খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে ইরানের পসারগাদেই এলাকায় হাঁটু গেঁড়ে বসে আছেন অল্পবয়সী এক তরুণ যোদ্ধা। তিনি বসে আছেন প্রায় ১১ মিটার লম্বা পাথরের তৈরী একটি সমাধির সামনে। তীব্র অনুতাপ ও ব্যথার ছাপ ফুটে উঠেছে তরুণের চোখে-মুখে। আশেপাশের মানুষ কিংবা তার সঙ্গে আসা বিশাল সেনাবাহিনীর কেউই বুঝতে পারছে না, পৃথিবী জয় করে আসা বীরের মনে কিসের ব্যথা। এই ভূমির মালিকও তো বর্তমানে তিনিই। সবকিছুই তো তার। তবে কিসের এই অনুতাপ?

কিছুক্ষণ নীরবে সমাধির সামনে বসে থেকে একটু পর উঠে দাঁড়ালেন তরুণ। সমাধির ভেতরটা ভালো করে দেখতে হবে। এই সমাধির অসম্মান কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। এ তো যেনোতেনো সমাধি নয়। সবচেয়ে মহান ও যোগ্য ব্যক্তির শব শায়িত আছে সেখানে। যদি কেউ অসম্মান করেও থাকে, তবে তাকে ছাড়বেন না তরুণ। সমাধির ভেতরে গিয়ে তার মনের আশঙ্কাই যে সত্যি প্রমাণিত হলো। কোনো সম্পদই অবশিষ্ট নেই সেখানে। সমস্ত কিছু লুট হয়ে গেছে। মহান গুরুর সমাধির এমন অসম্মান দেখে তরুণ ক্ষোভে পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তদন্তের কাজ শুরু করলেন এবং লুটেরাদের ধরে এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি।

 আলেকজান্ডারের মূর্তি

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত কিশোর আলেকজান্ডারের মূর্তি

কে এই তরুণ? আর কার মৃতদেহই বা শুয়ে আছে সেই সমাধিতে? কেনোই বা তরুণের মনে বেজে উঠেছে অনুতাপের বেদনাময় সুর? আসলে পসারগাদেই এলাকায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনার নায়ক হলেন সদ্য পৃথিবী জয় করা বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং যে সমাধির অসম্মানে তিনি এতো ক্ষুব্ধ হয়েছেন, সেই সমাধিতে শুয়ে আছেন স্বয়ং পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস দ্য গ্রেট। ইতিহাসের মহান দুই নায়ক প্রথম বারের মতো মুখোমুখি হয়েছেন, অথচ একজন জীবিত ও অপর জন মৃত। তবে পারস্য কিন্তু উভয়েরই ছিলো। আজ আলেকজান্ডার নিজের ভারাক্রান্ত মনকে হালকা করার জন্য পৃথিবীর একমাত্র জায়গা হিসেবে সাইরাসের সমাধির শরণাপন্ন হওয়াকেই সমীচীন মনে করেছেন।

পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস দ্য গ্রেট

সাইরাস দ্য গ্রেট

খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সাল। পার্সিয়ান রাজা প্রথম জার্জেসের নেতৃত্বে বিগত ১০ বছর যাবৎ গ্রীসের সাথে যুদ্ধ চলে আসছে। তবে আজকের মতো হিংস্র কখনোই হয় নি পার্সিয়ানরা। চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে গ্রীসের এথেন্সে। এথেন্স নগরী চিরতরে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছে পার্সিয়ানরা। এথেন্সবাসীর আর্তচিৎকার এবং হাহাকারে এক নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এই অসহায় এথেন্সবাসীর মাঝে একজন মা তার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে বের হয়েছেন। পেছনে পড়ে রয়েছে জ্বলন্ত এথেন্স নগরী ও তার পুরো পরিবার। কোলের মেয়ে শিশুটি চিৎকার করে কান্না করেই যাচ্ছে। কিন্তু সেই মা নির্বিকার। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে তিনি সেই ভয়াবহ আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণের মাঝেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো তার। জ্বলন্ত অগ্নিস্ফূলিংগের প্রতিবিম্ব দেখা গেলো তার দুই চোখে। এই প্রতিবিম্ব আসলে ছিলো তার ভেতরকার প্রতিশোধস্পৃহা।

এথেন্সের সেই ধ্বংসযজ্ঞের পর বহু বছর পার হলো। পারস্য এবং গ্রীসের সেই যুদ্ধ ৫০ বছর স্থায়ী হয়েছিলো। মেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের সুযোগ্য সন্তান আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট উঠেপড়ে লাগলেন পারস্য জয়ের অভিযানকে সফল করবার জন্য। মৃত বাবার অসম্পূর্ণ ইচ্ছাকে তিনি পূরণ করেই ছাড়বেন। পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে এক সুপ্ত ক্ষোভ ছিলো গ্রীকদের মনে সব সময় মেসিডোনিয়া থেকে রওয়ানা হয়ে এক এক করে সমস্ত রাজ্য জয় করে নিতে লাগলেন আলেকজান্ডার। রাজারাও নিজে থেকেই তার বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন। অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ সালে গগোমেলার যুদ্ধে পারস্য সম্রাট তৃতীয় ডেরিয়াসকে পরাজিত করেন আলেকজান্ডার। যুদ্ধে হেরে তৃতীয় ডেরিয়াস পালিয়ে গেলে বিনা বাধায়ই পারস্য জয় করে ফেলেন তিনি।

পারস্য জয় গ্রীকদের জন্য বিশাল অর্জন। আলেকজান্ডারও বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে মহা আনন্দিত। তাই তিনি ও তার সেনাবাহিনী সেই বিজয়ের রাতটি আনন্দ-উল্লাস করে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। গ্রীস থেকে সঙ্গে আনা হয়েছিলো বেশ কিছু নর্তকীকে। তাদের মাঝে একজন বিশেষ নর্তকী ছিলেন। আলেকজান্ডার তাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। আর সেই নর্তকীও আলেকজান্ডারকে তার কথায় সহজেই প্রভাবিত করতে পারতেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সাল। পারস্য বিজয়ের সেই রাতে আলেকজান্ডার ও তার সৈন্যরা প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করলেন। প্রচন্ড নেশায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন আলেকজান্ডার। সে সময় তার পাশে ছিলেন সেই বিশেষ নর্তকী। মদ্যপানের এক পর্যায়ে তিনি আলেকজান্ডার ও তার সৈন্যদের মনে করিয়ে দিতে লাগলেন, কতোটা বর্বরভাবে পার্সিয়ানরা গ্রীকদের ওপরে অত্যাচার করেছিলো এবং কিভাবে গ্রীকদের এক সমৃদ্ধ নগর তারা ধ্বংস করেছিলো। নর্তকীর কথা শুনে আলেকজান্ডার বাহিনীর অন্তরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠতে শুরু করলো। নর্তকী সুযোগ পেয়ে সেই প্রতিশোধের আগুনে ঘি ঢালতে লাগলেন। আলেকজান্ডারকে তিনি বোঝালেন, পার্সিয়ানদেরকেও উপযুক্ত শাস্তিই দেয়া উচিৎ, তাদের বিশাল সাম্রাজ্যকেও ধ্বংস করে ফেলতে হবে যেনো গ্রীসের সামর্থ্য ও গৌরবের ওপর আর কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। নর্তকীর কথায় কাজ হলো। আলেকজান্ডার আর কিছু ভাবতে পারলেন না। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন তিনি আর তার সেনাবাহিনী। পারস্য সাম্রাজ্যের গৌরব ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী পার্সেপোলিসকে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দিলেন প্রাসাদে। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো পার্সেপোলিস। ঠিক এথেন্সের মতোই সেই রাতে পার্সিয়ান নাগরিকদের আর্তচিৎকারে নরকে পরিণত হলো পার্সেপোলিস।

আলেকজান্ডারের ভাবনাকে উসকে দেয়া সেই নর্তকী হয়তো এথেন্সের বেঁচে যাওয়া সেই মা ও শিশুকন্যার মতোই কারো বংশধর ছিলেন, যিনি এথেন্সের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা শুনেই বড় হয়েছেন। স্বজন হারানোর ব্যথা হয়তো তার মধ্যেও গেঁথে গিয়েছিলো, সেই সাথে প্রতিশোধস্পৃহাও। হয়তো পারস্য অভিযানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই আলেকজান্ডারের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন সেই নর্তকী এবং সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন এতো দিন। আজ যখন উপযুক্ত সময় এসেছে, তখন পার্সেপোলিসের জ্বলন্ত আগুন দেখে তিনি নিজের অন্তরের আগুনকে নেভাতে সক্ষম হয়েছেন।

এথেন্সের অ্যাক্রোপলিসের মুর্তি

প্রাচীন মাস্টারপিস যা অলৌকিকভাবে এথেন্সের পারস্য ধ্বংস থেকে বেঁচে গিয়েছিল যখন অ্যাক্রোপলিস পুড়ে গিয়েছিল

এদিকে নেশা কাটবার পর থেকেই আলেকজান্ডার কেমন যেনো চুপ হয়ে গেছেন। পার্সেপোলিসের লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন তিনি ভেতরে ভেতরে। বারবারই ভাবছেন, এ কি করলেন তিনি! এমন দানবে কি করে পরিণত হলেন তিনি! তার একজন বুদ্ধিমান সেনাপতি তাকে বুঝিয়েছিলেনও যে, পার্সেপোলিসকে ধ্বংস করার কোনো প্রয়োজনই নেই, বরং এতো চমৎকার ঐতিহ্যে ভরা এই নগরীকে তিনি ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারতেন, পারস্য তো তারই। এতোসব ভাবতে ভাবতে ভীষণ অনুতপ্ত হয়ে পড়লেন আলেকজান্ডার। কিন্তু এখন আর অনুতপ্ত হয়ে কি লাভ! সামনের বিশাল পার্সেপোলিস ততোক্ষণে ভস্ম হয়ে গেছে।

হঠাৎ করেই আলেকজান্ডারের মনে পড়লো পারস্যের পিতা সাইরাসের কথা। তার সম্পর্কে অনেক গল্প তিনি শুনেছেন। মহান সাইরাস শূন্য থেকে গড়ে তুলেছিলেন এই বিশাল সাম্রাজ্য। তিনি ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক। তার চিন্তা-ধারা আলেকজান্ডারকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করতো। মনে মনে গুরু মানতেন তিনি সাইরাসকে। আজ হঠাৎ করেই আলেকজান্ডারের ইচ্ছে হলো, সাইরাসের কবরে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে ক্ষমা চাইতে। মহান গুরুর তিলে তিলে গড়ে তোলা বিশাল সাম্রাজ্য যে নিমিষেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন তিনি। এই অনুতাপের শেষ হবে সেখানেই।

আলেকজান্ডার বহু কষ্টে পসারগাদেইতে খুঁজে পেলেন সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধি

সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধি

আলেকজান্ডার বহু কষ্টে পসারগাদেইতে খুঁজে পেলেন সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধি। কিন্তু ততো দিনে সমাধির সমস্ত সম্পদ লুট হয়ে গেছে। তাই লুটেরাদের ধরে এনে তিনি উপযুক্ত শাস্তি তো দিলেনই, সেই সাথে সাইরাসের সমাধিকে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে আবারো সজ্জিত করলেন। হয়তো এভাবেই আলেকজান্ডার তার অন্তরের অনুতাপ কিছুটা কমাতে পেরেছিলেন।

 

রেফারেন্সঃ