সতেরো শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে জাহাজভর্তি করে কৃষ্ণবর্ণের মানুষগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমেরিকার উদ্দেশ্যে। অর্ধনগ্ন, ভয়ার্ত ও অসহায় সেসব মুখগুলোর মাঝে ছিলেন একজন নারী, নাম ডাস্কি স্যালি। সে সময় নারী দাসীদেরকে সাধারণত ব্যবহার করা হতো ‘বায়াবায়া’ হিসেবে। ‘বায়াবায়া’ অর্থ পুরুষের শয্যাসঙ্গী। ডাস্কি স্যালিকে খুবই অল্প দামে কিনে নিলেন জন হেমিংস নামের একজন শ্বেতাঙ্গের ব্যক্তি। বলাই বাহুল্য, শারীরিক সম্পর্কই ছিলো তার প্রধান উদ্দেশ্য। ডাস্কি স্যালির গর্ভে জন্ম নিলেন জন হেমিংসের শিশুকন্যা বেটি হেমিংস। দাসীদের গর্ভে নিজের সন্তান হলেও দাস-মালিকেরা কখনোই তাকে নিজ সন্তানের মর্যাদা দিতেন না। আর খুব কম দাসেরই সৌভাগ্য হতো নিজের পরিবারের সঙ্গে দিনযাপনের। বেটি হেমিংসের ক্ষেত্রেও মায়ের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য ঘটে নি। জন ওয়েলস নামের আরেক ব্যক্তির তামাকের ক্ষেতে কাজ জুটলো বেটির। জন ওয়েলসের অনেকগুলো বিয়ে হলেও স্ত্রীদেরকে অকালমৃত্যুর হাত থেকে তিনি বাঁচাতে পারেন নি। তবে তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিলো, নাম মার্থা। ওয়েলসও বেটিকে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করলেন। বেটির গর্ভে ওয়েলসের মোট ছয় জন সন্তানের জন্ম হলো। এদের মধ্যেই তার একজন কন্যা ছিলো, নাম স্যালি হেমিংস।
ক্রমাগত কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গের সংকরায়নের ফলে বেটির সন্তানদেরকে দেখতে আর নিগ্রো মনে হতো না। তবুও ক্রীতদাসীর গর্ভের সন্তান হবার কারণে তাদেরকে কৃষ্ণবর্ণ ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী বলেই গণ্য করা হতো। তবে স্যালি ও তার ভাই-বোনেরা অন্যদের তুলনায় ভাগ্যবান ছিলেন। তারা পুরো পরিবার একই মালিকের অধীনে একসাথেই বসবাস করছিলেন।
এক সময় ঊনত্রিশ বছর বয়সী এক যুবকের সঙ্গে প্রণয়ে জড়ালেন স্যালির সৎ বোন মার্থা। তাদের বিয়েও হলো এবং এই বিয়ের পরপরই মারা গেলেন জন ওয়েলস। শ্বশুরের মৃত্যুতে তার সমস্ত সম্পত্তিসহ প্রায় ১৩৫ জন ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীর মালিক হলেন মার্থার স্বামী। সে সময় স্যালির বয়স মাত্র দুই বছর। দুই বছর বয়সী স্যালি হেমিংসকে তার ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছিলো এক বিশেষ মালিকের অধীনে। কেননা মার্থার স্বামী আর কেউ নন; যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, কূটনীতিবিদ, স্থপতি, দার্শনিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রনায়ক টমাস জেফারসন।
কি বিশ্বাস হচ্ছে না? হ্যাঁ, সেই টমাস জেফারসনের কথাই বলছি, যিনি ১৭৭৬ সালের জুন মাসে তেত্রিশ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা রচনা করেছিলেন, যিনি তার অমর সেই ঘোষণায় স্পষ্ট ভাষায় ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জকে দাসবাণিজ্যের জন্য দোষারোপ করেছেন। বিশ্বাস হয়, এই টমাস জেফারসনই ছিলেন ১৩৫ জন ক্রীতদাসের মালিক? তবে গল্প এতোটুকুতেই শেষ নয়, নৈতিকতার মুখোশ পরিহিত এই প্রেসিডেন্টের জীবনে আরো বহুল আলোচিত ঘটনা আছে। কেননা এই কাহিনীর নায়ক কিংবা খলনায়ক জেফারসন হলেও, নায়িকা কিন্তু সেই ছোট্ট স্যালি হেমিংস, যিনি একই সাথে জেফারসনের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একজন ক্রীতদাসী।
স্যালির ভাগ্য কিছুটা প্রসন্ন ছিলো। খুব পরিশ্রমের কাজগুলো তাকে করতে হতো না। গৃহস্থালির সাধারণ কিছু কাজকর্ম এবং মার্থার সন্তানদেরকে দেখাশোনার দায়িত্বই তাকে দেয়া হয়েছিলো। কোনো এক বিশেষ কারণে হয়তো স্যালির প্রতি মার্থার এক অন্য রকম আস্থা ছিলো। তবে মার্থার ভাগ্য তেমন প্রসন্ন ছিলো না। তার সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা ছিলো ভীষণ কষ্টদায়ক। মোট ছয়টি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন মার্থা, কিন্তু এর মাঝে দীর্ঘ সময় বেঁচে ছিলেন মাত্র দুই জন কন্যা –প্যাটসি এবং পলি (পরবর্তীতে পলি ‘মেরী’ কিংবা ‘মারিয়া’ নামে পরিচিত হন)। এমনকি শেষ যে কন্যা সন্তান লুসিকে জন্ম দিতে গিয়ে ১৭৮২ সালে মার্থা মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেই সন্তানও খুব বেশি দিন বাঁচেন নি। মার্থা যখন মারা যান, তখন প্যাটসির বয়স মাত্র দশ বছর এবং পলির মাত্র চার বছর।
স্ত্রী-বিয়োগের দুঃখ ভুলতে টমাস জেফারসন বড় মেয়ে প্যাটসিকে নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং ভার্জিনিয়ার মন্টিচেলোতে পলির সঙ্গে রয়ে যান স্যালি। পরবর্তীতে লুসির মৃত্যুসংবাদ জেফারসনকে কাতর করে তোলে এবং পলিকেও তিনি প্যারিসে আনার ব্যবস্থা করেন। আর পলির সঙ্গে স্যালি হেমিংসের ভালো বন্ধুত্বের কারণে তার সফরসঙ্গী হন স্যালি। সাথে অবশ্য স্যালির ভাইও গিয়েছিলেন, কারণ একজন উন্নতমানের শেফ হবার যোগ্যতা তার ছিলো।
১৭৮৭ সালে প্যারিসে আসেন স্যালি হেমিংস। প্যারিস তখন এক বৈপ্লবিক শহর। ১৭৮৯ সালে সেখানে দাস-প্রথাও বাতিল করা হয়। স্যালির জন্য প্যারিসে কাটানো সময়টা ছিলো স্বপ্নের মতো। সেখানে তিনি ছিলেন মুক্ত পাখির মতো। নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে দুই ডলার করে পেতেনও। শিখেছিলেন ফরাসি ভাষাও। এছাড়াও অনেক কাজকর্মের জন্য উপযুক্ত ট্রেনিং নিয়ে নিজেকে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। আধুনিক ফ্যাশনের পরিপূর্ণ জ্ঞান ও দক্ষতাও তিনি অর্জন করেছিলেন। হয়তো খুব কম ক্রীতদাসের ভাগ্যেই এমনটা ঘটেছিলো।
প্যারিসে আসার পর থেকেই চৌদ্দ বছর বয়সের স্যালির প্রতি এক অদ্ভূত নৈকট্য লক্ষ করা যায় টমাস জেফারসনের পক্ষ থেকে। পলি একটু বড় হবার পর থেকে তার বন্ধুদের আড্ডা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক পার্টিগুলোতেও স্যালি তার সঙ্গী হতেন। মেয়েকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য নতুন পোশাক কিনে দেবার পাশাপাশি স্যালিকেও সেসব কিনে দিতেন জেফারসন। হয়তো জেফারসনের একাকীত্ব তাকে স্যালির প্রতি আকর্ষিত করতে শুরু করেছিলো। আর স্যালিও হয়তো তার মুক্ত জীবনকে খুব ভালোভাবেই উপভোগ করছিলেন। প্রায় ২৭ বছরের পার্থক্যসমেত টমাস জেফারসন ও স্যালি হেমিংস একে অপরের প্রেমে পড়েছিলেন বেশ গভীরভাবে। স্যালির গর্ভেও জেফারসনের ছয় জন সন্তানের জন্ম হয়েছিলো, যদিও এর মাঝে মাত্র চার জনই বেঁচেছিলেন।
স্যালি হেমিংসের প্রতি টমাস জেফারসনের অনুভূতি কেমন ছিলো, তা হয়তো আমরা জানতে পারবো না। কারণ এতো আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও স্যালিকে কিন্তু তিনি তার দাসত্ব থেকে কখনোই মুক্তি দেন নি। দাসবাণিজ্যের বিপক্ষে সোচ্চার সেই ব্যক্তিটি কখনোই স্যালির গর্ভের সন্তানদেরকে আপন করে নেন নি। জেফারসনের বড় মেয়ে প্যাটসির সন্তানদের সাথে তাকে বেশ প্রাণবন্তভাবে হাসতে-খেলতে দেখা গেছে। কিন্তু নিজের ক্রীতদাস সন্তানদের সাথে দাসের মতোই আচরণ করতেন তিনি। এ যেনো ভীষণ সাধারণ কোনো ঘটনা!
প্যারিসের সুন্দর জীবন ছেড়ে স্যালি কখনোই যেতে চান নি। কিন্তু জেফারসন তাকে আর তার ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২১ বছর বয়সে স্যালির সন্তানদেরকে তিনি মুক্ত করে দিবেন। এক ধরনের দোটানা নিয়ে গর্ভবতী স্যালি জেফারসনের সঙ্গে আবারো ফিরে আসেন ভার্জিনিয়ায়। টমাস জেফারসন ১৮২৬ সালে মারা যান। কিন্তু তার উইলের কোথাও স্যালি এবং তার সন্তানদের মুক্ত করবার কথা উল্লেখ ছিলো না। তার জীবদ্দশায় ১৩৫ জন ক্রীতদাসের মধ্যে মাত্র ৫ জনকে তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন।
১৮০১ সাল থেকে ১৮০৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন টমাস জেফারসন। আদর্শের মুখোশে ঢাকা টমাস জেফারসনের জীবনের এই স্ক্যান্ডাল সাধারণ মানুষের কাছে অপ্রকাশিতই ছিলো বহু দিন পর্যন্ত। কিন্তু ১৮০২ সালে প্রথম বারের মতো তার জীবনের এই সমালোচিত ঘটনা তুলে ধরেন একজন সাংবাদিক, জন থমসন ক্যালেন্ডার। প্রেসিডেন্ট হবার পর জেফারসন তাকে যে বিশেষ পদে অধিষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রক্ষা না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি জেফারসন পরিবারের এই সেনসিটিভ ঘটনাটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। জেফারসন পরিবারকে খুব কাছ থেকেই দেখেছিলেন ক্যালেন্ডার। তবু টমাস জেফারসনের পক্ষে ও বিপক্ষে এই নিয়ে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু ১৮৭৩ সালে ৬৮ বছর বয়সী একজন প্রাক্তন ক্রীতদাস স্বীকারোক্তি দেন যে, তার নাম ম্যাডিসন হেমিংস এবং তিনি স্যালি হেমিংস ও টমাস জেফারসনের সন্তান। তার স্বীকারোক্তিতে তিনি এ-ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, তার মা স্যালি হেমিংস দীর্ঘ দিন টমাস জেফারসনের রক্ষিতা ছিলেন। অবশেষে ১৯৯৮ সালে হেমিংস পরিবারের বংশধরদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয় যে, স্যালি হেমিংসের সবগুলো সন্তানের বাবাই ছিলেন টমাস জেফারসন।
উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব, দাস-মালিক বৈষম্য কোনো নতুন বিষয় নয়। ভাবলেও অবাক হয় যে, টমাস জেফারসনের মতো একজন ব্যক্তির জন্যও ক্রীতদাস প্রথা পালন এবং একজন ক্রীতদাসীকে রক্ষিতা বানানোর মতো জঘন্য বিষয়টিও ছিলো খুবই সাধারণ ঘটনা। আসলে কি এই জেফারসনই আমাদের এই গল্পের একমাত্র খলনায়ক? আমরা কি একটু নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে পারি না যে, কেনো আজও তুলনামূলক বিত্তবানদের ঘরের কাজে সাহায্যকারী আয়া এবং তার সন্তানদেরকে নিজেদের মতো করে আরাম-আয়েশে থাকার অধিকার দেয়া হয় না? কেনো গ্রীষ্মের তাপদাহ দিনগুলোতে নিজেদের ঘরে এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করা হলেও সাহায্যকারী আয়াদের ঘরে সেই সুবিধা দেয়া হয় না? আমরা প্রত্যেকেই এই অন্যায়গুলো সম্পর্কে অবহিত এবং লজ্জিত; অথচ আমাদের ঘরে ঘটে যাওয়া এই অন্যায়গুলোই যেনো আজ অত্যন্ত সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে, ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদী প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের জীবনে।
রেফারেন্স:
- Sally Hemings (2000) | Documentary
- Descendent of Jefferson and Sally Hemings Learns Details of Their Relationship | Smithsonian
- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তাদের ক্রীতদাস-দাসীরা: ব্যাক্তিগত জীবনে রাজনীতির খোঁজ
- Sally Hemings, the slave of a U.S. president who had 6 children by him
- Jefferson–Hemings controversy.
- “The President, Again” by James Thomson Callender (September 1, 1802)
- Madison Hemings