পার্সিয়ান বিশেষ সেনাবাহিনী পরিচিত ছিলো ‘স্পাডা’ নামে। তবে এই বিশেষের মাঝেও ছিলো আরেক বিশেষত্ব, প্রাচীন পৃথিবীর এক বিস্ময়কর সামরিক বাহিনী। ইতিহাসবিদগণ এদের নাম দেন ‘ইমমোর্টাল’। প্রথম পার্সিয়ান সাম্রাজ্য আকেমেনিড এই অভিজাত সেনাবাহিনীর জন্যই বিখ্যাত ছিলো। ঠিক ঠিক দশ হাজার সৈন্যের একটি পদাতিক বাহিনী নিয়ে গঠিত ছিলো সেই সেনাবাহিনী, একজন কমও নয়, একজন বেশিও নয়। তাদের সংখ্যা সব সময় অপরিবর্তনীয় ছিলো।

এই ইমমোর্টালদের যোগ্যতা ও শক্তি ছিলো প্রচন্ড। পারস্যের ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। রাজ্য বিস্তারের সূচনালগ্ন থেকেই এই ইম্পেরিয়াল গার্ডরা শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশেষ করে গ্রীকো-পার্সিয়ান যুদ্ধে তারা একাধারে স্থায়ী সৈন্য এবং ইম্পেরিয়াল গার্ডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পার্সিয়ানদের জন্য ছিনিয়ে এনেছিলেন একের পর এক বিজয়। এভাবেই তারা প্রাচীনতম বিখ্যাত যুদ্ধবাহিনীর সুনাম অর্জন করেছিলেন।

তাদেরকে ‘ইমমোর্টাল’ কেনো বলা হয়, তা-ও বলে গিয়েছেন হেরোডোটাস। এই ১০ হাজার সৈন্যদলের মাঝে একজন সৈন্যও যদি যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করতেন কিংবা আহত হতেন, তবে তৎক্ষণাৎ অন্য একজন সৈন্য গিয়ে আহত বা নিহত সৈন্যের পরিপূরক হিসেবে অবস্থান গ্রহণে সদা প্রস্তুত থাকতেন। এভাবেই যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের সৈন্যসংখ্যা অপরিবর্তিত থাকতো ও সুসংহত বাহিনীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকতো বলেই ‘ইমমোর্টাল’ বা ‘অমর’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলো এই সেনাবাহিনী।

আকেমেনিড সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট সাইরাসের সময়েই এই ইমমোর্টালদের সূচনা হয়। রাজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একের পর এক সাইরাসের সামরিক অভিযানগুলোতে ইমমোর্টালরা তার ব্যক্তিগত প্রহরী এবং শার্কস্কোপস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গ্রীক সামরিক নেতা, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ জেনোফোন বলেন, সেনাবাহিনীর সবচাইতে দক্ষ সৈন্যদের নিয়ে সাইরাস এই অভিজাত ইউনিটটি গড়ে তুলেছিলেন। সমাজের উচ্চবিত্ত দল থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বাহিনীর সদস্য নির্বাচিত হতো।

Ranks of Immortals

ইমমর্টাল তীরন্দাজ © Wikimedia Commons

পারস্যের সৈন্যদলের প্রশিক্ষণ শুরু হতো পাঁচ বছর বয়স থেকে। সেই শৈশবকাল থেকেই তাদেরকে ধনুকের ব্যবহার, জ্যাভেলিন বা বর্শা নিক্ষেপ, ঘোড়া চালানো ইত্যাদি শেখানো শুরু হয়ে যেতো। যুদ্ধকালীন সময়ের প্রতিকূলতার মোকাবেলার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। শেখানো হতো কিভাবে শিকার করতে হয়। খরা, তাপ, বৃষ্টি প্রভৃতিতে তাদের সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি করবার বিরাট দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতেন প্রশিক্ষকগণ। তাদেরকে নিয়মিতভাবে দৌড়সহ নানা ধরনের অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হতো। চরিত্র বিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো ইমমোর্টালদের প্রশিক্ষণের সময়। পার্সিয়ান ধর্ম জরাথ্রুস্টবাদ, দেবতা আহুরা মাজদার প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপকভাবে জ্ঞান লাভ করতে বাধ্য থাকতেন তারা। শুধু তা-ই নয়, পার্সিয়ান ইতিহাসের মহাপুরুষদের বিভিন্ন অবদান সম্পর্কে তাদেরকে অবগত করে নিজেদেরকে মহান সেনা হিসেবে গড়ে তুলবার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো। প্রতি মুহূর্তে তাদেরকে পারস্যের দেবতা, পারস্যের জনগণ, বিশেষ করে পারস্যের রাজার প্রতি তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো। একজন শক্তিশালী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবার জন্য তাদেরকে সত্য বলার প্রশিক্ষণও দেয়া হতো। এক টানা প্রশিক্ষণ লাভের পর তারা যখন ২০ বছর বয়সে উপনীত হতেন, তখন তাদেরকে সরকারি সামরিক বাহিনীতে যুক্ত করে রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত করা হতো।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ইমমোর্টাল বাহিনীর জন্য ছিলো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। রণক্ষেত্রে যাবার সময় তারা নিজেদের স্ত্রী, উপপত্নী এবং দাসদেরকেও সঙ্গে নিতে পারতেন। তাদের পরিবহনের জন্য ছিলো বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা। এই গাড়িতেই থাকতো খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। এই বাহিনীর সদস্য হবার সুযোগ যারা পেতেন, তাদেরকে বিশেষ ভাগ্যবান মনে করা হতো।

সামরিক শক্তির প্রতীক এই ইমমোর্টালদের সম্পর্কে হেরোডোটাসের বিবরণ ছাড়া অন্য সূত্র থেকে খুব কমই তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ঐতিহাসিক বিবরণের স্বল্পতার কারণে বিশদভাবে এদের বর্ণনা করা কঠিন। তবে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সমসাময়িক ইতিহাসবিদদের লেখায় ‘অ্যাপল বিয়ারার্স’ নামের একটি অভিজাত গোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায়, যাদের বর্শার মাথায় আপেল আকৃতির ভারী ধাতব বস্তু যুক্ত থাকতো। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বর্শায় ব্যবহৃত হতো সোনার তৈরী ভার এবং সাধারণ সৈন্যদের জন্য ব্যবহার করা হতো রূপার তৈরী আপেল। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের ধারণা, এই অ্যাপল বিয়ারার্সরাই ছিলেন পার্সিয়ান ইমমোর্টাল বাহিনী।

Persepolis_Apadana_noerdliche_Treppe

পার্সেপোলিসে খোদাইকৃত মিডিয়ান ও পার্সিয়ান যোদ্ধা, যাদেরকে অনেক পন্ডিতরা ইমমোর্টাল বাহিনীর সদস্য মনে করেন © Wikimedia Commons

ইমমোর্টালদের সুগঠিত অবয়ব, প্রশিক্ষণ ও চর্চার মাধ্যমে তৈরী তাদের দেহশৈষ্টব শত্রুদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম ছিলো। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেও এরা বেশ সতর্কতার সাথেই অগ্রসর হতেন। তাদের অত্যাধুনিক সাজ-সজ্জা শত্রুদের মনে ভীতি সঞ্চার করবার জন্য যথেষ্ট ছিলো। রণক্ষেত্রে যখন ইমমোর্টাল সৈন্যরা হেঁটে যেতেন, তখন সূর্যের আলোতে চিকচিক করে উঠতো তাদের পরিধেয় ব্রোঞ্জ এবং লোহা দিয়ে তৈরী দেহবর্ম। অনেক সময় দুর্বল শত্রুপক্ষ ইমমোর্টালদের পোশাক এবং সূর্যের আলোয় জ্বলতে থাকা বর্মটি দেখেই রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেতেন কিংবা আত্মসমর্পণ করতেন। হেরোডোটাসের মতে, মাথায় তারা টিয়ারা বা এক ধরনের হেডড্রেস পরিধান করতেন। মূলত ময়লা ও ধুলোবালি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই এই টিয়ারা তারা ব্যবহার করতেন বলে ধারণা করা হয়। ঢিলেঢালা ক্যাপের মতো ছিলো টিয়ারাটি। তাদের লোহার বর্মের গায়ে থাকতো রঙিন টিউনিক, দেখতে কিছুটা মাছের আঁইশের মতোন ছিলো সেগুলো। পায়ে পরিধানের জন্য ছিলো প্যান্ট।

ইমমোর্টালদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো ঢাল, ছোট আকৃতির বর্শা, তলোয়ার ও বড় ছোঁড়া। সাধারণ ঢালের পরিবর্তে তারা ব্যবহার করতেন বেতের ঢাল। বেতের তৈরী একটি বেল্টে ঝুলানো থাকতো ছুড়ি। এ ছাড়া তীর-ধনুক তো ছিলোই।

আশেপাশের স্বাধীন নগররাষ্ট্রগুলো জয় করবার ক্ষেত্রে ইমমোর্টালরা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। পারস্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনবার কৃতিত্ব ৭০ ভাগই তাদের। সাইরাস দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে এই অপ্রতিরোধ্য বাহিনীকে সাথে নিয়েই ব্যবিলন জয় করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ সালে দ্বিতীয় ক্যাম্বাইসেসের মিশর জয়ের সময়ও তারা শক্তি যুগিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫২০ এবং ৫১৩ সালে পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সিথিয়ানদের পরাক্রান্ত করে পারস্য সাম্রাজ্যকে তার বিশাল রূপ পেতে সাহায্য করেছিলেন এই ইমমোর্টালরা। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালে থার্মোপাইলির যুদ্ধে গ্রীকরা পারস্যের বিজয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পার্সিয়ানদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করবার জন্য প্রবেশপথটিকে তারা শক্তির সাথে অবরুদ্ধ করে রাখেন। কিন্তু ইমমোর্টাল বাহিনী ঠিকই ভিন্ন পথ খুঁজে বের করে পেছন দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে গ্রীকদের ওপর আক্রমণ করে বসেন। এসব ঘটনার বিবেচনায় শক্তিশালী ইমমোর্টালরা তাদের সংখ্যার ধ্রুবত্ব, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রাচীন মিলিটারী ইতিহাসে সবার বিস্ময়ের পাত্র হিসেবে পরিগণিত হতেন।

Men with Shields & Spears from Persepolis

পার্সেপোলিসে খোদাইকৃত ঢাল এবং বর্শা সহ ইমমোর্টালস © World History

পঞ্চাশ বছর বয়সে ইমমোর্টাল সেনাসদস্যদেরকে অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হতো। তাদেরকে বসবাসের জন্য জমি ও পেনশন দেয়া হতো এবং বাকি জীবন যাতে তারা আরাম-আয়েশে কাটাতে পারেন, সেই ব্যাপারটিও নিশ্চিত করা হতো।

সাইরাসের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি এবং আকেমেনিড সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ বংশধররাও তাদের জীবদ্দশায় ইমমোর্টালদেরকে প্রধান বাহিনী হিসেবে নিয়োগ দিতেন। বহু দিন পর্যন্ত এই বিশেষ সৈন্যবাহিনী পারস্যের বিজয় অর্জনে ভূমিকা রেখে গেছেন।

আলেকজান্ডারের কাছে পারস্য সম্রাটের পরাজয়ের পর আকেমেনিড সাম্রাজ্যের শেষ বাঁশি বেজে ওঠে। তবে ইমমোর্টালদের দিন কিন্তু তখনও শেষ হয়ে যায় নি। আলেকজান্ডার সাইরাসকে ভীষণ পছন্দ করতেন এবং সাইরাসের মতোই নিজের প্রাসাদের প্রতিরক্ষার জন্য পার্সিয়ান সৈন্যের একটি অভিজাত বাহিনীকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। সুদর্শন, দীর্ঘাঙ্গী, পারস্যের অলংকারে সজ্জিত, হাতে ছোট তলোয়ারবিশিষ্ট সেনারা অবস্থান করতেন আলেকজান্ডারের দরবার কক্ষের চারপাশে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য সাতটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই ইমমোর্টালরা সেলিউসিড সাম্রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন কি না, সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানা যায় নি। অনেকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ সালের গগোমেলার যুদ্ধ পর্যন্তই এই বিশেষ বাহিনীকে দেখতে পাওয়া যায়। সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিকাশ লাভের সময় আবারও এক অভিজাত সেনাবাহিনী তৈরী করে সাসানীয় সম্রাটরা ইমমোর্টালদের নিয়োগ দিয়েছিলেন বলেও জানা গেছে।

Alexander Sarcophagus

আলেকজান্ডার সারকোফ্যাগাস © World History

রেফারেন্স: