লোবান ইতিহাস ও বিপন্নতা আজ শুধু সুগন্ধির গল্প নয়, বরং এটি ছয় হাজার বছরের এক পবিত্র ঐতিহ্যের সঙ্কটের কাহিনি।
অনেক অনেক বছর আগের কথা। ইয়াকুব নামে এক মহানবীর পরিবারে ঘটেছিল এক করুণ ঘটনা—তাঁরই প্রিয় পুত্র ইউসুফকে তাঁর সৎ ভাইয়েরা তুলে দিয়েছিল একদল বণিকের হাতে। কালের পরিক্রমায় অনেকেই মনে করেন, ওই বণিকরা ছিল সুগন্ধির ব্যবসায়ী—গন্ধবণিক। গবেষকরা বলেন, এই তথ্য যদি সত্য হয়, তবে লোবান ইতিহাস ও বিপন্নতা শুরু হয়েছে অনেক আগেই, অন্তত ছয় হাজার বছর আগে!
আমাদের উপমহাদেশে “লোবান” নামটা খুব অপরিচিত নয়। ধূপধুনোর গন্ধের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন—লোবান এক ধরনের পবিত্র সুগন্ধি। তবে সবাই জানে না, এই লোবানের উৎস ঠিক কোথায়! পৃথিবীর কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে এই সুগন্ধি পাওয়া যায়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে আরব উপদ্বীপ, উত্তর আফ্রিকা আর সোমালিয়ার বাজারে লোবানের বেচাকেনা চলে আসছে।

পুন্ট থেকে মিশরে ধূপগাছ পরিবহন, হাতশেপসুতের মন্দির, দেইর এল-বাহারি
প্রাচীন মিশরের রানী হাতশেপসুতের সমাধিমন্দিরে পাওয়া এক বিখ্যাত দেয়ালচিত্রে দেখা গেছে, পান্ট নামের এক নগর থেকে নানা পণ্যের সঙ্গে করে আনা হচ্ছে লোবান। সেই সুগন্ধি তখনই ছিল পবিত্রতার প্রতীক, আভিজাত্যের চিহ্ন। উপাসনালয়ে প্রার্থনার সময়, রাজদরবারে সম্মান জানানোর মুহূর্তে কিংবা কোনো বিজয়ী বীরের ঘরে, লোবানের মৃদু ধোঁয়া আর সুবাস ঘিরে রাখত বাতাস।
বিজ্ঞানীরা বলেন, গন্ধের অনুভূতি একেবারেই ব্যক্তিগত। এক জোড়া জমজ ভাইবোন ছাড়া আর কেউই নাকি ঠিক একইভাবে এক গন্ধকে অনুভব করতে পারে না! একেক জনের নাকে একেক রকমে ধরা দেয় সেই একই সুগন্ধি।
লোবান নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা জানান, অন্তত ১৯ রকমের লোবান আছে। তবে এর মধ্যে সাত ধরনের গাছ এতটাই দুর্লভ যে সেগুলোর সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। এই গাছ থেকে যে আঠা পাওয়া যায় সেটাকেই বলে লোবান। গাছটার নাম Boswellia sacra। দেখতে অনেকটা আমাদের তেঁতুল গাছের মতো—পাতাও মিল আছে, তবে গাছটা ছোটখাট আর কাঁটায় ভরা। ফল হয় গোলগাল আর লাল। গাছের গায়ে আঁচড় দিলেই বেরিয়ে আসে সুগন্ধি আঠা, যা বাতাসে শুকিয়ে হয়ে যায় ধূপ। ধবধবে সাদা রেজিনের দাম সবচেয়ে বেশি।

মিশরের হাটশেপসুট মন্দিরে ধূপ এবং গন্ধরস গাছের ছবি
এই গাছ চাষ হয় ইয়েমেন, দক্ষিণ ওমান, ইথিওপিয়া, সুদান, সোমালিয়া, এমনকি ভারত ও চীনের কিছু জায়গাতেও।
তবে দুঃখের কথা হলো—এই প্রাচীন উপকারী সুগন্ধি আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা IUCN জানায়, লোবানের উৎস Boswellia sacra গাছ চরম হুমকির মুখে।
মানুষের লোভ, যুদ্ধ, সংঘাত, এবং অতি-শোষণের ফলে ধ্বংস হতে বসেছে ছয় হাজার বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য। যেখানে একসময় লোবানের ধোঁয়া উঠত উপাসনার ধ্বনি আর গীতির সঙ্গে, আজ সেখানে ধোঁয়ার বদলে উড়ে বেড়াচ্ছে দুশ্চিন্তা আর দীর্ঘশ্বাস।

হাতশেপসুত মিন-আমুন উপাসনায় Incense offerings
লোবান শুধু সুগন্ধি নয়—এটি ছিল শান্তি, পবিত্রতা আর সংযোগের প্রতীক। হয়তো সময় এসেছে আবার তাকে রক্ষা করার—সেই গন্ধ, সেই আভিজাত্য, আর সেই অতীতের সুরভিত স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার।