুনানির পর হিকিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং জেল হয় তার। জেল থেকেও হিকি কাগজ চালালেন কিছু দিন। কিন্তু একের পর এক মামলা আনলেন হেস্টিংস। মানহানির মামলা করেছেন গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়য় অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, রিয়েল স্টেটের ব্যাবসায়ী ছাড়াও যাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে হিকি কলাম ছাপিয়েছিলেন। বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হয় হেস্টিংসে অনুগত এলাইজা ইম্পে। জুরি হিসেবেও নিযুক্ত হন হেস্টিংসের অনুগত ব্যক্তিবর্গ। গির্জা, রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা, সকলের বিপরীতে যেমন বিচার আশা করা যায়, তেমনই হল। ৪০ হাজার পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়। যা হিকির পক্ষে অসম্ভব। হিকি কলম চালিয়ে যেতে থাকে কিন্তু তাতে কোন লাভ হল না বরং প্রতিটিতেই হিকিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। হেস্টিংসকে ক্ষতিপূরণ দিতে ছাপাখানা নিলামে তােলা হল ১০ এপ্রিল, ১৭৮৩। নিলামে এসব যন্ত্র কিনে নেয় দ্য ইন্ডিয়া গেজেট’। হিকি’স বেঙ্গল গেজেট এর অবস্থান থেকে যায় শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায়।

দীর্ঘ ইতিহাস হিকিকে অবহেলা করলেও, তরুণ মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গবেষকরা তাকে আবার মর্যাদার আসন দিয়েছেন।

হত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা তরুণ, পেটের দায়ে জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে একদিন বিদায় জানিয়েছিলেন জন্মভূমি বাকিংহামকে। অসংখ্য ব্যর্থতার পর সবে মাত্র দুটো পয়সার মুখ দেখেছিলেন। কি দরকার ছিল! এত এত সমস্যা নিজের করে নেওয়ার। সাহেবদের বস্তাপচা কৌতুকে হেহে করে, তাদের গুণগান ছাপিয়ে কিংবা ইংরেজরাই একমাত্র সভ্যতার ধারক আর ভারতীয়রা অমানুষ কিংবা হায়দার আলিকে নর রাক্ষস বলে কলামটা নাহয় তিনিই ছাপিয়ে দিতেন। কি বা যায় আসতো তাতে! দুটো পয়সা জমাতে পারতেন। বাংলায় কোম্পানির দুঃশাসনের কথা সবাই জানে। কিন্তু ভিনদেশি হয়ে কিসের আশায় যে ক্ষমতার মুখে দাঁড়িয়ে সত্য বলতে গেল!

দুশো চল্লিশ বছর আগের কথা, যে লোকটা দুটো পয়সার আশায় পরিবার পরিজন ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমান, যে একসময় আফ্রিকা থেকে দাস পাচারের জাহাজেও কাজ করেছে। তার কলম কিনা লিখলো, যদি সংবিধান খারিজ হয়, মানুষ দাসত্বে পতিত হয়, এক জন সাহসী মানুষ আর একটা স্বাধীন সংবাদপত্রই তাদের উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে মস্ত বীরপুরুষও স্বাধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে না লিখলেন এই কলকাতা থেকেই।